চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ওটা পতাকা বৈঠক ছিল না

ভারতীয় মিডিয়া দাবি করছে, পদ্মাপাড়ে পতাকা বৈঠকে গুলি বর্ষণের ঘটনায় বিএসএফের কনস্টেবল বিজয়ভান সিং নিহত হয়েছেন। এমনকি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ও টুইটারেও একই দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়া বলছে, বিএসএফ সদস্যরা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করেন। এটা পতাকা বৈঠক ছিল না।

পতাকা বৈঠকের ধারণাটা উপমহাদেশে বেশ জনপ্রিয়। ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ছাড়া পৃথিবীর কোথাও পতাকা বৈঠকের উল্লেখযোগ্য নজির নেই। ইন্টারনেটে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যও নেই। পৃথিবীর জটিল জটিল সব সীমান্তেও এমন উদ্যোগ দেখা যায় না। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৯৭৫ সালে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফের সাথে চুক্তি সই করে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস। সেই চুক্তির ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, সীমান্তে কোনো সংকট দেখা দিলে আঞ্চলিক পর্যায়ের কমান্ডাররা টেলিফোনে আলাপ করবেন। ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ বলছে, টেলিফোনের সংযোগ না থাকলে নির্ধারত রং ও আকারের পতাকা নাড়িয়ে এক পক্ষের কমান্ডার অন্য পক্ষকে বৈঠকের আহ্বান জানাবেন। পতাকা বৈঠকে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিরস্ত্র ও দেহরক্ষী ছাড়া থাকবেন বলেও চুক্তিতে স্পষ্ট করা আছে। বিধি মোতাবেক পতাকা বৈঠক হলেতো কারো কাছেই অস্ত্র থাকার কথা না। তাহলে গোলাগুলি হলো কিভাবে?

এছাড়া বিএসএফ জওয়ানরা ইউনিফর্মে ছিলেন না। তারা কি আসলেই বিএসএফের সদস্য? নাকি অন্য কেউ? বিএসএফ হলে তারা কি কর্তপক্ষকে জানিয়ে বিনা পোশাকে বাংলাদেশ সীমানায় অনুপ্রেবেশ করেছিল কিনা, সেটাও পরিষ্কার নয়। খোদ বিএসএফের সব কর্মকর্তা ও জওয়ানরাও স্বীকার করবেন যে, পতাকা বৈঠকে কোনো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের পোশাকে অংশ নেন না। এটা পতাকা বৈঠকের রীতিবিরুদ্ধ।

প্রমত্তা পদ্মায় স্রোতের অনুকূল-প্রতিকূল হিসেব করতেই হিমশিম খেতে হয় দ্রুতগতির স্পিডবোটকে। ভারতীয় মিডিয়ার দাবি, স্পিডবোটে করে ফেরার সময় ‘কাপুরুষের মতো’ পেছন থেকে গুলি করেছে বিজিবি, তাও আবার হেড-শট! প্রশ্ন হচ্ছে, স্রোতজ পদ্মায় এমন গতিময় একটি বোটে নিশানা ঠিক রেখে গুলি করা কি বাস্তবসম্মত? এটা হিন্দি সিরিয়ালের মতো ফিল্মি হয়ে যাচ্ছে না! এমনওতো হতে পারে, নিরাপদে পালানোর সময় নিজেদের গুলিতেই মারা গেছেন বিএসএফ জওয়ান বিজয়ভান সিংহ। আর তিনি যে সত্যিই মারা গেছেন, এই তথ্য-প্রমাণ এখনও পায়নি কোনো মিডিয়া। তার মরদেহ বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবি দেখায়নি কেউ।

ইলিশ রক্ষায় অভিযানটি পরিচালনা করছিলেন চারঘাটের মৎস্য কর্মকর্তা। সীমান্ত এলাকা বলেই অভিযানে অংশ নিয়েছিল বিজিবি। স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলাদেশি মিডিয়ায় সাক্ষাতকারে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন করে বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশে আসেন। আটক জেলেকে ছাড়িয়ে নিতে মৎস্য কর্মকর্তাসহ বিজিবি সদস্যদের হুমকি-ধামকি দেন। স্পটেতো ভারতীয় সাংবাদিকরা ছিলেন না। তাহলে ভারতীয় মিডিয়া এটা কিভাবে বলে যে, বিজিবি আগে গুলি ছুঁড়েছে?

আসলে উগ্র জাতীয়তাবাদী মোহ ভারতীয় মিডিয়াকে অন্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতী রায় যথার্থই বলেছিলেন, Nationalism of one kind or another was the cause of most of the genocide of the twentieth century. Flags are bits of colored cloth that governments use first to shrink-wrap people’s minds and then as ceremonial shrouds to bury the dead.

টেলিভিশনের ডেইলি সোপের আজগুবি স্ক্রিপ্ট যে জার্নালিজমে চলে না, এটা জানার পরও ভারতীয় মিডিয়ার এই ফিকশন রিপোর্টিং দেশটির মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)