লক্ষীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) শেখ মুর্শিদুল ইসলামের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সালাহ উদ্দিন শরীফকে আটকের পর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সোমবার সকালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নুরুজ্জামান তাকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
খবরে প্রকাশ, সোমবার সকালে শহরের কাকলি স্কুলের প্রবেশ পথ দিয়ে আগে-পরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও ডা. সালাহ উদ্দিন শরীফের কথা কাটাকাটি হয়। এসময় তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে পুলিশ ডাক্তারকে আটক করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পুলিশ এই চিকিৎসককে কারাগারে পাঠায়।
প্রশ্ন হচ্ছে এডিসির সাথে তর্ক করা কী তবে অপরাধ? এর শাস্তি কি তিনমাসের জেল? তাহলে একজন ডিসি, এসপি, সচিব বা মন্ত্রীর সাথে তর্ক করা কি আরো বড় অপরাধ? এর জন্য শাস্তি কি আরো বেশি? এগুলো কি বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের অংশ? তা যদি না হয়, তা হলে কোন আইনে এমন বিশেষ আদালত বসিয়ে একজন সাবেক সিভিল সার্জনকে দণ্ড দেয়া হলো? এটা কি মগের মুল্লুক? ‘জোরের যুক্তি’ প্রতিষ্ঠিত হবে প্রশাসনে? তর্ক তো দুজনেই করেছেন, ‘হাতাহাতি’ও দুজনেই করেছেন, তাহলে শুধু ডাক্তারকে দণ্ড দেয়া হলো কেন? তর্ক করার জন্য কি এডিসি সাহেবের কোনো শাস্তি হবে? এর জন্য কি কোনো ভ্রাম্যমান আদালত বসানো হবে? এসব প্রশ্নে উত্তর কে দেবে?
এমন আমলাদের দৌরাত্ম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় আসলেই বয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রের ‘স্থায়ী কর্মচারী’দের সাধারণত ‘আমলা’ বলা হয়। অন্যান্য আরও কিছু পেশার মানুষদের মতো আমাদের দেশে এই আমলাদের মধ্যেও ‘গণশত্রু’ হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে! এটা রাষ্ট্র সমাজ, সরকার কারও জন্যই শুভ নয়। আমলাদের জন্যও নয়।
আমলাদের নিজের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। নিজেদের ‘আচরণ’ বদলানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যুরোক্র্যাসি সম্পর্কে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীদের যে তত্ত্ব এবং মতামত পাওয়া যায়, তা মোটেও গরিমাপূর্ণ নয়। দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের মতে, ব্যুরোক্র্যাসি সম্পূর্ণ ভাবে কর্তৃত্বের পূজারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এই ব্যুরোক্র্যাসি। লেনিনও ব্যুরোক্র্যাসি সম্পর্কে একই রকম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন।
সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার ব্যুরোক্র্যাসি বিষয়ে নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন। এ কথা স্বীকার করতেই হয়, ব্যুরোক্র্যাসি সম্পর্কে প্রকাশিত নেতিবাচক ধারণা থেকে তিনি এটিকে মুক্ত করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী, আধুনিক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যুরোক্র্যাসি প্রশিক্ষিত প্রশাসক এবং কর্মীদের একটি সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত। যার মাধ্যমে যুক্তিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আধিপত্য গড়ে ওঠে কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে।
