সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতির উপকরণ হয়ে গেছেন। তাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলা যায়, এবং সে খেলাটা তিনি নিজেও যে উপভোগ করছেন না তা না। এরশাদকে নিয়ে এই খেলার ছলে তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই উপস্থাপন করে বসে আছেন। কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক এককভাবে এরশাদ এবং তার দলের ক্ষমতা যাই থাকুক না কেন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে এখনও তিনি গুরুত্বপূর্ণ; এবং এই গুরুত্ব সরকার গঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রসদ যোগানোর মতই।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে এরশাদ একটা সময়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেও বের হয়ে আসার পর ঠিক ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে না পারলেও ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে নির্ণীত হচ্ছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট গঠিত হলে সেই জোট ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করে। এরপর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলই অংশ না নিলেও এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। এবং সেই নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধীদলও হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টি।
নির্বাচনের আগমুহূর্তে নানা নাটকীয়তা, সকালে এক কথা ত বিকেলে আরেক কথা এমন অদ্ভুত সব কাণ্ড করেছিলেন তিনি। নিজে নির্বাচনে অংশ নেবেন না এমন সিদ্ধান্ত নিলেও তার পক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল হয়, সেটা যাচাইবাছাই শেষে বৈধও হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জিতেও যান তিনি। এরপর শপথ নেবেন না বললেও একটা সময়ে শপথও নেন তিনি। সাংসদ হন, সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন, সাংসদের সমূহ সুযোগসুবিধাও ভোগ করেন তিনি।
এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। তার দলের একাধিক সাংসদ মন্ত্রীও হন। সংসদের বিরোধীদল আবার সরকারের অংশীদার- এমন অদ্ভুত ভূমিকা পালন করে জাতীয় পার্টি, এবং সেটা পুরো পাঁচ বছরই। ওই সময়ে বারবার তার দলের পক্ষ থেকে দলীয় মন্ত্রীদের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের কথা বলা হলেও সেটা করেননি তারা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জাতীয় পার্টির একাধিক সাংসদ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
স্ত্রী সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, দলীয় একাধিক সাংসদ মন্ত্রীসভার সদস্য- এখানেই শেষ না এরশাদের প্রাপ্তি; তিনি নিজেও মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। মন্ত্রীদের জন্যে নির্ধারিত সুবিধাদিসহ তিনি পাচ্ছেন অফিস কক্ষ, বিদেশ ভ্রমণ, ভ্রমণের জন্য বিশেষ ভাতা, ইনস্যুরেন্স, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা। পেয়েছেন ১১ জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী। দেশ বিদেশে যোগাযোগের জন্য তার বাসা ও অফিসের টিএনটি ফোনের এবং ব্যক্তিগত মোবাইলেরও বিল দিচ্ছে সরকার। আছে সার্বক্ষণিক গাড়ি। তার জন্যে আছে সরকারি বাড়ি নেওয়ার সুযোগ, অন্যথায় তিনি নিতে পারেন বাড়িভাড়া আর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভাতা। এরই সঙ্গে এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে পুলিশ প্রোটোকলও রয়েছে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এরশাদ বারবার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিলেন। বয়সের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করতে চাইলেও সেটা সম্ভব ছিল না, কারণ যখনই আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাওয়ার মত কথা বলতেন তখনই দলের কিছু লোকের অথবা সরকারপক্ষের মাধ্যমে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতো। হাসপাতালে কদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর তিনি ফের সরকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করতেন। শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনের সময়ে তিনি বেশিরভাগ সময় হাসপাতালেই কাটিয়েছিলেন। তার সেই ঘন ঘন হাসপাতাল বিশেষ করে সিএমএইচ-গমনের বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে একটা রাজনৈতিক কৌতূহল নয় কৌতুকে পরিণত হয়েছে। এখন অনেকেই বলে সিএমএইচে গেলে এরশাদ ‘আওয়ামী লীগের লোক’ হয়ে যান।
