ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে পড়তে গিয়ে গ্রিক ও ইজিপ্সিয়ান সভ্যতা ও স্থাপনা সর্ম্পকে জানা, আর তা থেকেই এলিজা বিনতে এলাহীর আগ্রহ তৈরি হয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপরে। তিনি বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশ ঘুরে দেখেছেন বিভিন্ন স্থাপনা, জেনেছেন ইতিহাস ও মিশেছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠির সঙ্গে।
ফেসবুক ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপ বাংলার পথে ও ব্যাকপ্যাক রুমসের আয়োজনে এক ট্রাভেল আড্ডায় এসব তথ্য জানান তিনি। আড্ডায় এলিজার ভ্রমণ-গবেষণার কর্মের স্মৃতিচারণে তাকে সহায়ক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহযোদ্ধা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রেজওয়ান ইউরেকা।
শহীদ বীর উত্তম আনোয়ারা গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের পরে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করে এআইইউবি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এমবিএ করেছেন তিনি। পেশায় শিক্ষক এলিজা ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা থেকে শিক্ষাছুটিতে বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের হেগ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশনে পড়াশোনা করছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষনকে তিনি তার পড়াশোনার অংশ হিসেবে যুক্ত করতে পেরেছেন বেশ সফলতার সঙ্গে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশকেও। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে কীভাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা যায়, তা তার উচ্চতর পড়াশোনার বিষয়। কোয়েস্ট (অ্যা হেরিটেজ জার্নি ফর ডেভলপমেন্ট) নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তিনি বাংলাদেশের স্থাপত্যকর্মগুলো পরিদর্শন করছেন এবং তা তুলে ধরছেন বিশ্ব দরবারে।
কেমন চলছে তার পড়াশোনা, ভ্রমণ ও কর্ম, তা সাবলীলভাবে জানিয়েছেন এই গুণী নারী।
ভ্রমণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপরে কীভাবে আগ্রহ তৈরি হলো, সে সর্ম্পকে এলিজা বলেন, ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে পড়তে গিয়ে গ্রিক ও ইজিপ্সিয়ান সভ্যতা ও স্থাপনা সর্ম্পকে জানা ও আগ্রহ তৈরি। পরে মনে হলো, বিশ্বজুড়েতো অনেক কিছুই আছে, বাংলাদেশে কোথায় কী আছে তা জানা দরকার আগে। কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে না, আসলে নিজের জানার জন্য এই আগ্রহ ও ঘোরাঘুরি। আমি নিজে জানার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলেকে জানানো দরকার বলেও আমার মনে হয়েছে। সেজন্য আমি যা দেখে আসি, যা শিখি, তা ছেলের সঙ্গে শেয়ার করি, তাকে বলি। তবে হ্যাঁ, বর্তমানে মনে করছি এ বিষয়গুলোর একটি আর্কাইভ বা প্রকাশনা থাকা দরকার।
দেশের প্রত্নতত্ত্ব ও দেশ ভ্রমণ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী- প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা গুলো ঘুরতে গিয়ে আবারো মনে হয়েছে , গর্ব করার মত নানা বৈচিত্রে ভরপুর এক সমৃদ্ধ জনপদ ‘বাংলাদেশ’। একবছরে প্রায় ২০ জেলার ঐতিহ্যের স্থাপনা ঘুরে মনে হয়েছে ভাঙ্গা ইটের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখি। ২০১৬ সালের ১০ জুলাই শুরু হয় এই “হেরিটেজ জার্নি” যার নাম দিয়েছি QUEST। পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন দিয়ে শুরু হয় QUEST এর যাত্রা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা বিভাগ ও ময়মনসিংহ বিভাগের সব জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য সরেজমিনে ঘোরা হয়েছে এবং সর্বশেষ আপডেটের উপরে প্রকাশনাযোগ্য তথ্য আমার কাছে আছে।
ইট-কাঠ আর পাথরের ঘেরা এ শহরেই এলিজা ছোট থেকে বড় হয়েছেন। মা আইনপ্রণেতা হওয়ায় জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে রাজধানীর এমপি হোস্টেলে। বর্তমানে সেই ইট-কাঠ-পাথরের গন্ডি পাড় হয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশ। একজন ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে তার দেখা দেশ-স্থানগুলো নিয়ে লিখেছেন ২টি বই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেশের পর্যটনের তুলনা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি বলেন,’দেশের পর্যটন অনেকটা আগ্রহী ট্রাভেলারদের জন্যই এগিয়ে যাচ্ছে। পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার অনেক কাজ করলেও পর্যটক আকর্ষণে ও দেশীয় ঐতিহ্যগত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা রক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে। কীভাবে ওইসব ঐতিহাসিক ও আদি স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে হয়, তারও প্রায়োগিক জ্ঞানের ঘাটতি আছে। আমি অনেক জায়গায় দেখেছি, মেরামতের নামে পুরাতন ভবনের গায়ে থাকা স্থাপত্য নকশা তুলে ফেলে সরাসরি সিমেন্ট লেপে দেয়া হয়েছে। কোথাও আবার সেসব দেয়ালে ফুল-লতাপাতার টাইলস লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা অনেক সময় বুঝতেই পারছে না, কী দেখতে আসে পর্যটক? এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে আমি নিজে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় সরাসরি গিয়েছি, কিন্তু তারা খুব একটা সাড়া দেন নাই। বিদেশী পর্যটকদের জন্য এয়ারকন্ডিশন আর দামী দালান বানিয়ে লাভ নেই, তারাতো তাদের দেশে সেসবেই বড় হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনার বিষয়ে বিদেশীদের আগ্রহ আছে। কিন্তু পর্যটক নিয়ে আসতে পর্যটকদের নিরাপত্তা, ঐতিহ্যগুলো রক্ষা ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আর আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা, যতো সম্ভব দেশ ঘুরবো, দেশের সব জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সরেজমিনে দেখবো এবং সেগুলো নিয়ে প্রকাশনা করার ইচ্ছে আছে।
ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবসায়ী স্বামী ও এক পুত্র সন্তানের জননী এলিজা তার পরিবার নিয়েও ঘুরতে পছন্দ করেন। তারাও তার কাজে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যা দেখছেন তা শুধু নিজে বা তার পরিবার দেখুক, তা চান না তিনি। তার চোখে দেশের মানুষ বিশ্ব দেখুক সেজন্য ভবিষ্যতে বন্ধুদের নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা জানালেন এই গুণী নারী।
আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন বাংলার পথের এডমিন পলাশ ইসলাম, পর্যটন ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেন সুমন, সাংবাদিক মাজহারুল হক মান্নাসহ আরও কয়েকজন ভ্রমণপ্রেমী।