সবে ঘুম ভেঙেছে। বাসের জানালায় লাল আলোর ঝলকানি। পাশেই বয়ে চলছে হাওরের স্নিগ্ধ জলরাশি। বাসের গতি বাড়ে কিন্তু হাওরের সীমনা যেন আর কমে না! তখন হাওরের বুকেও দেখা যায় এক টুকরো লাল বাংলাদেশ। বাতাসে সাথে জলের মৃদু স্রোত দেখলে যে কেউ বলবে সূর্যমামা দোল খাচ্ছে। সকালের সূর্য এতোটা মনোরোম এর আগে কেউ দেখেছে কিনা জানা নেই।
যতই বেলা যায় সূর্য ততই প্রখর হয়। তাপ বাড়ার সাথে হাওর আর আকাশের সম্পর্কও বৃদ্ধি পায়। মনে হয় সকল সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে এই হাওরে। যেখানে আকাশ বৈচিত্র রং ধারণ করে ক্ষণে ক্ষণে। এক টুকরো সাদা মেঘ আর নীল আকাশ যখন হাওরের পানিতে ভেসে উঠে তখন মনে হয় পুরো পৃথিবীই সাদা আর নীল। প্রকৃতির এমন উজার করা সৌন্দর্য যেন শেষ হয় না। নীল জল, নীল আকাশ আর পাশে পাহাড়। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। যে আমাদের চোখে আজও ছবির মতো ভাসে। বলছিলাম, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার কথা। নামের ভিতরেই যে জেলার সুনাম লুকায়িত, সেখানে প্রকৃতি তো নতুন রূপে সাজবেই।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়েছে হাতে গোনা কয়েকদিন। এরমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র (রাবিসাস) আয়োজনে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের লীলাভূমিতে। উপরে নীল আকাশ আর নিচে নীল জলের ওপর ট্রলারে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো নীলাদ্রি লেক, লাকমাছড়া ঝরনা, যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা আর শিমুল বাগান ভ্রমণ। শুরু থেকেই ভ্রমণ পিয়াসী মন আর নেশাতুর চোখে তাক লেগে যায়। স্বচ্ছ পানি আর নীল আকাশে যে কেউ হারিয়ে যাবে। যতদূর চোখ যাবে শুধু নীল জলরাশি আর মেঘালয় পাহাড়। মনে হবে পৃথিবী তো ওই পাহাড়েই শেষ। হয়তো আর একটু গেলেই পৃথিবীর অন্ত পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহতম এই জলাভূমি। যেখানে সুনামগঞ্জ জেলার একান্নটি বিল এই হাওর সৃষ্টি করেছে। এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে যোগ দিয়েছে মেঘালয় পাহাড় থেকে বেশ কিছু ঝরনা। সকল কৌতুহল কাটিয়ে আমাদের ট্রলার সবে নীলাদ্রি নোঙর ফেলেছে। সেখানে সারি সারি ট্রলার ঘাটে বাধা। সবাই ছুটছে লেক আর মেঘালয় পাহাড়ের দিকে। নীলাদ্রি লেক খ্যাত পর্যটন কেন্দ্রটি চুনাপাথরের পরিত্যাক্ত খনির লাইম স্টোন লেক। তাহিরপুর উপজেলার ট্যাকেরঘাট গ্রামে যার অবস্থান। এই লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। তবে এটা পর্যটকদের কাছে নীলাদ্রি লেক নামে বেশি পরিচিত। লেকের নীল জল, ছোট-বড় টিলা, চুনাপাথর আর পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট উদ্ভিদ নজর কারে সবার। লেক থেকে বাম পাশে একটু এগুলেই লাকমাছড়া ঝরনা। পর্বতমালার ভাঁজে ভাঁজে সবুজের আস্তর। আর সেই সবুজ পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে এসেছে সরু ঝরনা। শীতল স্বচ্ছ জলরাশি নিজ সুরে কলকল করছে। ছড়ার চুনাপাথরের বুকজুড়ে ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে পরখ করছে অনেকে। এ যেন পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য।
দিন শেষে সন্ধ্যার সময় প্রত্যেক ট্রলার থেকে ভেসে আসে গলা ছেড়ে গাওয়া গানের কথা। সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর ব্যস্ততা শেষে সবাই ট্রলারে উঠে। রাত সেখানেই অতিবাহিত করে। এ যেনো এক অন্য অভিঙ্গতা। খোলা আকাশের নিচে জলের ওপর ভেসে থেকে চাঁদ আর তারার গল্প অবলোকন করা। রাতের চাঁদ হাওরের নীল জলে আরো বেশি উজ্জ্বল মনে হবে।
হাওরে সকালের সূর্য নিয়ে বলতে গেলে শেষ হবে না। আবার একটা দিনের শুরু। ভোরের সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে আমাদের ট্রলার। গন্তব্য যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান আর বারিক্কা টিলা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় থেকে উৎপত্তি যাদুকাটা নদীর। যাদুকাটা নদীর আগের নাম রেণুকা। রূপের নদী, সম্পদের নদী, শ্রম ও সমৃদ্ধির নদী নামে ডাকা হয় যাদুকাটা নদীকে। বৈচিত্রময় ও মনোহর রূপের কারণে পাহাড়ি যাদুকাটাকে দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত নদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ নদী থেকে উত্তোলন করা হয় বালু, পাথর ও কয়লা। চারদিকে খালি বালু আর বালু উত্তোলনের নৌকা। ব্যস্তময় কর্মজীবন। বৈচিত্রময় এখনকার জনজীবন। ঠান্ডা জল আর বালুময় স্বর্গ যেনো যাদুকাটা নাম রাখার অন্যতম কারণ। স্থানীয় লোকজনের অন্যতম একটা কর্মসংস্থানের যোগান দিয়েছে এই নদী। যাদুকাটা নদীর দুই পাশেই অবস্থান শিমুল বাগান আর বারিক্কা টিলার।
যাদুকাটা নদীর পাড় ঘেষে ১০০ বিঘারও বেশি জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের বড় শিমুল বাগান। ২০০২ সালে তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁও গ্রামে গড়ে উঠে। জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি প্রায় তিন হাজার শিমুলের চারা রোপন করেন। তবে বর্ষার সময় সবুজ পাতা আর সারি সারি গাছ প্রশান্তি এনে দেয় পথিকের মনে। তবে বসন্তের সময় লাল ফুল স্বর্গীয় সৌন্দর্য দান করে। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, বারিক্কা টিলা, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপাড়ে শিমুল বন। সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য।