ব্যুরোক্র্যাটের বাংলা পরিভাষা আমলা শব্দটি সাহিত্যে, সংবাদ মাধ্যমে এমনকী বৈঠকি আড্ডার আসরেও প্রবল ভাবে উপস্থিত এবং বর্তমানে সর্বজনগৃহীত। সংসদ অভিধানে ব্যুরোক্র্যাসির একটি মাত্র বাংলা অর্থ বা প্রতিশব্দ হিসেবে আমলাতন্ত্র ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র তার নখদন্ত প্রবল ভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। আমলাতন্ত্রের দৈরাত্ম দেখে অনেকে একে ‘আমলাশাহীও বলে থাকেন। মিশেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র তখন গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে তোলে। তাইতো অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশ তো মন্ত্রীরা চালান না, আমলারা চালান’।
আসলে আমলা শব্দটার জন্ম-ইতিহাস রয়েছে অন্যত্র। রাষ্ট্রকর্মের আধুনিক ইতিবৃত্তে নয়, এর জন্ম ও লালন হয়েছে জমিদারি সেরেস্তায়। অন্তত আমাদের সংস্কারে নায়েব-গোমস্তা-সেরেস্তাভৃত্যদের একটা ছবি ফুটে ওঠে আমলা শব্দটায়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শব্দকোষ’-এ আমলা শব্দটার নীচেই আছে আর একটা শব্দ আমলাফয়লা। তার অন্যতম অর্থ মোসাহেব। রবীন্দ্রনাথেও আমলাফয়লাকে দেখা যায় মফঃস্বলি কাছারিতে। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে কর্তাদের শুভ কাজে ভৃত্যসমাজে উৎসাহের ঢেউ উঠল: ‘আমলা ফয়লা পাইক বরকন্দাজ সবারই গায়ে চড়ল নতুন লাল বনাতের চাদর, রঙিন ধুতি।’ শরৎচন্দ্র আরও স্পষ্ট। ‘দত্তা’য় বিজয়ার ‘দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী’দের উপর নরেন তার স্বত্বের কথা বলে, অন্য দিকে ক্ষুব্ধ বিলাসেরও নায়িকার কাছে ক্ষুণ্ণ প্রশ্ন: ‘আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?’ বাংলা সাহিত্যে আমলা মানেই কর্তার বশংবদ ভৃত্য মাত্র।’’
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে আমলা শব্দের অর্থ বিবেচনা করতে গিয়ে অন্যতম সংজ্ঞা হিসাবে বলছেন: ‘উচ্চ কর্মচারীর অধীন কর্মচারী…’, অর্থাৎ আমলা শব্দের মধ্যেই অধীনতার ঘোষণা আছে। ‘আমলা’ শব্দটির মানে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেই আসলে ঝামেলা আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান’ আমলা শব্দের ব্যাখ্যায় সতীনাথকে উদ্ধৃত করে টিপ্পনি দিয়েছে: ‘উকিল, মোক্তার, আমলা সবাই ঝুঁকে সেলাম করে জজসাহেবকে!’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতায় বললেন, ‘যারা সাহিত্যের ওমরাও-দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা দলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা, ফ্যাশান তাদেরই’।
পরিহাসের কথা, আধুনিক ইউরোপের আইন-শাসিত সেই ব্যুরোক্র্যাটের বাংলা তর্জমা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমলা। কার্যকারণের অবিচলিত সম্পর্ক তৈরি করতে আধুনিক পুঁজি যে নিয়মতান্ত্রিকতা চাইল, তার বাংলা হয়ে দাঁড়াল আমলাশাহী। ঔপনিবেশিক খণ্ডিত আধুনিকতা ও কিছু রাষ্ট্রকর্মীর ক্লৈব্যের প্রতি অবজ্ঞায় সাংবাদিকের বাংলা ফিরে তাকাল জমিদারি আঁতুড়ঘরে। রাজপুরুষ, রাজকর্মচারী, সিভিলিয়ান, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, হাকিম, সচিব, রাষ্ট্রকর্মী ও জনসেবক ইত্যাকার বহুবিধ বর্ণময় শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে বাংলা গদ্যে ‘আমলা’ নামক একটি শব্দকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠছে যেন একটা আপতিক ঐকমত্য।
