হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যান্ড দল এলআরবি পার করেছে তাদের পথ চলার দুই যুগেরও বেশি সময়। এখনো তাদের জনপ্রিয় তুঙ্গে। দেশে বিদেশের শ্রোতাদের মাতিয়ে চলেছে ব্যান্ডটি। ৫ এপ্রিল দেশের শীর্ষস্থানীয় এই দলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা:
যে গানকে ভালোবাসে না, সে মানুষকেও ভালোবাসতে পারে না। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে গান শুনতে অপছন্দ করেন। আর বাঙালিতো এমন হতেই পারে না। বাঙালি গান শুনতে জানে, সে গান শুনে নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারে, এবং ভালোবেসে যুদ্ধেও যেতে পারে। এটা প্রমানিত। তো এমন দেশে সংগীত দিয়ে শ্রোতা দর্শকদের মুগ্ধ করার শিল্পী আর গানের দলের জন্ম হবে এটা স্বাভাবিক! হলোও তাই, স্বাধীনতা উত্তরকালে এই বাংলায় তেমন প্রতিভাধর শিল্পী আর তাদের গানের দলের আবির্ভাব হলো। জন্ম নিলো সোলস, ফিডডব্যাক, এলআরবি আর নগর বাউল –এর মতো জনপ্রিয়সব গানের দল। প্রত্যেকটি দলই নিজেদের স্বকীয়তা আর সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে গানের মাধ্যমে মোহিত করলো দেশের শ্রোতা-দর্শকদের। এদের মধ্যে এলআরবি গানের দলটি দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে অনন্যতা পেয়েছে। গানের জগতে তাদের প্রবেশ, তাদের উল্লেখযোগ্য কীর্তী, গত দুই যুগের বেশি সময়ে সংগীত দুনিয়ায় তাদের বিস্তার, দেশের গানে তাদের অবদান এইসব কিছু জানানোর প্রচেষ্টা রইলো।
বর্তমান সময়ে শুধু বাংলাদেশি ব্যান্ড হিসেবে নয় সমস্ত বাংলা গানের অঙ্গনে এলআরবি একটি লিজেন্ডারি গানের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যান্ড দল হিসেবে এলআরবি যাত্রা করলেও ১৯৯০ সাল থেকেই সংঘঠিত হওয়া শুরু করে জনপ্রিয় এই ব্যান্ড দলটি। মূলত এলআরবি‘র প্রধান সদস্য ও লিড ভোকাল আইয়ূব বাচ্চু’র হাত ধরেই ব্যান্ডটির যাত্রা, এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি স্বয়ং। লিটল রিভারব্যান্ড –এর সংক্ষিপ্তরূপ হচ্ছে এলআরবি। যদিও পরবর্তীতে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ নামটি পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘লাভ রানস্ ব্লাইন্ড’। এলআরবি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরই বাংলা ব্যান্ড সংগীতে যেনো একটা ঝাঁকুনি লাগে। একটি ডবল অ্যালবাম দিয়ে সেই ঝাঁকুনি যেনো আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়। দুটি গান দিয়ে একটি পুর্ণাঙ্গ অ্যালবামের কাজও বাংলাদেশে এলআরবি’র আগে কেউ করেনি। নব্বই দশকের শুরুতে মাধবী এবং হকার নামে বের হয়েছিলো এলআরবি’র সেই বিখ্যাত ডবল অ্যালবাম।
আশির দশকে টানা দশ বছর জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’ –এর হয়ে গিটার বাজান আইয়ুব বাচ্চু। সেখান থেকে বের হয়ে এসে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন গানের দল ‘এলআরবি’। গানের প্রতি পরম ভালোবাসা থেকে জন্ম এলআরবি নামের ব্যান্ড দলটি। একটি ব্যান্ড দল যদিও একজন ব্যক্তির উপর ভর করে দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুর একাগ্রতায় আর গানের প্রতি পরম ভালোবাসায় বাংলাদেশের সংগীতে সত্যিকার অর্থেই দাঁড়িয়ে যায় ব্যান্ড দল এলআরবি। তাদের দর্শকপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা এতোটাই যে,আজ এলআরবি এবং আইয়ুব বাচ্চু যেনো একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। আইয়ূব বাচ্চু মানেই এখন এলআরবি, আর এলআরবি মানেই আইয়ুব বাচ্চু! বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন আইয়ুব বাচ্চু। অত্যন্ত গুণী এই শিল্পী তাঁর শ্রোতা-ভক্তদের কাছে এবি (AB) নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে গায়ক, লিডগিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার এবং প্লেব্যাক শিল্পী। ১৯৯১ সালে জন্ম হওয়া ‘এলআরবি’ ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং ভোকাল তিনি। এর আগে টানা দশ বছর ‘সোলস’ –এর লিডগিটারিস্ট হিসেবে থাকলেও ১৯৭৮ সালে ফিলিংস –এর মাধ্যমে সংগীত জগতে তাঁর প্রবেশ।
