চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

এবার অন্ততঃ পুলিশকে সামলান মন্ত্রী মহোদয়

গত কিছুদিন ধরে আমাদের পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারবার সংবাদ শিরোণামে পরিণত হচ্ছে। বিশেষতঃ গত বৃহস্পতিবারে এক হাজার টাকা চাঁদা না দেয়ায় এক নিতান্ত দরিদ্র চা দোকানদারকে আগুনে পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা প্রদর্শনের ব্যাপারটি এখন “টক অফ দ্যা কান্ট্রি”তে পরিণত হয়েছে।

বাবুল মাতুব্বরের ছেলে রাজু জানান, গুদারাঘাটে কিংশুক বহুমুখী সমিতির গেটের পাশে রাস্তায় বাবুল মাতুব্বরের চা দোকান। চুলা হিসেবে কেরোসিনের স্টোভ ব্যবহার করেন। বুধবার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে শাহআলী থানা পুলিশের একটি টহল টিম মাইক্রোবাসে তার দোকানে যায়। রাস্তায় দোকান বসানোর জন্য পুলিশ তার কাছে চাঁদা চায়। বার্ন ইউনিটে রাত সাড়ে ১০ টার দিকে চিকিৎসা নেয়ার সময় দগ্ধ বাবুল মাতুব্বর চিৎকার করে বলেন, আমি বলি টাকা দেব কেন? এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্ক হয়। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠি দিয়ে স্টোভের চুলায় আঘাত করে। স্টোভের কেরোসিন ছিটকে তার গায়ে পড়ে আগুন ধরে যায়। দোকানেও আগুন লাগে। এতে তিনি দগ্ধ হন। বাবুলের পুত্রবধূ মনি আক্তার বলেন, যার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় তার গায়ে পুলিশের পোশাক দেখেছেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গাড়ি নিয়ে চলে যায়।

পুলিশের আগুনে দগ্ধ চা দোকানি বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। পুলিশের বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন পুলিশের এখন লাগাম টেনে ধরা দরকার; অত্যাচারী পুলিশ আমাদের প্রয়োজন নেই। ড. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ যে বাড়াবাড়ি করছে তা চরম পর্যায়ে পৌছেঁছে। পুলিশের এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে সমাজ তথা পুলিশ বাহিনীর ওপর প্রভাব পড়বে।’(আমার দেশ)

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বীকে হেনেস্থা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সাথে অশালীন আচরণ, সরকারী কর্মকর্তাকে মারধরের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটিয়ে চলেছে পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ নিজেই অপরাধী বিধায় অনেক ঘটনাই ভবিষ্যৎ হয়রানির আশংকায় এগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন প্রকার অভিযোগ উত্থাপন করেন না অধিকাংশ ভুক্তভোগীরাই। ফলে ক্রমশ আরো বেপারোয়া হয়ে উঠছে এই বাহিনীর সদস্যদের কার্যকলাপ।

ব্রিটিশ কলোনিয়াল ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছে আমাদের পুলিশ বাহিনী। ব্রিটিশ আম্মলে প্রণীত পুলিশ রেগুলেসন্স অনুযায়ী পরিচালিত হয় আজো এই বাহিনীটি। কোম্পানি আমলে স্থানীয়দের সেপাই পদে নিয়োগ করা হতো, একটু লেখাপড়া জানলে দারোগা। এএসপি পদে সাদা ছোকড়া আসতো বিলেত থেকে, এসেই সবার দণ্ড মুন্ডের মালিক বলে যেতো। পরবর্তীতে নবাব/ রাজা/ মহা রাজাদের ছেলেরা ঈন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের মাধ্যমে বড় পদে আসতে শুরু করে কিন্তু উঁচু পদ্গুলো ছিল রাজার জাত সাদাদের জন্য বরাদ্দ। সে সময় সেপাইরা স্বপ্ন দেখতো দারোগা হবার – দারোগারা স্বপ্ন দেখতো ডিএসপি হবার।

কোম্পানি আমল- পাকিস্থান আমল শেষ করে বাংলাদেশ আমল শুরু হয়েছে ; কিন্তু সেই আচার এখনো রয়ে গেছে। পুলিশের কলোনিয়াল উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে ডঃ মাহবুবউল্লাহ স্যার লিখেছিলেন, “১৭৯২ সালে এতদঞ্চলের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দারোগা আইনের প্রবর্তন করেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এ দেশে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। মুঘল শাসনে জমিদার শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। মুঘল সম্রাটরা মনসবদারি প্রথা চালু করেছিলেন। মনসবদাররা সবাই সমান ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন না। একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য একজন মনসবদার থাকতেন এবং তার অধীনে বিভিন্ন সংখ্যায় ও মাত্রায় পাইক থাকত। যে মনসবদারের পাইকের সংখ্যা বেশি থাকত, সে-ই ছিলেন অধিকতর ক্ষমতাশালী। পাইকরা এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ দমন, সম্রাটের জন্য কর, খাজনা আদায় এবং সম্রাটের প্রয়োজনে যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণ করত। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত খাজনা পাইকদের বেতন-ভাতা নির্বাহ করা, মনসবদারের প্রাপ্য পূরণ করা এবং সম্রাটের প্রাপ্য পরিশোধে ব্যবহার করা হতো। তবে ক্ষেত্রবিশেষে খোদ মনসবদাররা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন। ১৭৯২ সালের দারোগা আইন স্থানীয় আইনশৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে মুঘল ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কোম্পানি শাসকরা দারোগাদের জন্য খুবই সামান্য মাসমাহিনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তাদের দেয়া হয়েছিল বল প্রয়োগের প্রচুর ক্ষমতা। ধরে নেয়া হয়েছিল মাস-মাহিনার ঘাটতি দারোগারা তাদের বল প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে আদায় করে নেবেন। আইন লংঘনকারীরা এভাবে দারোগাদের ঘুষ দিয়ে অনেক সময় রেহাই পেত। এক অর্থে বলা যায়, দারোগাদের প্রদেয় ঘুষই ছিল আইন লংঘনের জন্য এক ধরনের জরিমানা।

দারোগা আইনের ওপর ভিত্তি করে গত দুই শতাধিক বছরে এ দেশে পুলিশ প্রশাসন গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি আমল এবং বাংলাদেশ আমলেও এর চরিত্রগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেক আইন-কানুন রচিত হয়েছে। পুলিশি ক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে গণতন্ত্র চালু আছে বলেও দাবি করা হয়। এসব সত্ত্বেও একটি প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। প্রবাদটি হল, ‘বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর ঘা’। অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই ১৭৯২ সাল থেকে পুলিশ বেতন-ভাতা হিসেবে যা পায় তা অতি নগণ্যই। তাদের ক্ষমতার শাখা-প্রশাখা এতই বিস্তৃত যে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সব ক্ষেত্রের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ অবশ্যম্ভাবী। পুলিশকে বিচিত্র ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি-চামারি পর্যন্ত সব কিছুতেই পুলিশের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি। দেশের পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যে, কোথায় কখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে, সড়ক অবরোধ হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শত-সহস মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, অকল্পনীয় রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হবে- এর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পুলিশকে। কখনও কখনও পুলিশও খুন-জখমের শিকার হন। জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল। হাল আমলে পুলিশকে অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, জল কামান এবং সাউন্ড গ্রেনেড। এত কিছু করেও মাঝে মাঝে পুলিশকে অসহায় মনে হয়। আবার একথাও সত্য যে, পুলিশের বাড়াবাড়ি এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে পুলিশ পরোয়া করে বলে মনে হয় না। অনেক সময় নিরীহ মানুষকে আসামি সাজিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়। এমনকি ধৃতাবস্থায় তাদের পায়ে গুলি করা হয়। আইন যদিও বলছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাকিমের কাছে উপস্থিত করতে হবে, এখন তার ব্যত্যয়ই সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে আর পাওয়া যায় না। কখনও কখনও খালে-বিলে, রেললাইনের ধারে ভাগ্যাহত ব্যক্তির গলিত লাশটি উদ্ধার হয়। এসব কিছু আমরা জানতে পারি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে। অনেক সময় প্রতিবেদকও পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়া থেকে রেহাই পান না। এর সবকিছুই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক।

