আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি ঢাকায় এসেছে। অফিসে এসে বললো, ‘কাল তোমাদের ঝালকাঠি যাব’। কেন? ‘আমার জ্যাঠার জন্য মাটি আনতে।’ মাটি কেন? ‘আর বোল না, সে তো বহুকাল আগে কলকাতায় চলে গেছে। যাওয়ার সময় সে নিজের বাড়ির কিছু মাটি নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো খুঁজে পাচ্ছে না। এখন আমি বাংলাদেশে আসব শুনে বললো, আমি যেন তার জন্য অবশ্যই তার বাবার ভিটা থেকে একটু মাটি নিয়ে আসি।’
২০১৪ সালের সম্ভবত অক্টোবর মাসে আমাকে বিবিসির লন্ডন অফিস থেকে শাকিল আনোয়ার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার বাড়ি ঝালকাঠিতে না?’ বললাম, জি ভাই। বললেন, ‘ওখানে রামচন্দ্রপুর নামে কোনো গ্রাম আছে নাকি?’ বললাম, জি আছে। ‘তুমি ওখানের কাউকে চেন?’ চিনি। আমার বেশ কিছু আত্মীয়ের বাড়ি সেখানে। এর পরদিন শাকিল ভাই আবার ফোন করে দুজন লোকের নাম দিয়ে বললেন, এনারা আমাদের (বিবিসি) সাবেক স্পোর্টস এডিটর মিহির বোসের পূর্ব পুরুষ। যারা ছেচল্লিশের দেশভাগের সময়ে বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। তাদের বাড়ি ছিল এই রামচন্দ্রপুর গ্রামে। তবে মিহির বোসের জন্ম ভারতে। তিনি স্পোর্টসের লোক হলেও ইতিহাস নিয়ে দারুণ আগ্রহী এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একসময় তার মনে হলো, নিজের বাপ দাদার ভিটেটা একবার দেখা দরকার। তাই তিনি আমার শরণাপন্ন হন এবং তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেন।
একজন প্রবীণ মানুষ তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি খুঁজছেন, সেখানে এখন তাদের উত্তরপুরুষের আদৌ কেউ আছেন কি না, থাকলে তারা কারা এবং মিহির বোসের বাপ দাদাদের সম্পর্কে আদৌ কিছু জানেন কি না এমন সব তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়ে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমার ভেতরে তৈরি হয়। খুব আগ্রহ নিয়ে রামচন্দ্রপুর গ্রামে মিহির বোসের পূর্বপুরষের সন্ধান করি এবং একসময় সত্যি সত্যি পেয়ে যাই। এই তথ্য যখন তাকে মোবাইল ফোনে এবং ইমেইলে জানালাম, তিনি যারপরনাই খুশি। পারলে তখনই লন্ডন থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর দিনক্ষণ ঠিক করে মিহিরদা সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসেন এবং তাদের নিয়ে চলে যাই রামচন্দ্রপুর গ্রামে। বাপদাদার ভিটেতে গিয়ে মিহির বোস যেভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং সেই জরাজীর্ণ বাড়িতে এখন যারা থাকেন, তাদের সাথে মিহির বোসের সরাসরি রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তাদের জড়িয়ে ধরে যেভাবে নিজের আবেগ-উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটান, তার যথোপযুক্ত বর্ণনা দেয়া কঠিন। সম্ভবত এই আবেগের নামই দেশপ্রেম। পরিচিত কেউ একজন জন্মভিটায় যাচ্ছেন জেনে তাকে সেখানকার একটুখানি মাটি নিয়ে আসতে বলার যে আকুলতা, তার নামই বোধ হয় দেশপ্রেম।
