রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পী পরিচিত কনকচাঁপা নামে। নিজেকে পরিচয় দেন কণ্ঠশ্রমিক হিসেবে। গান অন্তপ্রাণ শিল্পী গানের পাশাপাশি সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। লেখেন কবিতা। আঁকেন ছবিও। কনকচাঁপার অজানা পাঁচ অধ্যায় নিয়ে এই আয়োজন।
ছবি আঁকা
ফেসবুকে মাঝে মাঝে নিজের আঁকা ছবি পোস্ট করেন। তাইবলে তিনি গানের পাশাপাশি ছবি আঁকেন এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। বরং গানের আগে ছবি আঁকা শুরু। কনকচাঁপার বাবা ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। বলা যায়, অঙ্কনের প্রতি প্রেম তার জন্মসূত্রে। চিত্রশিল্পী বাবা চাননি মেয়ে ছবি আঁকুক। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়ে গান বাদ দিয়ে ছবি আঁকলে দেশের সংগীতাঙ্গনের ক্ষতি হবে। দেশ সুললিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপাকে হারাবে।
ফলে বাবার কড়া নিষেধ, ছবি আঁকা বন্ধ। বাবার অনুগত কন্যা ছবি আঁকার চিন্তা সরিয়ে ধ্যানমজ্ঞ হলেন গানে। নিজেকে সুরের জলে ভাসিয়ে দিলেও মাঝে মাঝেই মন খারাপ হতো রঙতুলির জন্য। কলম আর কাগজ পেলেই আনমনে আঁকতে শুরু করতেন।
বাবার মৃত্যুর পর কনকচাঁপার মা রঙতুলি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমার বাবা যে জায়গায় দেখতে চেয়েছিল তুমি সে জায়গায় পৌঁছে গেছ। এখন ইচ্ছে করলে ছবি আঁকতে পারো।’
আর ঠেকায় কে? রঙতুলির আঁচড়ে প্রাণবন্ত হতে শুরু করল সাদা কাগজ। কখনো সে কাগজে ফুটে ওঠে প্রাণের আদি রহস্য। কখনো নিশুতি রাতের জোসনা। পাতার ফাঁকে বসে থাকা বুলবুলি পাখি। পাখা মেলানো প্রজাপতি। প্রজাপতি এত জীবন্ত যেন, শব্দ করলেই উড়ে যাবে।
আঁকতে আঁকতে কখন তা শয়ের ঘর ছাড়িয়েছে, খেয়ালই করেননি।
গত বছরের এপ্রিলে তার আঁকা শতাধিক ছবি নিয়ে ‘দ্বিধার দোলাচল’ নামে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে শিল্পকলা একাডেমিতে। ‘ছবি আঁকার সময় রঙের প্রতি লোভ জাগে। রঙের লুকোচুরি তাকে মোহিত করে। সাদাকালো রঙের প্রতি দুর্বলতা কাজ করে। ছবি আঁকতে গিয়ে লড়াই করতে হয় আলোর খেলার সঙ্গে। আমার এখনো মনে হয় ছবি আঁকা শেখা উচিৎ। জন্মসূত্রে পাওয়া প্রতিভার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেকোনো প্রতিভাকে গতিশীল ও নিখুঁত করে।’ ছবি আঁকা নিয়ে বলছিলেন কনকচাঁপা।
সামাজিক কাজে সম্পৃক্ততা
সামাজিক কাজকর্মে গানের মতো সরব কনকচাঁপা। নিজেকে সমাজের প্রতিনিধি ও সমব্যথী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। তার মা নিবেদিত সমাজহিতৈষী। ছোটবেলা থেকে দেখেছেন, মা পরিবারের কাজে যত সময় দেন, সমাজের কল্যাণেও সমান সময় দেন। সেই শিক্ষা থেকে কনকচাঁপা মনে করেন, সমাজের পাশে দাঁড়াতে অনেক টাকা-পয়সার চেয়ে সদিচ্ছা বেশি প্রয়োজন। খুব ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেও হাসি ফোটানো যায় পিছিয়ে পড়া দুঃখী মানুষদের। তার দাদাবাড়ি সিরাজগঞ্জ। নদীভাঙন এলাকা। ফলে গরীবদের অভাব, কষ্ট খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন।
