গত সপ্তাহের শেষের দিকে সারাদেশের মানুষ একটি খবর অবাক দৃষ্টি নিয়ে বারবার অনলাইন, টেলিভিশন আর সংবাদপত্রে চোখ রাখতে রাখতে জানলেন। হাইকোর্ট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং একজন রিকশা চালক আবদুস সালামের ত্রিমাত্রিক ভূমিকায় প্রায় ৩০ বছর পর সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলাটিকে গভীর অন্ধকার থেকে সত্যের আলোতে বের হতে দেখলেন। এ যেন এক রহস্যগল্পের সফল সমাপ্তি।
পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের এত এত বছর পর তাতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে দেয়া চার ব্যক্তির জবানবন্দী অবশেষে চাঞ্চল্যকর এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করে দিলো। ঘটনাটি তিন দশক আগের, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। সেদিন সগিরা মোর্শেদ সালাম রিকশা করে ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে তার মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে পৌঁছামাত্র মোটরসাইকেলে থাকা দুই যুবক সগিরা মোর্শেদ সালামমের হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ও হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তিনি বাধা দেন এবং একটি নাম বলে বলেন, ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, এখানে কেন তুমি?’
এরপরই মোটরসাইকেলে থাকা এক যুবক সগিরা মোর্শেদকে লক্ষ্য করে পর পর দুটি গুলি করেন। একটি গুলি সগিরার ডান হাতে লাগে এবং আরেকটি তার বাম বুকে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। তখন আশেপাশে লোকজন জড়ো হতে শুরু করলে ফাঁকা গুলি করতে করতে মোটরসাইকেলে আসা সেই দুই যুবক পালিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় সগিরাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার দিনই অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন নিহতের স্বামী সালাম চৌধুরী। এ মামলার তদন্তকালে মিন্টু ওরফে মন্টু এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেপ্তার হন। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়ে পরবর্তীতে চার্জশিট দেওয়া হয়। এবং সাক্ষ্যে মারুফ রেজার নাম আসায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। কিন্তু অধিকতর তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা। সে রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। সেই সঙ্গে তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এরপর আবার ১৯৯২ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আদেশ দেন। এরপরই প্রকারন্তে থেমে যায় এ মামলার সব ধরণের তদন্ত কাজ।
তবে মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। পরবর্তিতে বিষয়টি আবার হাইকোর্টে তোলা হয়। এবং গত ২৬ জুন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে জারি করা আগের রুলটি খারিজ করে রায় দেন। সেই সাথে হাইকোর্ট তার রায়ে এ মামলাটির অধিকতর তদন্ত ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। এবং তদন্ত শেষে ৯০ দিনের মধ্যে মামলাটির বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘২৮ বছর পর আবার এ মামলার অধিকতর তদন্ত হলে এবং এরপর রায় হলে কি হবে তা কেবলই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন। ২৮টা বছরে এ মামলার ভিকটিমকে আমারা কি দিতে পারলাম? সামগ্রিকভাবে এটা আমাদের ব্যর্থতা।’ তবে ওইদিন হাইকোর্ট এ মামলার অধিকতর তদন্তের ফলাফলের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী না হলেও প্রকারন্তে হাইকোর্টের ওইদিনের রায়ের ফলেই আঠাশ বছর ধরে ফাইলবন্দি থাকা হত্যা মামলাটি নতুন করে প্রাণ পায়।
এরপরই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে মামলাটি পিবিআইয়ের হাতে আসে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় অধিকতর তদন্ত গুরুত্বের সাথে শুরু করা হয়। তবে পিবিআইয়ের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ৩০ বছর আগের প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিকসা চালক আবদুস সালামকে খুঁজে বের করা। বর্তমান ঠিকানা এবং কোনো যোগাযোগসূত্র না থাকার পরেও সে সময়কার অনেক রিক্সাচালক ও ঘটনাস্থলের আশেপাশের দোকানিদের সাথে কথা বলে এক পর্যায় আবদুস সালামকে খুঁজে বের করে পিবিআই। আবদুস সালাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই ব্যক্তির শারীরিক বর্ণনা দেন এবং রিকশায় থাকা অবস্থায় সগিরা মোর্শের বলা কথার বিষয়টি জানান। রিকশা চালক আবদুস সালামের দেয়া তথ্যগত সহযোগিতা এই মামলার অধিকতর তদন্তে গুরুতপূরর্ণ ভূমিকা রাখে।