দেশ কী জিনিস তা আমরা প্রতিবছর দুই ঈদের সময় দেখতে পাই রাজপথে, রেললাইনে, নদীপথে। দেশের টানে মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত। রাজধানীতে থাকা এই মানুষগুলোর দেশ আসলে তাদের জন্মস্থান। গরিব মানুষেরা পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হলে জিজ্ঞেস করে, আপনের দেশ কোথায়? তিনি জবাব দেন, বাউফল, ভুরুঙ্গামারি, হাইমচর…। এর সবই বাংলাদেশেরই অন্তর্গত। অথচ তাদের কাছে দেশ মানে জন্মস্থান। দেশ মানে যেখানে মা বাবা আত্মীয়-পরিজন থাকেন। দেশ মানে যেখানে পূর্বপুরুষের কবর। দেশ মানে যেখানে পৌঁছানোর জন্য
ঈদের ছুটিতে প্রাণ হাতে নিয়ে বাস ট্রেন লঞ্চের ছাদে উঠে পড়েন বৃদ্ধ, তরুণ, শিশু।
এই সময়ে গণমাধ্যমে খুব কমন শিরোনাম হয়, ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’। অর্থাৎ এই যে নাড়ির টান, সেটির নামই বাড়ি, সেটিই দেশ। দেশের ভেতরে থেকেও মানুষ ওই নাড়ির টানে প্রকৃত দেশে যায়। এখানে দেশ মানে আলাদা ভূখণ্ড নয়। আলাদা মানচিত্র নয়। পাসপোর্ট ভিসা লাগে না। এখানে মা মানেই দেশ। এখানে বাড়ি মানে যেখানে মা থাকেন। যাঁর মা নেই কিন্তু মা ছিলেন; তিনি মায়ের কবরের কাছে যান। কারণ ওটাই তাঁর দেশ। ওখানে যাওয়ার জন্য তাঁর হা হুতাশ, মধ্যরাত থেকে সকাল অব্দি রেলস্টেশনে একটি টিকেটের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা, একটা লঞ্চের কেবিনের জন্য এর কাছে ওর কাছে ধর্ণা দেওয়া; কারণ তিনি বাড়ি যাবেন।
মানুষ বরাবরই শেকড়সন্ধানী। যে কারণে বছরের পর বছর বিদেশে থাকা মানুষও শেষ বয়সে এসে ভাবেন, আহা শেষ সময়টা যদি গ্রামের মানুষের সঙ্গে, সবুজ মাঠ, শান্ত খাল আর দূর থেকে ‘ভাইজান’ বলে ডাক দেওয়া লোকদের সঙ্গে কাটানো যায়- তাহলে কতই না ভালো হয়।
হয়তো ওই মানুষটি নিউইয়র্ক বা লন্ডনের মতো অভিজাত শহরেই বাস করেন দুই যুগ ধরে। হয়তো এখন তিনি সেখানেরই নাগরিক। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর বুকের ভেতরে ঝিলিক দিয়ে ওঠে এক টুকরো গ্রাম। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি হয়তো ভাবেন, সেই শেকড়ে ফিরে যেতে যেখানে তাঁর জন্ম। যেখানে মাটির নিচে তাঁর পূর্বপুরুষ শুয়ে আছেন। যেখানে কবরস্থানে পাতাবাহারের ঘনছায়ায় মায়ের কবরটা ঢাকা পড়ে গেছে। বাবার কবরটা বাধাই করা হয়নি। আগামী ঈদে সময় পেলেই বাড়ি গিয়ে কবরটা বাধাই করার ইচ্ছা আছে। মানুষ বস্তুত সেখানে ফিরতে চায়।
জন্মস্থানের দিকে এই প্রাণপন ছুটে চলার নামই বোধ হয় দেশপ্রেম। যে প্রেমের কারণে শত সহস্র মাইল দূরে বসে যখন সে জন্মভূমির একটু মাটি হাতে পায়, তখন মনে হয় সেই ঘ্রাণ পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ সুগন্ধী। তার হয়তো মনে হয়, এই মাটিটুকুই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বস্তুত দেশে থেকে দেশের প্রতি মমত্ববোধ সেভাবে তৈরি হয় না বা ততটা অনুভব করা যায় না, যেরকমটি অনুভব করতে পারেন কলকাতার সেই জ্যাঠামশাই কিংবা লন্ডনের মিহির বোস। তারা একটি ভিন্ন দেশে, ভিন্ন শহরে বসবাস করলেও প্রত্যেকের বুকের ভেতরে বাস করে আরেকটি দেশ; যেটিই মূলত তার নিজের দেশ। যেখানে ছুটে যাওয়ার জন্য সব সময় তার ভেতরে একধরনের আকুলতা কাজ করে। এই আকুলতার নামই বোধ হয় দেশপ্রেম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)