হাওরে অকাল বন্যায় ক্ষেতের ফসল ও সহায়-সম্বল হারিয়ে বিপন্ন হাওরবাসীর কান্না না থামতেই ঘটে গেল পাহাড় ধসের ট্র্যাজেডি। পাহাড় ধসে বিপুল মানুষেরই কেবল মৃত্যু হয়নি, বরং রাস্তাঘাট, বসতি, সহায়-সম্বল সবকিছু হারিয়ে অনেক মানুষ ভয়াবহ দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি।
অপরিণামদর্শী নানা উদ্যোগ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই মানুষদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। সারাদেশের মানুষ যে মুহূর্তে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে সে মুহূর্তে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় বিভোর। ঈদ তাদের জীবনে খুশির বার্তা বহন না করে বাড়তি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চারদিকে ঈদের আনন্দ চললেও এসব পরিবারে চলছে কষ্ট আর নীরব হাহাকার। ঈদে ভালো খাবার তো দুরের কথা, ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক কিনে দেয়ার মতো অবস্থা নেই অনেকের। চরম অভাব-অনটন নিয়ে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তাদের ঈদের আনন্দ।
এমন পরিস্থিতি খুবই বেদনাদায়ক। এ মুহূর্তে হাওরের প্রায় এক কোটি মানুষ আর পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী প্রায় দশ লক্ষ মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা ও ভরসা যোগানোটা সবচেয়ে বড় মানবিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে অনেকে উদ্যোগী হয়েছেন। নিজেদের মতো ত্রাণ ও অন্যান্য সহযোগিতা দিতে ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়, এগুলো আরও ব্যাপক বিস্তৃত হওয়া দরকার। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যাগে মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার ঘটনা অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি। দেখেছি, ‘সিডর’ ‘আইলা’ প্রভৃতি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক আবেগের এই প্রাচুর্য সভ্য-জাতির গর্ব এনেছিল আমাদের মনে।
আমরা ছাত্র-জীবনে আত্মস্থ করেছি একটি কবিতা, যার সারমর্ম বলছে- বিন্দু বিন্দু জলকণা দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে সাগর-মহাসাগর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণার সমষ্টিতেই গড়ে ওঠে দেশ, মহাদেশ। ক্ষুদ্রের সমন্বয়ের এই উদাহরণটিতে মহত্ত্বের প্রেরণাটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। দুর্যোগকবলিত বা দুস্থ মানবতার সহায়তার জন্য প্রসারিত একটি একটি করে এগিয়ে আসা হাতও হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত শক্তি, যে শক্তি দিয়ে জয় করা যায় দুর্যোগের তাণ্ডব, রক্ষা করা যায় পৃথিবীর অসহায় বিপন্ন মানবতাকে। আমরা যদি আমাদের আয় থেকে বাঁচিয়ে, একটু সংযম করে সামান্য কিছু টাকা দুর্গত মানুষের জন্য ব্যয় করি তাহলে একটি শিশু পেতে পারে এক বেলার আহার। এক দিনের খরচের সামান্য একটু অংশ একটি শিশুর জীবন বাঁচতে পারে।
অতীতে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় হলে সমগ্র বাংলাদেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতো। যে যেমন পারে, যে যেখানে যে অবস্থায় আছে সেখান থেকেই সাহায্য করার চেষ্টা করতো। আফসোসের বিষয়, এখন বুকে হারমোনিয়াম বেঁধে তরুণেরা পথে পথে গান গেয়ে বলে না ‘ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী।’ এখন জনসভায় কেউ বলে না- আসুন দুর্গত মানুষের জন্য হাত বাড়াই। বিপন্ন শিশুদের বাঁচাই।
হাওরবাসীদের ওয়াইফাই নেই, ফেসবুক নেই, ল্যাপটপ নেই, আইফোন নেই, চুল ফাঁপানোর সেলুন নেই, ভাত নেই, কাপড় নেই, থাকার জায়গা নেই, সামনে বাঁচার কোনো উপায় নেই। সবাই ছুটে আসছে শহরের দিকে। কিন্তু শহরের মানুষগুলো অন্য রকম। এখানে অনেকেরই গাড়ি আছে। অট্টালিকার মতো বাড়ি আছে। গাড়িতে গাড়িতে ভর্তি পথঘাট। ধোঁয়া আর ময়লা রাশি রাশি।শহরের পরিবেশ ঠিক শহরের মানুষের মনের মতো। কুৎসিত কদাকার। এমন ছিল না আগে। এমন করেছে সবাই মিলে। বাঁচার আশায় হাওরবাসীরা ছুটে আসছে সেই কুৎসিত কদাকার শহরে।
হাওরবাসীদের জন্য শহরের মানুষের সময় নেই। তাদের আসলে কারো জন্য সময় নেই। শহরের মানুষেরা ছুটছে আর ছুটছে। সবাই টাকা বানাতে চায়। গাড়ি, বাড়ি, সুন্দর পোশাক, ফাঁপানো চুলের মেয়েদের হাত ধরে হাঁটতে চায়। এক অলীক সুখের সাগরে ডুবতে চায়!
বিল্ডিং ভেঙ্গে যাচ্ছে, ব্রিজ ভেঙ্গে যাচ্ছে, রাস্তা ভেঙ্গে যাচ্ছে, নর্দমাতে ময়লা আটকে বৃষ্টির পানি নোংরার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার নদী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কারোর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই ছুটছে কাগজের টাকা ছিনিয়ে এনে সুখে কিনে বিশাল ভুঁড়ি বানাবার আয়োজনে। এই ‘কেবল ছুটে চলা’ মানুষদের মধ্যে মানবতাবোধের উন্মেষটা আজ বড় বেশি প্রয়োজন!
মানুষ এখন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। বহু মানুষের মন থেকে মহত্ত্ব, মনুষ্যত্ব মহানুভবতা, মানবিকতার ‘ম’গুলো দিনে দিনে মুছে যাচ্ছে। অথচ অপরের সুখ-দুঃখ অনুভব করাই তো মানুষের মানবীয় গুণাবলি। কিন্তু প্রকৃত সত্য বর্তমানে আমাদের সমাজে আমরা লক্ষ করছি ব্যক্তি তার বিবেক, মানবিক চেতনা, বিচার-বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থের বেড়াজালে বন্দী। চোখের সামনেই ঘটে যাওয়া অনেক মর্মান্তিক ঘটনায় মানুষ চোখ বুজে মুখ ফিরিয়ে পাশ কেটে চলে যায়। এখন প্রতিবেশীর অভাব-অনটন দুঃখ-কষ্ট প্রতিবেশীকে সেভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে না। মানুষের মন এখন অনুভূতিহীন যেন পাথর হয়ে গেছে। সেটা কারও দুঃখে খুব বেশি একটা বিগলিত হয় না।
কিন্তু না, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে দীনতার মাঝে কষ্ট করে হলেও মানবতার মোমবাতিটি জ্বালিয়ে রাখতে হবে। মানবধর্মকে পারাজিত হতে দেওয়া যাবে না। মানুষের দুঃখে মানুষের মন যদি না কাঁদে যদি কোনো সমবেদনা না জাগে তাহলে তাকে মানুষ বলা যায় না। আর এটা গোটা মানব সমাজের জন্যই অবমাননাকর।
আমরা মানবসেবার মাধ্যমেই মানবপ্রেমের মহিমা দেখতে পাই। তবুও যখন দেখি কিছু মানুষ শীতার্ত-বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটাই মানবতার বিজয়। স্বামী বিবেকানন্দ মানব সেবার মহিমা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ তাই মানবসেবায় আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। যদি তা না করি সেটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ।
মনে রাখতে হবে, মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য। মানুষের বিপদের সময় তার পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে; একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
আমাদের সবারই সুযোগ রয়েছে মানবসেবায় নিয়োজিত করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। আমি, আপনিসহ এগিয়ে আসতে পারি সবাই। দাঁড়াতে পারি মানুষের পাশে। মানুষের মতো মানুষ হতে আসুন, আমরা দুর্গতদের পাশে এসে একটু সাহায্যের হাত প্রসারিত করি।
আমাদের ঈদ হবে নানা আয়োজনে, আর ওদের দিনটা কাটবে বিষণ্ণতায়। আমরা কী পারি না ওদেরকে নিয়ে ভাবতে? আনন্দময় একটি ঈদ উপহার দিতে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)