পুলিশের কাজ হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ঘটনা এমনভাবে ঘটে, মনে হয়, দুষ্টরাই পুলিশের কাছে আদৃত এবং শিষ্টরাই পুলিশের চক্ষুশূল। কারণ কোনো নীতিবান মানুষই পুলিশকে বেআইনিভাবে উপরি দিতে রাজি হয় না। পুলিশ বাহিনীকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। তাদের লোগোতে জ্বলজ্বল করে “সেবাই ধর্ম” লেখাগুলো। প্রতিনিয়ত আমাদের জানমালের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করেন। দুষ্কৃতিকারীদের সাথে সংঘর্ষে প্রতিবছর প্রাণ হারান , পঙ্গু হন অনেক পুলিশ সদস্য। তারপরও এই ধরনের কিছু সদস্যদের জুলুমবাজির কারণে এই পোশাকটা মানুষের কাছে ক্রমশঃ লাফিং স্টকে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ফিল্ড লেভেলের কর্মকর্তাদের বাড়াবাড়ির শিকার হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ সাধারণ মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসাইটি অফ ক্রিমনলিজির নির্বাহী সদস্য শেখ বাতেন বলেন, “একজন আলোচিত আইজিপি বলেছিলেন, তিনি এসপি থাকাকালে এক পুলিশ পরিদর্শক বিরক্ত হয়ে তাকে বদলি করিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ সার্ভিসের বাইরে–প্রেষণে।”  চেইন অব কমান্ড-এর দুর্গতির অনেক গল্প আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র পুলিশের সশস্ত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিম্ন আদালতের বিচারক ও সিভিল আমলাদের জবাবদিহিতার আওতায় রাখা হয়। বাংলাদেশের মিলিটারি শাসকরা গণনির্যাতনের সুবিধার জন্য সে আইন বাতিল করে দিয়ে গেছে। সেই থেকে পুলিশ নির্বাহী আমলাদের নিয়ন্ত্রণ মানতে রাজি না, মানেও না। ফলে, কেতাবে লেখা না থাকলেও কার্যত সে নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে এলাকার এমপি, মন্ত্রী, এপিএস ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে। যাদের নামে সর্বদাই থানায় ডজন খানেক খুনখারাবির মামলা ছিল বা আছে।

বাস্তবতা হলো এরাই পুলিশের বদলি, পদায়ন, মিশনে যাবার সুযোগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। কললিস্ট পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এরা সার্বক্ষণিকভাবে থানায় হস্তক্ষেপ করে। পুলিশ এদের কাছে শুধু অসহায় নয়, নাজেহালও হয়। বাধ্য হয়ে কিংবা আগ বাড়িয়ে এরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে নষ্টদের সহযোগিতা করে। অর্থাৎ দুর্বলের উপর বলপ্রয়োগ, নারী নির্যাতন, সাংবাদিককে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া, নিরপরাধীকে নাজেহাল, বিচার প্রার্থীকে হেনস্থা, জমির জবরদখলকারীর পক্ষ নেয়াসহ এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। কাকে নিরাপত্তা দিতে হবে, কার বিরুদ্ধে কতটা বলপ্রয়োগ করতে হবে সেই পেশাগত রাষ্ট্রীয় দায় ভুলে গিয়ে নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। তাই, একজন থানার ওসি পর্যায়ের কর্মকর্তার জবাবদিহিতার জন্যে আজ হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, নিচের পর্যায়ে অনেক বিচারাদালত, জনপ্রশাসনের অনেক স্তর থাকা সত্ত্বেও। যে কথা শুনতে অনেকের ভালো লাগবে না তা হলো, দুইটি দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক দল আমাদের জীবন, নিরাপত্তা ও ইজ্জতের বিপরীতে পুলিশের আচরণকে ক্রিমিনালাইজ করে ফেলেছে, আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতোই।”

১৯৭৫ সালে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তব্যের কিছু অংশঃ ‘আজ তিন বছর হলো বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজ প্রথম আমাদের পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এখন একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। যে রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি, সেই রক্ত দিয়েই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, এই রাজারবাগে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা আপনাদেরই ভাই। তারাও পুলিশে চাকরি করতেন। জনগণের সঙ্গে তারা হাত মিলিয়েছিলেন। ত্রিশ লক্ষ লোকের সঙ্গে পুলিশের অনেক লোকও আত্মত্যাগ করেছিলেন। তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের ইজ্জত আপনারা রক্ষা করবেন। তাদের সম্মান আপনারা রক্ষা করবেন। তাদের আত্মা যাতে শান্তি পায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। মনে রাখবেন, আপনাদের মানুষ যেন ভয় না করে। আপনাদের যেন মানুষ ভালোবাসে। আপনারা জানেন, অনেক দেশে পুলিশকে মানুষ শ্রদ্ধা করে। আপনারা শ্রদ্ধা অর্জন করতে শিখুন।’

‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন। মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরীবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনাদের নয়, সমগ্র সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যেন কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন।’

‘আর যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আল্লাহর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আমি আপনাদের জাতিরপিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে। আপনাদের প্রত্যেকটি কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চাপে, আমার সহকর্মীদের ঘাড়ে চাপে। এজন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইলো, আমার অনুরোধ রইলো, আমার আদেশ রইলো, আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে হয় না। একটা গরিব যদি হাত তুলে আপনাকে দোয়া করে, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এজন্য কোনদিন যেন গরিব-দুঃখীর ওপর, কোনদিন যারা অত্যাচার করেনি, তাদের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। যদি হয়- আমাদের স্বাধীনতা বৃথা যাবে।’

‘আমার ভাইয়েরা, এক দল লোকের পয়সার লোভ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পয়সার জন্য তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মৃত্যুর পর এ পয়সা তাদের কোন উপকারে আসবে না। এই পয়সায় যদি তাদের সন্তানরা মানুষ না হয়, তাহলে তারা নানা অপকর্মে তা উড়িয়ে দেবে। তাতে তারা লোকের অভিশাপ কুড়িয়ে আখেরাতেও শান্তি পাবে না। তাই আমি সকলকে অনুরোধ করি, রাত্রে একবার চিন্তা করবেন, সারাদিন ভালো কিছু করেছেন, না মন্দ করেছেন। দেখবেন, এতে পরের দিন মনে আশা জাগাবে যে, আমি ভালো কাজ করতে পারি।’

‘আপনাদের দুঃখ-কষ্টের কথা আমি জানি। আপনাদের খাওয়া-পরার কষ্টের কথাও। কিন্তু কষ্ট কি শুধু আপনারাই করছেন? যাদের টাকা দিয়ে আমরা চলি, তারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে। আমরা চাই একটা শোষণহীন সমাজ। আমরা চাই ইনসাফের রাজত্ব। আমরা চাই মানুষ সুখী হোক, গরিব-দুঃখী, বড়-ছোট পেট ভরে ভাত খাক। তাহলেইতো আমাদের স্বাধীনতা সার্থক হবে। যারা আত্মত্যাগ করেছে, রক্ত দিয়েছে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে’।

স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সম্ভবতঃ উলুবনেই মুক্তো ছড়িয়েছিলেন। পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। Tomlins লিখেছেন, আমেরিকান রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে গিয়ে পুলিশের বংশ লতিকা উল্লেখ না করা হবে পুঁজিবাদের আলোচনা না করে আমেরিকান অর্থনীতির ইতিহাস লেখার চেষ্টা করা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে পুলিশ বলতে বোঝাত একটি সুশৃংখল পরিবেশের স্রষ্টা, যে পরিবেশ হবে বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। পুলিশ একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। পুলিশ শব্দটির মূল খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে এবং সেখান থেকে গ্রিসে। গ্রিসে এরিস্টটলের লেখায় পলিসি অথবা পলিটিক্সের উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে বোঝানো হতো, দেশের সমুদয় প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে বোঝানো হতো, যেগুলোর মাধ্যমে সমাজে শৃংখলা আসে এবং শৃংখলা থেকে আসে সমৃদ্ধি, প্রগতি এবং সুখ, বিশেষ করে যার ফলে বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

বস্তুত: এটাই হল শাসন ব্যবস্থার একটি অংশ, যার মাধ্যমে সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুলিশ বাহিনীর বেপারোয়া আচরণে ক্রমশঃ নাভিশ্বাস উঠছে জনজীবন। রক্ষককে বিবেচনা করা হচ্ছে ভক্ষক হিসেবেই। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর বেশী দূরে নয়,যেদিন পুলিশ বাহিনীকে একটি অস্ত্রধারী পেটোয়া বাহিনী ছাড়া আর কিছুই বলে বিবেচনা করবেনা আমজনতা। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। তাই অনতিবিলম্বে পুলিশ বিভাগে ব্যাপক সংস্কার আনা প্রয়োজন। যাতে জনগণের প্রতিপক্ষ না হয়ে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই এই বাহিনী দেখা দিতে পারে। এখনো সময় আছে মাননীয় স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়। এবার অন্ততঃ পুলিশকে সামলান।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)