যে কারণে প্রায় বিশ বছর ধরে তাদের পাশে দাঁড়ান নিজ তাগিদে। শুরুতে ছিলেন প্রচারবিমুখ। ভালো কাজ প্রচার করে বেড়ানোয় গর্ব নেই বলে মনে করতেন। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে চিন্তা। এখন মানুষ ফেসবুকমুখী। খুব সহজেই চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারছে। ভালো কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে অন্যদের। সমাজের বিত্তবান যারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় তাদের একত্র করা যায় সহজেই।
এবছর শীতকালে বগুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চার শতাধিক দরিদ্র, বৃদ্ধের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছেন একটি করে কম্বল। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছেন দেশ-বিদেশে অবস্থানরত ভক্ত, অনুরাগী, বন্ধুরা। কম্বল যেন সত্যিকার দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছায়, সেদিকটা দেখভাল করেছেন তার স্বামী সুরকার মইনুল ইসলাম খানের বন্ধু গ্রাম থিয়েটারের তৌফিক হাসান ময়না।
কনকচাঁপা বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে অনেক সেলিব্রেটি আছেন। এরা সামাজিক কর্মবিমুখ। জাতীয় পর্যায়ে যে মানুষটা অবস্থান করছেন, তিনি নিশ্চয়ই পরিণত। একজন পরিণত মানুষের বিবেক নিজ থেকেই জাগ্রত না হলে তাকে পরিণত বা জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব বলা যায় কি না তা নিয়েই আমার মনে প্রশ্ন জাগে।’
এদিক থেকে তরুণরাই এগিয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বৃদ্ধদের কাছে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। বরং ফেসবুকে ‘নাইস পিক, কিউট পিক’- কমেন্টের যুদেও কিছু যুবক কাজ করে যাচ্ছে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। তিনি নিজেকে সেসব যুবকের একজন মনে করি আমি। এ যুবকরাই বিভিন্ন খরচ বাঁচিয়ে জমিয়ে জমিয়ে শীত, বন্যাসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগিয়ে আসতে পারে।’
যখন একজন মানুষের গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেওয়া হয়। যখন একজন বন্যার্ত পরিবারের হাতে দু’টি খাবার তুলে দেওয়া হয়। সেই মানুষটার চোখে মুখে তাকালে কী যে প্রশান্তি জাগে মনে। এই আনন্দ এই প্রশান্তির সমতুল্য আর কিছু হতে পারে না। এ প্রশান্তি ও আশীর্বাদের লোভেই সবার সবার ভালো কাজ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
অনলাইন স্কুল
রুমানা মোরশেদ কনকচাঁপার একটি অনলাইন স্কুল আছে। নাম ‘আমাদের খেলাঘর ইশকুল’। স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ৩২ জন। সবার ধারণা হতে পারে, এ স্কুলে বুঝি গান শেখানো হয়। কনকচাঁপা জানালেন, স্কুলে গান শেখানো হয় না। এখনকার তরুণ-যুবকদের জীবনমুখী ব্যস্ততা। তাদের প্রথম হতে হবে, গান শিখতে হবে, ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। অনেক কিছু হতে হবে, পেতে হবে। এর বাইরে ফেসবুকে সময় কাটানো তো আছেই। কনকচাঁপা দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়ে এই স্কুলে ক্লাস নেন। গল্পে গল্পে শেখান জীবনবোধ। গল্পে গল্পে বের করা হয় শৈশব ও কৈশোরের ধুলো জমা স্মৃতির মলাট। খুব ছোট ছোট কথা যা সবাই জানে, সবাই শিখেছে কিন্তু ভুলে গেছে। সেই কথাগুলো শেখানো হয় নতুন করে।
