সাম্প্রতিক সময়ে অথনৈতিক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এশিয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগামী কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলের অথনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার এই অংশ প্রধান ঝোঁক হিসেবে কাজ করবে। শুধু এশিয়াতেই নয়, বাকি বিশ্বেও তা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
২০০৫ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা(ওইসিডি)যাদের দৈনিক আয়-ব্যয় ১০-১০০ ডলারের মধ্যে তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আওতাভুক্ত করে। তাদের মতে ২০০৯ সালে বিশ্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা ছিল ১.৮ বিলিয়ন। সংস্থাটি বলছে, ২০৩০ সালে এই সংখ্যা হবে ৪.৯ বিলিয়ন। যা ০৯-এর চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। এর তিনভাগের দুই ভাগই হবে এশিয়াতে এবং সিংহভাগ থাকবে চীনের। চীন যদি অথর্নীতির দ্রুত বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি ও কাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারে তাহলে তাদের মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে এক বিলিয়ন। যেটা ২০০৯ সালে ছিল ১৫৭ মিলিয়ন।
এশিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত উত্থান অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে বহুদূর প্রসারিত করবে। কোম্পানিগুলোর জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বাজার খুলে যাবে। এরই মধ্যে এশিয়াতে চাহিদার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অটোমোবাইল ও মোবাইল ফোন মার্কেটে চীন সবচেয়ে বড় বাজার হয়ে গেছে। বিলাসবহুল এবং প্রযুক্তিগত পণ্য ক্রয়ের আরো শক্ত ভিত্তির প্রয়োজেন আছে। ক্রয় ক্ষমতার দিক দিয়ে উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো পিছিয়ে থাকলেও দিন দিন সেটা বাড়ছে।
এশিয়ার অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ চাহিদা, বিশেষ করে পরিবারের খরচ এবং বাইরের উপর কম নির্ভরতা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় রপ্তানি চাহিদা কমে গেলেও তা খুব একটা সমস্যার কারণ হয় না। তারপরও এই সুবিধা এশিয়ায় সীমাবদ্ধ করা ঠিক হবে না। সেটা হলে এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত এশিয়াকে বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী বাজার হিসেবে পরিচিত করবে। এই চাহিদার উপর ভিত্তি করে শুধু এশিয়াতে নয়, বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি করবে। যা সারা বিশ্বের উৎপাদন ও সরবরাহের রুট হিসেবে কাজ করবে।
ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি করবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি উৎপাদন বাড়াবে। আর এটা দীঘস্থায়ী অথনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। চীন সাম্প্রতিক দশকে শিশু মৃত্যু ও শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। তা সত্ত্বেও বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের পুষ্টি এবং স্কুলে তালিকাভুক্তি হার কম।
উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নাগরিকদের চাহিদায় পরিবর্তন আনবে। দেশের রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে নারীদের শিক্ষা এবং কাজের সুযোগ বাড়বে। এর ফলে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বৃদ্ধি মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের রাস্তা আরো বেশি সুগম করবে। যেটা সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্যে খুবই দরকারী। ১৯ থেকে ২১ শতক পর্যন্ত চালানো একটি বড় মাপের জরিপে দেখা গেছে, যেসব দেশের জনসংখ্যা বেশি এবং সুশিক্ষিত, বিশেষ করে নারীরা বেশি শিক্ষিত ও রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য সেসব দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি তত মজবুত ও স্থায়ী।এই জরিপ অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সত্য।
পশ্চিমে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র পাশাপাশি থেকেই অগ্রগতি লাভ করেছে। সেখানে ভূ-স্বামীদের ক্ষমতা হ্রাস হয়ে বাজার ক্ষমতা বেড়েছে। আর এটা হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অবাধ কাজ করার সুযোগ পাওয়ার ফলে। মধ্যবিত্তের সক্রিয় রাজনীতির কারণে মানুষ নির্বাচনে পছন্দ মতো প্রাথী নির্বাচন করছে, একনায়কতন্ত্র প্রতিহত এবং জাতীয় স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সময়ে, মধ্যবিত্তের উত্থানের ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে জনগণের প্রতিষ্ঠান একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিনত হওয়া বন্ধ হয়েছে।
অনুরূপ অগ্রগতির একটি দেশ এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া। যেখানে ১৯৮০ সালে গণতন্ত্রের সূচণার পর দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। যার পেছনে কাজ করেছে একটি বৃহৎ মধ্যবিত্ত শ্রেনী। কোরিয়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে চীন, জনবহুল দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো এশিয়াতে।
একটি বড় মধ্যবিত্ত শ্রেনী থাকার সুবিধা নিতে এশিয়ার দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ, আয় ও শিক্ষাগত বৈষম্য দূরীকরণের দৃঢ়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। তাছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও তৈরি করা উচিত।
সর্বোপরি, জননীতি, আইনের শাসন শক্তিশালীকরণ, বাণিজ্য প্রচার, এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অর্জনের লক্ষ্যে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ক্রমাগত উর্ধ্বগামী গতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং তা বজায় রাখা অপরিহার্য। যে উর্ধ্বগামী গতিশীলতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেবে।