বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে ডিসেম্বরের মামলাটির অভিযোগপত্র দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
রোববার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে হলি আর্টিজান হামলা মামলার তদন্ত ও ব্লগার, প্রকাশক হত্যার মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়েও কথা বলেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র এ মাসেই দাখিলের চেষ্টা করবো। গত বছর হলি আর্টিজানে নৃশংস হামলা মামলার তদন্ত অনেক আগেই শেষ পর্যােয়ে পৌঁছে গেলেও কিছু আসামী নিয়ে কনফিউশন ছিল। যেমন- বাশারুজ্জামান চকলেট, ছোট মিজান। এরা মামলার আসামী হলেও পলাতক ছিল। চাপাইনবাবগঞ্জে কিছুদিন আগে অপারেশনে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছিলাম ওখানে নিহতদের চেহারার সঙ্গে চকলেট ও ছোট মিজানের মিল রয়েছে। পরে ডিএনএ প্রোফাইলেও সেটা মিলে গেছে। তারা নিহত হয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে।
‘আগে যেসব আসামী শনাক্ত করেছিলাম তার মধ্যে বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে। কেউ কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। একজন আসামী আগের হিসেব মতে পালিয়ে আছে। সেই আসামী হলেন হাদিসুর রহমান সাগর। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
হলি আর্টিজান হামলা মামলা তদন্তে আরো কিছু নাম পাওয়া গিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অর্থ দেবার ক্ষেত্রে আকরাম হোসেন নামের একটি নাম এসেছে যাকে খোঁজা হচ্ছে। ১৫ অগাষ্টে পান্থপথে হোটেল ওলিওতে হামলারও সেই অর্থ জোগানদাতা ও নির্দেশনাও সেই দিয়েছে।”
তাছাড়া প্রাথমিক পর্যািয়ে হলি আর্টিজান হামলার আগে এমন একটি বড় হামলা করতে একটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত রিপন ও ঢালি নামের দুইজনের নামও তদন্তে এসেছে। তাদের বড় ভুমিকা না থাকলেও তারা ইন্ডিয়ান পার্টে পলাতক থেকে এদের অনুপ্রেরনা দিয়েছে। এগুলো মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।
“এদের গ্রেপ্তার করতে পারলে জবানবন্দি নেয়া্ সম্ভব হবে, গ্রেপ্তার না করতে পারলেও এই মাসেই অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য চেষ্টা করবো।”বলে জানিয়েছেন মনিরুল ইসলাম।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ঘটনায় এরইমধ্যে অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রাজিব গান্ধী, রাশেদ গ্রেফতার হয়েছে, রিগ্যান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পাঁচজনকে জীবিত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। মামলার গুরুত্বপূর্ন আসামী সোহেল মাহমুফকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও সাক্ষি হিসেবে তানভির কাদেরীর ছেলে ও স্ত্রী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে।
যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে বাশারুজ্জামান চকলেট, তামিম চৌধুরী, ছোট মিজানসহ বেশ কয়েকজন ও ঘটনাস্থলে থাকা পাঁচজনও এই মামলার আসামী। যেহেতু তারা মারা গেছেন তাদের নাম অভিযোগপত্রে উল্লেখ না থাকলেও ঘটনার সঙ্গে তাদের দায় দায়িত্ব দেখিয়ে তাদের চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এই ঘটনার মোটিভ কী এবং পেছনে কারা ছিল জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই ঘটনার পেছনে মূল মাষ্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। তার সহযোগি ছিলেন সারোয়ার জাহান, পলাতক মেজর জাহিদ। এরা মূলত আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। বড় হামলা করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেন আইএস তাদের নেয়। তবে সেগুলো আইএস ডাইরেক্টেড অপারেশন নয়। তদন্তে এমন কিছু নেই যে ঘটনাটি নিয়ে আইএসের সঙ্গে আলাপ করেছে বা আইএস জানতো। ঘটনার সঙ্গে আইএসের কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
মনিরুল আরও জানান, এই ধরনের ঘটনার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। বিদেশীদের হত্যা করা হয়েছে যেন ফরেন ইনভেষ্টমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ সরকার যেন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষ যেন প্রচণ্ডভাবে সরকারের থেকে আস্থা হারায়, সন্ত্রাস দমন করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এমন বার্তা দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবে।”
‘তারা ভেবেছিল এমন আরো দুই একটা হামলা করলে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবেন এবং তাদের অনুকূলের একটা সরকার আসবে। এই সরকারকে হটাতে পারলে তাদের সেভেন্টি পারসেন্ট বিজয় হতো। পরে ২০০৪-০৫ সালের মতো জঙ্গি কার্য্ক্রম চালাতে পারবে এমন সরকার ক্ষমতায় আসতো। এই ধারনা থেকেই তারা এই কাজটি করেছে।’ বলেন তিনি।
মনিরুল ইসলাম বলেন, এই সরকারের যারা রাজনৈতিকভাবে হটাতে চায় তারা তো এদের ন্যাচারাল এ্যালাই। তারা এই কাজটি করতে পারলে তারাও লাভবান হবে। এজন্য তাদের মৌন সমর্থনও ছিল। এজন্য আমরা তদন্তে দেখেছি ঘটনার পর অনেকে বিবৃতি দিয়ে বলেছে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সেই রকম একটা দৃষ্টাতো তো দেখতেই পেয়েছি। যেমন আমরা দেখেছি নব্য জেএমবি ঘটনাটি ঘটিয়েছে।নব্য জেএমবির যারা ধরা পড়েছে এদের প্রায় সকলেই ইসলামী জামায়াত ইসলাম ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেখানে তারা সংগঠনের ইচ্ছাতেই গিয়েছে নাকি সম্পর্ক ছিন্ন ছিন্ন করেছে এক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা এসেই যায়। হলি আর্টিজানের মূল পরিকল্পনাকারীদের জীবিত গ্রেপ্তার করা গেলে সরাসরি সংযোগের বিষয়টি সাক্ষ্য প্রমাণ দিযেই দেখতে পারবো।
যারা অর্থদাতা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, এখন আকরাম হোসেনের নাম এসেছে যিনি সরাসরি নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত, তানভীর কাদেরী সেই অর্থ দিয়েছে। তার সমস্ত সঞ্চয় সংগঠনে দিয়েছে। সংগঠনের কথিত ভ্রান্ত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই এটা দিয়েছে। যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে সংগঠনের যোগ দিয়েছে। আকরাম হোসেনের মতো ভদ্রবেশী যারা তারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তারা আদর্শিকভাবে জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে। তারাও এক্ষত্রে যুক্ত হয়েছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। জঙ্গিরা ওই রাতে ২০ জনকে হত্যা করে, যাদের নয়জন ইটালির নাগরিক, সাতজন জাপানি, তিনজন বাংলাদেশি এবং একজন ভারতীয়। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়।