তিনি যেমন রোজকার কাজ রোজ দিন করেন স্কুলের ছেলে-মেয়েসম ছাত্রদের একই শিক্ষা দেন। জীবনের বড় পরিকল্পক মাথার ওপরে। তার পরিকল্পনার ওপর কারো পরিকল্পনা নেই।
স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে তার আরেকটি পরিবার। পরিবারে মায়ের ভূমিকায় কনকচাঁপা। একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, ক্লাস, সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়াও মাঝে মাঝে বসে পারিবারিক আড্ডা। বার্ষিক পরীক্ষা, ফলাফলের ভিত্তিতে পুরস্কৃত করা, স্কুলের কারো কোনো সমস্যা হলে সবাই মিলে সমাধান করা হয় স্কুলের মা কনকচাঁপার নেতৃত্বে।
বাগান
কনকচাঁপার অন্যতম ভালো লাগা, ভালোবাসার নাম বাগান। তাকে যদি কেউ বলেন, শিল্পী না হলে কী হতেন? তিনি একবাক্যে বলেন ‘কৃষক হতাম’। কৃষকের বউ না, নিজে কৃষক হওয়ার আজন্ম সাধ তার। তার একান্ত সময় কাটে গাছের সঙ্গে। চারটা বারান্দা ভরা ফুলগাছ। আছে সবজি, টমেটো, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা। একাডেমিতে, পদ্মফুলও আছে তার বারান্দায়।
বাগান করার আনন্দের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা বীজ গজিয়ে যখন সবুজ কচিগাছ বেরিয়ে আসে, আনন্দে কান্না করি আমি। আমার হাত ধরে একটা প্রাণ এসেছে পৃথিবীতে। এর চেয়ে আনন্দের ভাবনা আর কিছু হয় বলে আমি মনে করি না। আল্লাহর কী শক্তি, একটা বীজের ভেতর এত বড় গাছকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন। সেই গাছের ঘুম ভাঙিয়ে জগতের আলো দেখানোর এ খেলা খুব উপভোগ করি।’
বাগান করা নিয়ে বললেন মজার এক গল্প। তার টবে বাতাসে উড়ে এসেছিল একটা শিশুগাছের বীজ। বীজ থেকে গাছ হলো। সবুজ কচি গাছটা বড় হতে শুরু করল। বড় হতে হতে একসময় টব ফেটে যাওয়ার অবস্থা। বাগানের গাছ টবে যে কষ্ট পাচ্ছে, এটা তিনি অনুভব করছেন প্রতিনিয়ত। তিনি গাছের মাথায় হাত বুলান। শব্দ করে বলেন- ‘বাবা, মন খারাপ কোরো না। তোমাকে জায়গা মতো পাঠাব।’ পরম যত্নে শিশুগাছটাকে নিয়ে গেলেন তার গ্রামে। বাগানবাড়িতে খোলা জায়গায় গাছটা লাগিয়ে তবেই প্রশান্তি পেলেন। সেই গাছটা এখন ডালপালা ছড়িয়ে যুবক হয়ে গেছে। শিমুলগাছ তার খুব পছন্দ। একটা শিমুলগাছের মালিক হওয়ার খুব লোভ বলে জানালেন।
পরিবার
সবার ধারণা হতে পারে, এত দায়িত্বশীল কনকচাঁপা পরিবারে কেমন ভূমিকা পালন করেন? পরিবার নিয়ে তাকে আসলে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। পরিবার শামলাতে হয় না। তিনি পরিবারে একটা শিশুর মতো। ফুল-পাখি, লতাপাতা আর নাতনি নিয়ে খেলেন। মেয়ে-জামাই, মেহমান নিয়ে সময় কাটান। গান নিয়ে মেতে থাকেন। তার পরিবারের সব কঠিন কাজ করেন স্বামী সুরকার মইনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমাকে কখনো বাচ্চাদের স্কুলে নিতে হয়নি। বাচ্চাদের কোচিং, ডাক্তার, বিয়ে, বাজার, ইনকাম ট্যাক্স, বাসা, জমি এসব কোনোকিছুতেই আমাকে মাথা ঘামাতে হয় না। এমনকি আমার গানে, গলার যত্নও স্বামীর হাতে ছেড়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে থাকতে পারি। এ জন্য আমার দায়িত্বশীল স্বামীর ওপর একটু বেশিই কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে এভাবে সাপোর্ট না দিলে আজকের কনকচাঁপা হওয়া আমার জন্য কষ্টের হতো।’