পারিবারিক কলহের জেরে যে এই হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়েছে; সে বিষয়টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত দু’জনের শারীরিক বর্ণনা ও বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্যে পিবিআইয়ের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। পিবিআই তদন্তে উঠে আসে, ঢাকার রাজারবাগে পৈত্রিক বাড়ির নীচতলায় সালাম চৌধুরীর বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর থাকতেন। আর দোতলায় থাকতেন সগিরা-সালাম চৌধুরী দম্পতি এবং তাদের তিন মেয়ে। আর সালাম চৌধুরীর মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার স্ত্রী-সন্তানসহ লিবিয়ায় থেকে ১৯৮৫ সালে দেশে ফেরার পর কিছুদিন নীচ তলায় থাকেন। এরপর তারা দ্বিতীয় তলায় সালাম দম্পতির বাসার একটি রুমে থাকেন। তখন থেকেই ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী শাহিনের সঙ্গে সগিরার বিভিন্ন বিষয়ে কলহ শুরু হয়।
একপর্যায়ে ওই বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান তার পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় ওঠেন। এরপর বিভিন্ন সময় তৃতীয় তলা থেকে আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে শাহিনের সঙ্গে সগিরার (দুই জা’য়ের) দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে সগিরা মোর্শেদকে ‘শায়েস্তা’ করতে হত্যার পরিকল্পনা করেন হাসান আলী চৌধুরীর ও তার স্ত্রী শাহিন। এরপর ২৫ হাজার টাকায় মারুফ রেজার সঙ্গে চুক্তি করেন বলে জানায় পিবিআই। পরবর্তিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই দুপুরে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন এবং মারুফ রেজার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। রেজওয়ানের সঙ্গে মোটর সাইকেল করে মারুফ রেজা সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের কাছে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর ওইপথে সগিরাকে রিকশায় করে আসতে দেখে তারা কিছুদূর অনুসরণ করার পর সগিরার রিকশার পথ আটকান এবং সগিরা মোর্শেদের হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ও হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় সগিরা মোর্শেদ বাধা দেন এবং বলেন, ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি রেজওয়ান, এখানে কেন তুমি?’ এরপরই সগিরা মোর্শেদকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর রেজওয়ানকে (ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক) গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। এরপর ১২ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে। আর ১৩ নভেম্বর গ্রেফতার হন মারুফ রেজা। এরপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন তারা। পরে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
দীর্ঘ ৩০ বছর অন্ধকারে থাকা মামলাটির তদন্তে দৃষ্টান্তমূলক সফলতার জন্য পিবিআই তথা এ মামলার অধিকতর তদন্তের কাজে থাকা কর্মকর্তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সেই সাথে রিকশাচালক আবদুস সালামের সহযোগিতায় যে এ হত্যার রহস্য উন্মোচনের অনন্য ভূমিকা রেখেছে, তা অনস্বীকার্য। আর এত বছর পর হাইকোর্ট তার রায়ের মাধ্যমে এই মামলার বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়, যা কিনা এই মামলায় ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে। প্রত্যাশা করি আদালতের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে এ হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে।
এই মামলাটি আরেকভাবে মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে; তাহলো অপরাধ করে সহজে পার পাওয়া যায় না। দেরিতে হলেও একদিন না একদিন তা প্রকাশ্যে আসেই। আর সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদেরকেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)