কেবল দশম সংসদ নির্বাচনই নয়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও ফের এরশাদ সিএমএইচ-মুখো হয়েছেন। তিনশ’ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণার পর এবার এক দফা সিএমএইচে যাওয়ার পর ফের সরকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। দেশে যখন সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক জোটের জন্ম হয় তখন এরশাদ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ কথা বলতে শুরু করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় তখন তিনি বলেছিলেন এত লোক সঙ্গে করে নিয়ে গেলে সেটা সংলাপ হয় না। প্রথমে বলেছিলেন তিনি হাতেগোনা কয়েকজনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই সময় এও বলেছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করবেন এবং তার দলের জন্যে বেশি আসন ছাড় দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করাই তার সেই বৈঠকের উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত এরশাদ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এরশাদ ফের সিএমএইচে ভর্তি হন। তার এই অসুস্থতা কিংবা সিএমএইচ-গমনের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে এতখানি কৌতুহলউদ্দীপক ও কৌতুকের ঘটনা ছিল যে ওখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও মন্তব্য করতে হয়েছে। ওবায়দুল কাদের তখন বলেছিলেন, ‘সত্যি-সত্যি এরশাদ অসুস্থ’। এরবাইরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেও এরশাদের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। তবে যে যাই বলুক না কেন সত্যি সত্যি এরশাদ অসুস্থ হলেও এই দেশে এটা বিশ্বাস করানো এখন খুব কঠিন। দেশে এখন অনেকের জোর বিশ্বাস নির্বাচন এলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এরশাদ, এবং এটা তার ‘রাজনৈতিক অসুখ’। অথচ ৮৮ বছর বয়স্ক একজন লোকের বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হওয়া কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
এরশাদের দুঃখ যে তিনি অসুস্থ হলেও এটাকে ‘নাটক’ ভেবে অনেকেই আনন্দ খুঁজেন। আর এই আনন্দে এবার আরও কিছু রসদ যুগিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী এবং দলটির নতুন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেছেন, ঘুমের ডিস্টার্ব হলেও তিনি (এরশাদের) সিএমএইচে যান। বাসায় একা থাকেন বলে তার একলা লাগে, ভয় করে। তা ছাড়া ইনফেকশনের (সংক্রমণ) ভয়ও আছে।’
এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বদল হয়েছে। রুহুল আমিন হাওলাদারের জায়গায় এসেছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। হাওলাদার নির্বাচন করতে পারছেন না মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায়, আপিলেও টেকেনি মনোনয়ন। এমন অবস্থায় নতুন মহাসচিব আর এরশাদের শারীরিক অবস্থায় সরকারি দল আওয়ামী লীগও অনেকটাই নির্ভার।
মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি সর্বোচ্চ ৪০ আসন আদায় করে নিয়েছে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। সাবেক সামরিক শাসক, স্বৈরাচার এরশাদের দলের জন্যে এটা বড় এক অর্জন। দলটি নিজস্ব দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়েই নির্বাচন করবে। নির্বাচনের আগে-পরে যাতে এরশাদ ‘ডিগবাজি’ না খান এনিয়ে সতর্ক অবস্থানে আওয়ামী লীগ। জাপার মহাসচিব বদল দলীয় অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এখানে যে কোন খেলা নাই সে কে বলবে!
৩০ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (নৌকা) ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের (ধানের শীষ) কেউ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তবে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে যাওয়া এরশাদের জাতীয় পার্টিই (লাঙ্গল) সরকার গঠনের নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠতে পারে। সেই হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের জন্যে যেমন দরকার জাতীয় পার্টিকে, তেমনি জাতীয় পার্টির জন্যে একান্ত জরুরি আওয়ামী লীগের ভোট; ঠিক তেমনি সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও।
ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ২৮ বছর পর এরশাদ রাজনীতিতে এককভাবে কোন ভূমিকা রাখতে না পারলেও ভোটের রাজনীতি ও সরকার গঠনের রাজনীতিতে এখনও শক্তিশালী। তার এই শক্তিমান হয়ে ওঠা বারবার প্রমাণ হয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে; এবং কে জানে এটা আসন্ন সংসদ নির্বাচনের পর পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আরও অধিক শক্তিমান হয়ে ওঠার মাধ্যমেই হয় কিনা। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হচ্ছে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)