সিনেমা হউক কিংবা হউক গান, প্রকৃতপক্ষে এগুলোর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে দর্শক-শ্রোতারা। এই দর্শক কিংবা গানের শ্রোতারাই একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখেন। শ্রোতা কিংবা ভক্ত অনুরাগীরাই শিল্পীর সবচেয়ে আপন। তারাই যুগ যুগান্তর বাঁচিয়ে রাখেন শিল্পীদের। শ্রোতা-শিল্পী পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতায় কেটে যায় বছরের পর বছর। এলআরবি দর্শকদের কাছে তেমনি একটি গ্রহণযোগ্য ব্যান্ড দল। ১৯৯১ সালে তাদের যাত্রার পর থেকে আজ অবধি বহু অ্যালবাম আর অসংখ্য জনপ্রিয় গান ক্রমাগত উপহার দিয়েছে এলআরবি। ১৯৯১ সালে তাদের যাত্রা শুরু হলেও প্রথম অ্যালবামটি প্রকাশ পায় ১৯৯২ সালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডবল অ্যালবাম প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলো তারা। এরপর একে একে সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, স্বপ্ন, ফেরারী মন,আমাদের বিস্ময়, মন চাইলে মন পাবে, অচেনা জীবন, মনে আছে নাকি নাই, স্পর্শ ও যুদ্ধ নামের অ্যালবাম বের করে বাংলা ব্যান্ড গানের অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায় তারা। এলআরবি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে এতোটাই জনপ্রিয় যে, এলআরবি যখন কোনো স্টেজ শো’তে গান পরিবেশনের জন্যে যান, তখন নির্ধারিত কয়েকটি গান গাওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়ে উঠে না শ্রোতা-ভক্তের প্রত্যাশার সামনে। দর্শকদের চাওয়াকে উপেক্ষা করে যেতে পারেন না তারা। ফলে দর্শক-শ্রোতার চাহিদার সামনে তাদের গেয়ে যেতে হয় একের পর এক গান! শ্রোতা ভক্তরাও আপ্লুত হন এলআরবি’র এমন আচরণে।
একটা সময় ছিলো শুধু শহরে আর নগরে নয়, গ্রাম-গঞ্জ আর অলিতে গলিতে চলতো এলআরবি’র গান। ফেরারি মন, ঘুমন্ত শহরে কিংবা হকার, এখন অনেক রাত কিংবা রূপালী গিটারের মতো কালজয়ী গানগুলো যখন বেজে উঠতো। আর পাশ দিয়ে যাওয়া ভদ্রলোকটিও গুনগুনিয়ে উঠতো। হিন্দি কিংবা ভিনদেশি গানের আগ্রাসনে হয়তো সেইসব অলিগলি আজ দখল হয়ে গেছে। তবু আজও বাঙালি হৃদয় সেইসব গান প্রবল আগ্রহ নিয়ে শুনে। প্রণোদিত হয়, আহ্লাদিত হয়, আপ্লুত হয় সেইসব কালজয়ী গানের মাধ্যমে। এলআরবি শুধু তাদের গায়কী বা সুরের জন্যই বিখ্যাত হয়ে উঠেনি, বরং তাদের গানের লিরিকও মানুষের কাছে ছিলো অসম্ভব প্রিয়। সেই সময়ে ‘হকার’ নামের গানটি বাঙালি হৃদয় স্পর্শ করে গেছিলো। ‘হকার’ নামের গানটি শুনে বাঙালি হৃদয় কেঁদে উঠেছিলো। পুরো গানটির মধ্যে একজন হকারের জীবন, তার বাঁচার তাগিদ এবং ভয়াল ট্রাকের ধাক্কায় নির্মম মৃত্যুর কথা তুলে ধরেন গানটিতে। সত্যি সত্যিই এলআরবি’র এমন মনোমুগ্ধকর সুর আর কথায় বাঙালি হৃদয় কেঁদে উঠে। গানটি ছিলো এমন, একটি হকার কেউ নেই তার/ সকাল হলেই ছুটোছুটি/ আর চিৎকার করে বলে/পেপার পেপার…
এছাড়াও ‘চলো বদলে যাই’, ‘বাংলাদেশ’ কিংবা ‘হাসতে দেখো’র মতো এমনসব অসাধারণ গানে এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে কোনো তরুতাজা সময়ের স্মৃতি, কিংবা নস্টালজিক হতেই চলুন ফিরে যাই এলআরবি’র দিকে। গৌরবের সাথে দুই যুগের বেশি সময়কে পেছনে ফেলে আসা বাঙলার এই গানের দলের জন্য রইলো শুভকামনা। তাদের জনপ্রিয়তার এই যাত্রা অব্যাহত থাকুক যুগ যুগান্তরে।