চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘এধরনের অপরাধকে চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা অযৌক্তিক’

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ে হাইকোর্ট

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘এ ধরনের সংঘটিত অপরাধকে শুধু চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হলে, তা অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে। কারণ, মূল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আসামীরা তাঁদের লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন।’

আলোচিত এই মামলায় ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম। আর তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান।

এই রায়ে বলা হয়েছে ‘আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামীরা দেশের প্রচলিত আইন মান্য করতে নারাজ। তারা জঙ্গি তৎপরতার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে চায়। কিন্তু তাদের এই ধরনের চিন্তা দেশের প্রচলিত আইন কখনো সমর্থন করে না। কারণ, তারা সকলেই জন্মগতভাবে এ দেশের নাগরিক। ষড়যন্ত্র করে ও দুটি বোমা পোঁতার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ তারা সংগঠিত করেছে, তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও জঘন্য। এ অবস্থায় কয়েকজন কয়েদির (দণ্ডিত আসামী) দীর্ঘ হাজতবাসে তাদের দণ্ড লঘু করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’

রায়ে আরো বলা হয়েছে, ‘আসামীরা তাদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন যে একটি নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যা করবেন মর্মে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিস্ফোরকদ্রব্যের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে দুটি বোমা তৈরি করে ঘটনাস্থালে স্থাপন করেছিলেন তাঁরা। ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের জন্য আসামীরা বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন দুটি বোমা তৈরি ও তা মাটির নিচে পুঁতে রাখার মধ্য দিয়ে, যাতে ধ্বংসাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয়।’

এছাড়া হাইকোর্ট এই পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলেছেন যে, ‘এ ধরনের সংঘটিত অপরাধকে শুধু চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হলে তা অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে। কারণ, মূল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আসামিরা তাঁদের লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন।’

এই মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস.এম. মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ, ডঃ মোঃ বশির উল্লাহ, ইয়াসমিন বেগম (বিথী), সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমান খান শাহিন, মুহাম্মদ শাহীন মৃধা, মোঃ সাফায়েত জামিল, আশিকুজ্জামান বাবলু, সৈয়দা জাহিদা সুলতানা রত্না ও সায়েম মোহাম্মদ মুরাদ। আর আসামীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, মোহাম্মদ আহসান, মো: নাসিরউদ্দিন। এছাড়া পলাতক আসামীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন আমূল্য কুমার সরকার।

২০০০ সালের ২১ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। পরদিন ওই স্থানেই শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। বোমা উদ্ধারের ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক নূর হোসেন বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পরে মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত শেষে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর গোপালগঞ্জের আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এই মামলার বিচার শেষে হরকাতুল জিহাদের ১০ নেতাকর্মীর ফাঁসি, একজনের যাবজ্জীবন ও তিনজনের ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। এই রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। আর আসামী আনিসুল ইসলাম, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ও সারোয়ার হোসেন মিয়াকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক বছর করে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই মামলা থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়।

বিচারিক আদালতের ওই রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী আসামীদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল আসামীদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়ে দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি ও ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত দুই আসামীর সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এছাড়া ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামী সারোয়ার হোসেন মিয়াকেকে খালাস দেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামীরা হলেন ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান খান ওরফে শিমন খান, ইউসুফ ওরফে মোসহাব মোড়ল ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে মুফতি রউফ ওরফে আবদুর রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর।