চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কথাসাহিত্যের দুই নক্ষত্র: সৈয়দ হক ও রাবেয়া খাতুন

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলা সাহিত্যাকাশে একটি উজ্জ্বল দিন। এদিন কুড়িগ্রামে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এবং বিক্রমপুরে কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন জন্মগ্রহণ করেন।

দেশের দু-প্রান্তে জন্মগ্রহণ করেও এই দুই সাহিত্য তারকা বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন এক অন্য মাত্রায়। ২০১৬ সালে জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক। তাদের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদরূপে দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে। দু-জনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দেড়শতাধিক, অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা অর্ধশত পেরিয়েছে। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা অনুষঙ্গ স্থান পেয়েছে তাদের সাহিত্যকর্মে।

সৈয়দ শামসুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকালীন অবস্থায় ১৯৫১ সালে ‘অগত্যা’ ম্যাগাজিনে ‘উদয়াস্ত’ শিরোনামে প্রথম গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৬ সালে রচনা করেন প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’। এছাড়াও তিনি কাব্যনাট্যে নিজস্ব অবস্থান দখল করেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ প্রকাশের মাধ্যমে। তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর শুধু শিল্প-সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা চলচ্চিত্র জগতেও বিস্তৃত। তিনি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, রচনা করেছেন চলচ্চিত্রের গান। পেয়েছেন চলচ্চিত্র পুরস্কারও।

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ হকের ৬২ বছরের বর্ণাঢ্য লেখকজীবনে রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তাস, শীত বিকেল, রক্তগোলাপ, আনন্দের মৃত্যু, প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান, জলেশ্বরীর গল্পগুলো উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। কবিতাগ্রন্থের মধ্যে একদা এক রাজ্যে, বিরতিহীন উৎসব, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভিতর, নিজস্ব বিষয়, রজ্জুপথে চরেছি, বেজান শহরের জন্য কোরাস, এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি, অগ্নি ও জলের কবিতা, আমি জন্মগ্রহণ করিনি, রাজনৈতিক কবিতা, নাভিমূলে ভস্মাধার, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর এবং উপন্যাসের মধ্যে দেয়ালের দেশ, এক মহিলার ছবি, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, স্মৃতিমেধ, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, স্তব্ধতার অনুবাদ, এক যুবকের ছায়াপথ, স্বপ্ন সংক্রান্ত, বনমালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, ত্রাহি, তুমি সেই তরবারী, কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন, নির্বাসিতা, নিষিদ্ধ লোবান, খেলারাম খেলে যা, মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, কালঘর্ম, অন্য এক আলিঙ্গন, উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা, বাংলার মাটি বাংলার জল, নারীগণ তার অমর কাব্যনাট্য। অনুবাদেও রেখেছেন সফলতার স্বাক্ষর। শিশুসাহিত্যও এড়িয়ে যাননি তিনি। লিখলেন সীমান্তের সিংহাসন, আনু বড় হয়, হডসনের বন্দুক।

‘সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম প্রয়াণবর্ষ স্মরণার্ঘ্য’

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কারের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ লেখক হিসেবে মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের পাশাপাশি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত স্বর্ণপদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ্ স্বর্ণপদক, পদাবলী কবিতা পুরস্কার, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন।

একই দিনে জন্মগ্রহণ করা কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন বাংলা কথাসাহিত্যে আরেক বিস্ময়ের নাম্। প্রায় এক হাজার ছোটগল্পের পাশাপাশি পঞ্চাশটির বেশি উপন্যাস রচনা করেছেন এই মহিয়সী কথাসাহিত্যিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। ১৯৬৩ সালে প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব অবস্থানের জানান দেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাহেব বাজার, রাজারবাগ শালিমারবাগ, মন এক শ্বেত কপোতী, ফেরারী সূর্য, নীল নিশীথ, বায়ান্ন গলির একগলি, পাখি সব করে রব, নয়না লেকে রূপবান দুপুর, মিড সামারে, এই ভরা বাদর মাহ ভাদর, হিরণ দাহ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, এই বিরল কাল, হোটেল গ্রীন বাটন, চাঁদের ফোটা, বাগানের নাম মালনিছড়া, বসন্ত ভিলা, ছায়া রমণী, সৌন্দর্য সংবাদ, হৃদয়ের কাছের বিষয়, ঘাতক রাত্রি, মালিনীর দুপুর, রঙিন কাচের জানালা, মেঘের পর মেঘ, যা কিছু অপ্রত্যাশিত, দূরে বৃষ্টি, রমনা পার্কের পাঁচবন্ধু, শুধু তোমার জন্য, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রথম বধ্যভূমি, কমলিকা, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, যা হয়না, আকাশে এখনো অনেক রাত, জাগতিক, স্বপ্নে সংক্রামিত, ও কে ছিল, মহাপ্রলয়ের পর, শহরের শেষ বাড়ি, নষ্ট জ্যোস্নার আলো, এই দাহ এবং রাইমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

গল্প ও উপন্যাস ছাড়াও তিনি ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস এবং স্মৃতিকথাও লিখেছেন। রাবেয়া খাতুন রচিত ভ্রমণকাহিনী বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ও উপন্যাস রচনায় রয়েছে বিশেষ খ্যাতি ও পাণ্ডিত্য।

রাবেয়া খাতুন

রাবেয়া খাতুন সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ সালে একুশে পদক এবং ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের পাশাপাশি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, জসিমউদ্দিন পুরস্কার, শেরে বাংলা স্বর্ণপদক, ঋষিজ সাহিত্য পদক, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার অর্জন করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে ফুঁটে উঠেছে মধ্যবিত্ত জীবন, আঞ্চলিক ভাষা পেয়েছে নতুন মাত্রা। আর রাবেয়া খাতুনের রচনায় ফুটে উঠেছে বিকাশমান নাগরিক আধুনিকতা এবং জীবনসংগ্রামের চিত্র। বাংলা সাহিত্যের দুই নক্ষত্র সৈয়দ শামসুল হক এবং রাবেয়া খাতুন তাদের নিজস্ব সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে অমর ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।