বাবা রাজনীতিবিদ ছিলেন। কোনো কারণে মারা গেলেন। সেখানে প্রার্থী বানানো হলো ছেলেকে, যে হয়তো রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। কিংবা কারো স্বামী মারা গেলেন। সেখানে তার নিরীহ বউটিকে মনোনয়ন দেয়া হলো। এক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা কী? নেতার ছেলে বা বউ। এটা কি কোনো আধুনিক সমাজে এমপি হওয়ার যোগ্যতা বলে বিবেচিত হতে পারে? হ্যাঁ, আমাদের দেশে এখনও এই আত্মীয়তার পরিচয়কেই ‘যোগ্যতা’ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো বিবেচনা করছে। কোনো একজন নেতার ভাই, বোন, বউ, বাবা, মা, ভাইস্তা-ভাস্তি, দাদা, নানারা নির্বাচনি রাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছেন।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমন সিদ্ধান্ত দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন, নানা বিতর্কের কারণে কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে মনোনয়ন না দিয়ে তার স্ত্রী শাহীনা চৌধুরীকে দলের প্রার্থী করা হবে। ওদিকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এমপি আমানুর রহমান রানার বদলে টাঙ্গাইল-৩ আসনে মনোনয়ন দেয়া হবে তার বাবা আতাউর রহমান খানকে। বদি এবং রানার জনপ্রিয়তা বিচার করেই নাকি এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এসব দেখেশুনে প্রশ্ন জাগে, আসলে এদেশে এমপি হওয়ার যোগ্যতা কী? ঠিক কী কী করলে বাংলাদেশ নামক দেশের এমপি বা মন্ত্রী হওয়া যায়? কেবল কোনো নেতা বা নেত্রীর আত্মীয় হলে এমপি হওয়া যাবে? অবৈধ সম্পদের পাহাড় ও কাড়ি কাড়ি কালো টাকা থাকলে এমপি হওয়ার টিকেট মিলবে? কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো কারণে রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেই মনোনয়ন পাওয়া যাবে? রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণ-এসব কি এমপি হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে না?
বাংলাদেশে এখন এমপি হওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষজন মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন এমপি পদে মনোনয়ন পেতে, এমপি হতে। বাংলাদেশে এমপি হতে পারাটা খুব লাভজনক। অর্থ-বিত্ত-সম্মান-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা সব কিছুই রয়েছে এমপি হতে পারার মধ্যে। কিন্তু শুধু এ জন্যই কি সবাই এমপি হওয়ার পেছনে ছুটছে?
হ্যাঁ, এমপি হতে পারাটা আমাদের দেশে খুবই লাভজনক একটা ব্যাপার নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাই বলে এমপি হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতার মাপকাঠিই থাকবে না? বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে এমপি হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতার মাপকাঠি নেই। বর্তমান জমানায় একজন পিয়ন-চাপরাশি কিংবা ঝাড়ুদারের চাকরি পেতেও আইএ-বিএ পাস করতে হয়। কিন্তু এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে সেসব যোগ্যতার কোনো বালাই নেই। অথচ এ পদটি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সচিবেরও উপরে।
কোনো পেশাকে ছোট করে দেখছি না, উদাহরণ হিসেবে বলছি, সমাজ-রাজনীতি-জনকল্যাণের সঙ্গে সংস্রবহীন একজন বালু ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, একজন পান দোকানদার, জুতার পাইকার কিংবা মুদিখানার মালিক অথবা ঝুট ব্যবসায়ী, উদীয়মান খেলোয়াড়-নায়ক-গায়ক-নর্তক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা-পুলিশ-সেনা, অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকার মালিকের মতো কিছু লোক এখন নির্বাচন সামনে এলেই এমপি হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেন। তারা ভাবেন যেহেতু পান দোকানদার কিংবা মুদিখানার মালিক কিংবা অন্য সব পেশায় তেমন কোনো সম্মান নেই, স্ট্যাটাস নেই, অন্যদিকে এমপি হতেও কোনো বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। তাই সহজ রাস্তাটি হচ্ছে কিছু মালকড়ি ঢেলে এমপি হতে হবে। অথচ গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার রাষ্ট্র শাসনকার্য পরিচালনাকে এয়ারক্রাফট অর্থাৎ বিমান চালনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। একটু এদিক সেদিক হলেই বিমানটি যেমন ক্র্যাশ হয়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ঠিক তেমনি দেশ চালাতে গিয়ে একটু ব্যর্থ হলেই দেশের সর্বাঙ্গে সর্বনাশ হয়ে যায়!
এমপি কোনো হেলা-ফেলা ব্যাপার নয়। এমপি হচ্ছে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বাংলায় বলে সংসদ সদস্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আইনসভা বা সাংবিধানিকভাবে প্রচলিত নাম ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ’-এর সদস্য। সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থায় সরকার ও রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় সংসদের সূচারুরূপে কাজ করার উপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল। বিরোধী দলের সব কথা বা বিল তেমন গুরুত্ব না দিলেও তাদের কথা ধৈর্য্য সহকারে অনুধাবন করার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র ও আইনসভার সফলতা। সংসদ সদস্যদের তাই জ্ঞানী, দুরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়। জনকল্যাণে আইন প্রণয়নের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অধিকন্তু, আইনের সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে।
আমাদের সংবিধানেও বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যাস্ত হইবে।’ এ থেকে বোঝা যায়, সংসদ সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব, দেশ পরিচালনার জন্য সকলের উপযোগী আইন তৈরি করা। এটা যে কোনো রাষ্ট্রের সংসদ সদস্যদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যদি তাই হয়, তাহলে সংসদ সদস্যদের নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়টি সংবিধানে সংযোজন করা হচ্ছে না কেন? আরেকটি কথা, যদি আইন ও নীতি প্রণয়ন সংসদ সদস্যদের মূল কাজ হয়ে থাকে তাহলে তাঁদের আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকাটা প্রয়োজন নয় কি?
কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা এসব নিয়ে খুব বেশি ভাবেন বলে মনে হয় না। অনেকেকে হেঁয়ালি করে বলতে শুনেছি, কি হবে এত আইন জেনে? আইন প্রণয়ন তো আইন মন্ত্রণালয় আর আমলাদের কাজ। আমাদের কাজ হলো হাত তুলে এই আইন পাস করা। সরকারি দলে থাকলে আইনের প্রশংসা করা। আর বিরোধী দলে থাকলে ‘কালো আইন’, ‘ক্ষতিকর আইন’, ‘গণবিরোধী আইন’ ইত্যাদি বলে সমালোচনা করা। আসলে আমাদের রাজনীতি এবং পুরো দেশটাই চলছে এক ধরনের হেঁয়ালির উপর। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা কোনো কিছুই তলিয়ে দেখতে, গভীরভাবে ভাবতে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পছন্দ করেন না। আপাতত তাদের একটাই ভাবনা: কীভাবে একজন প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যায়। ক্ষমতায় আসা বা থাকা যায়। যাকে তারা মনোনয়ন দিচ্ছে, তার চালচুলা-রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, জ্ঞানবুদ্ধি, সংসদে ভূমিকা পালনের দক্ষতা-যোগ্যতা আছে কি নেই, তাতে কিছুই যায় আসে না। তাদের চাই ‘তারকা’ খ্যাতি। আর এই খ্যাতির মূল নিয়ামক হচ্ছে টাকা! সমাজে এখন সে-ই ‘তারকা’ যার বিপুল টাকা আছে। সে টাকা যেভাবেই উপার্জন করুক না কেন!
এক সময় এদেশের মানুষ খুব-একটা লেখাপড়া করত না। তার দরকারও হতো না। একটু পেপার-পত্রিকা পড়তে পারলেই কাজ চলত। এখন দিন বদলেছে। লেখাপড়া ছাড়া এই আধুনিক সমাজে নিজে এগিয়ে যাওয়া কিংবা সমাজকে পথ দেখানো প্রায় অসম্ভব। তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-নির্ভর আজকের বিশ্বে অল্পশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হয়ে থাকা অচল মুদ্রায় পরিণত হওয়ার শামিল। কিন্তু আমরা এখনও সেই পুরনো ধ্যান-ধারণাতেই আটকে আছি। আমরা এখনও জ্ঞান ও শিক্ষাকে যোগ্যতা হিসেবে দেখবার মানসিকতা অর্জন করিনি। অথচ আমরাই তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে উন্নয়নের মহাসড়ক পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখছি!
একথা ঠিক যে পুঁথিগত বিদ্যা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষার মান, ব্যক্তির জানাবোঝার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই শোচনীয়। কিন্তু তাই বলে শিক্ষাকে বাদ দিয়ে তো কোনো যোগ্যতা নির্ধারণ হতে পারে না!
আগে আমরা দেখেছি, আইনসভার বেশিরভাগ সদস্য আইনজ্ঞ ছিলেন। তখনকার দিনে কালো টাকার মালিক বা এতো ঋণখেলাপি সংস্কৃতি ছিল না। বাংলাদেশে গত চার দশকে ঋণখেলাপিদের সংসদে স্থান করে দেয়াতে ওই কালোটাকার দাপটে সবকিছুই হচ্ছে। এর জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা। তাদের লোভ। তারা ওই ধরনের লোকদের থেকে আর্থিক অনুদান ও সাহায্য নিয়ে সমাজে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও মূল্যবোধের অধঃপতন ঘটাচ্ছেন। যার ফলে রাজনীতিবিদরা সমাজে যোগ্য সম্মান হারাচ্ছেন।
আজ জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সদস্য বিভিন্ন রকমের ব্যবসায়ী, ঋণ খেলাপী, কালো টাকার মালিক। সেখানে যে দক্ষ-যোগ্য-জ্ঞানী-গুণীরা নেই তা নয়। এমনকি যারা ব্যবসায়ী তাদের মধ্যেও শিক্ষিত লোক নেই সেটাও নয়। কিন্তু তারাতো তাদের শিক্ষাকে কাজে না লাগিয়ে কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আরও বেশি ফুলে-ফেঁপে উঠবেন সেই সাধনায় মশগুল।
রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে হলে কোনো বাছ-বিচার ছাড়া কেবল টাকাওয়ালা, ক্ষমতাবান, ‘তারকা’দের মনোনয়ন দেয়া বন্ধ করতে হবে। হ্যাঁ, রাজনীতি সবাই করতে পারবে, তারা এমপি পদে মনোনয়নও পাবে, কিন্তু তাদের ন্যূনতম স্নাতক হতে হবে। কমপক্ষে পাঁচ বছর না হোক, অন্তত তিন বছর তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতে হবে। আজ দলে যোগ দিয়ে কালই মনোনয়ন পাবে না। কারো যদি তেমন খায়েশ থেকেই থাকে তবে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে হবে। সামান্য এই কয়েকটি নীতি যদি রাজনৈতিক দলগুলো মেনে চলে তাহলেই কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)