বিজয় দিবসের বিকেলে এসে জানা গেলো এক অদ্ভুত খবর। বরিশালের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেসঙ্গে তার মাতাকেও যিনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী।
অর্থাৎ একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী এবং তাদের মুক্তিযোদ্ধা পুত্রকে রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিজয় দিবসের আগেরদিন কথিত ‘দালিলিক প্রমাণের’ ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই তালিকা প্রকাশ করেছে।
বিষয়টি জানাজানি হয় বরিশালের বাসদ (বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল) নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর একটি ফেসবুক পোস্টে।
ডা. মনীষা তার পোস্টে লিখেছেন: ‘সদ্য প্রকাশিত রাজাকারদের গেজেটে আমার বাবা এবং ঠাকুমার নাম প্রকাশিত হয়েছে। আমার বাবা এড. তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা, ক্রমিক নং ১১২ পৃষ্ঠা ৪১১৩। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে থাকেন! আজ রাজাকারের তালিকায় তিনি ৬৩ নাম্বার রাজাকার। আমার ঠাকুরদা এড. সুধির কুমার চক্রবর্তীকে পাকিস্তানি মিলিটারি বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তিনিও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর সহধর্মিণী আমার ঠাকুমা উষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকারের তালিকায় ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
প্রথমে কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে ডা. মনীষার নামে কেউ হয়তো ভুয়া আইডি খুলে এরকম অসম্ভব একটি মিথ্যা খবর প্রচার করছে। পরে মনীষার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনিই ওই পোস্টটি দিয়েছেন।
এভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মীণিকে রাজাকার বানিয়ে দেওয়ার ঘটনা অবিশ্বাস্যই নয়, ন্যক্কারজনকও বটে। এরকম ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই।
তবে, কেন এরকম একটি ঘটনা ঘটলো তার একটি ব্যাখ্যা বাসদ নেত্রী ডা. মনীষার কাছ থেকেই পাওয়া যায়। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার পুরস্কার পেলাম আজ। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগকে।…. শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য আমার রাজনীতি করার খেসারত দিতে হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগ সরকারকে।’
বরিশালের অনেকের ধারণা যে বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডা. মনীষা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী হওয়ার কারণেই তার মুক্তিযোদ্ধা পিতা এবং পিতামহীকে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের তালিকা ধরে গত রোববার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে কোনভাবেই অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী এবং তার মা শহীদজায়া উষা রানী চক্রবর্তীর নাম থাকতে পারে না।
অনেকের মতো আমাদেরও মনে হয় যে প্রতিহিংসাবশতঃ স্থানীয় কেউ রাজাকারের তালিকায় তাদের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, স্থানীয় প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কীভাবে তা মেনে নিলো? তালিকাটি প্রকাশের আগে কর্মকর্তারা কি তা যাচাই-বাছাই করে দেখেননি!
ডা. মনীষার পরিবারের এই ঘটনা নিয়ে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন তোলপাড়, ঠিক তখনই আরেক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করেছে একাধিক গণমাধ্যম। সেই খবরে বলা হয়েছে, সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নাম আছে বায়ান্ন’র ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নাম। যিনি ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য এবছর একুশে পদক পেয়েছেন।
তার মানে এই তালিকা তৈরির কাজে যারা জড়িত ছিলেন, তারা যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন – তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকেও তারা এমন হাস্যকরভাবে করেছে। কিন্তু এই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কেন্দ্রে কারা? এদেরকে অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে তাদেরকে।
আমরা মনে করি, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনকে এখনই সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদজায়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে রাজাকারের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চরম অবমাননা।
যারা এ কাজটি করেছে তারা কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হতে পারে না। এরা হচ্ছে চেতনা ব্যবসায়ী; যাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থে ব্যবহারের একটি হাতিয়ার। আমরা অবিলম্বে রাজাকারের তালিকা থেকে ওই তিনজনের নাম প্রত্যাহার, এরকম ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতার প্রতিশ্রুতি চাই।