বৃত্তির বর্ণনায় সে বৃত্তির শ্রেষ্ঠ ও স্বাভাবিক আদর্শ বিধৃত থাকবে, এটাই কাম্য। আমলার আচরণ ক্ষেত্রবিশেষে মোসাহেবি হলেও শুধু সেই বিবেচনায় তার পেশার নামকরণ চলে না। কিছু শিক্ষক হয়তো ছাত্রদের পীড়ন করেন। তথাপি আমরা আমাদের শিক্ষকদের পীড়ক না বলে শিক্ষক বলি। কিছু যাজক অনাচারী, তবুও আমরা তাঁদের বৃত্তির নামকরণে যাজনের কথাই স্মরণ করি। পেশা, ক্রিয়া ও নামকরণের সমন্বিত ও স্বচ্ছ সংযোগে বৃত্তির বর্ণনা উদ্ভাসিত হয়। সেই উদ্ভাসে কখনও কখনও ইতিহাসের দীর্ঘ ছায়া পড়ে। ‘আমলা’ শব্দটি এই মহত্ত্বের ছায়া থেকে বঞ্চিত।
অথচ রাষ্টকর্মের ইতিহাসেও এই পশ্চাদ্বর্তী প্রলম্বিত মহৎ ছায়ার সন্ধান সম্ভব। বস্তুত, এই সন্ধান প্রয়োজনীয়। ফিলিপ মেসন তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য মেন হু রুলড ইন্ডিয়া’য় ভারতে সিভিলিয়ানদের ঐতিহ্য ও সংস্কারের সন্ধান করতে গিয়ে প্লেটো পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। ‘গার্ডিয়ান’ শব্দের ব্যবহার করে তিনি আধুনিক আইসিএস অফিসারকে যুক্ত করেছেন প্রাচীন গ্রিক অ্যাকাডেমির নিষ্কাম অভিভাবকদের সঙ্গে। হালের রাষ্ট্রতাত্ত্বিক আগামবেন ব্যুরোক্র্যাটের জীবনচর্চার শ্রেষ্ঠ আদর্শের মধ্যে খুঁজতে চেয়েছেন ক্রিশ্চিয়ান ধর্মতত্ত্বের অ্যাঞ্জেলদের নিরাসক্ত কর্মকে। কাজিদের ন্যায়াদর্শ নিয়ে বহু গল্পই আজ প্রবাদে পরিণত। অযুত অনাচার সত্ত্বেও সেই সব সমুচ্চ আদর্শের একটা ছায়া পড়বে না বৃত্তির নামপরিচয়ে? নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রিক আইনানুগ ন্যায়াদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভৃত্যত্বের স্মারক ওই আমলা হয়েই থাকবেন? কোনও দিন কিছুতেই কি বুঝবেন না যে, তাদের নিজস্ব কিছু দায়-দায়িত্ব-বৈশিষ্ট্য আছে? এগুলো থেকে বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে আসলে গণতন্ত্রের অনুবর্তী নিয়মনিষ্ঠ সুশাসনের সম্ভাবনাকেই ক্রমশ আঘাত করা হচ্ছে?
আমাদের দেশে বেশিরভাগ আমলা এখন ‘নব্য জমিদারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারা নিজেরাই নিজেদের নামে নানা ধরনের ‘মহত্ত্বের ছায়া’ আরোপ করে থাকেন। আমলাদের কাছ থেকে মানুষ ‘নিরপেক্ষতার নৈতিকতা’ আশা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। তারা শাসক দলের ‘চামচা’ অথবা নিজেরাই ক্ষমতাবান ‘অত্যাচারী’ হিসেবে আবির্ভূত হন।
এটা দুঃখজনক। সরকারকে আমলাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।আমলাদেরও নিজেদের ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনার সুযোগ আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, সমাজে নিজেদের ‘ব্রাক্ষ্মণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, ‘জোরের যুক্তি’ প্রতিষ্ঠা করা-এগুলো আখেরে কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না।এতে জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে। আর আদালত, আইন, পুলিশ, এমনকি ‘বিশেষ আদালত’ বসিয়েও কিন্তু জনরোষ থেকে বাঁচা যায় না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)