চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এখন সময় টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার

ফাগুনের তখন এত ঘনঘটা ছিল না। নির্ধারিত দিনক্ষণ ছিল না ভালোবাসারও। তাতে কি ফাগুন অনুভব করা যেত না? ভালোবাসা কি ছিল না? রাস্তার পাশে কৃষ্ণচুড়া যখন রাঙিয়ে দিয়েছে চারপাশ আর ভেসে এসেছে কোকিলের মধুর কণ্ঠ, তখন বুঝতে পারা গেছে ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত বরণ করা না হলেও দেহ-মনে ছুঁয়ে যেত বাসন্তী হাওয়া। তাতে বুকের মধ্যে যেন কেমন কেমন করতো। হিল্লোলিত হতো সুরেলা আমেজ। প্রাণে প্রাণে বয়ে যেত খুশির নহর। আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে না থাকলেও ভালোবাসা তো চিরকালই ছিল। আছে। থাকবে।

প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে ভালোবাসা না থাকার কোনো কারণ নেই। যুগে যুগে ফুটেছে ভালোবাসার গোলাপ। আবার না ফোটাও থেকে গেছে কত কত। ঝরে গেছে কুঁড়ি হয়ে। ভালোবাসায় কেউ সফল। কেউ ব্যর্থ। তাতে ভালোবাসার কোনো হেরফের হয় নি। যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে, তার কাছে ভালোবাসার প্রাপ্তিটা একরকম। আর যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি, তার কাছে ভালোবাসার অপ্রাপ্তিটা অন্যরকম। এই বিপরীতধর্মীতাই ভালোবাসার সৌন্দর্য। পাওয়াটাই সবটুকু নয়, না পাওয়ার মধ্যেও ছিল ভালোবাসার অন্য রকম মাধুর্য।

কিন্তু ভালোবাসার অনুভব, অনুভূতি, অনুরণন তো সব কালে, সব যুগে, সব সময়ে একই রকম ছিল। তবে ভিন্নতা প্রকাশের। ভিন্নতা আবেগের। ভিন্নতা দৃষ্টিভঙ্গির। ভালোবাসা তো আবেগেরই রূপান্তর। কতভাবেই না ছড়িয়েছে ভালোবাসার রং। কতভাবেই না ভালোবাসা ছুঁয়েছে একে অপরের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে-।’ আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন ভালোবাসার গভীরতা, তীব্রতা ও স্পন্দন ছিল অন্য মাত্রার। আবেদন ছিল অন্য রকম।

অবশ্য নিজের সময়কে অনেকের কাছেই সেরা মনে হতেই পারে। তবে এটাও ঠিক, তাতে সব কিছুতেই অতীতের একটা ধারাবাহিকতা ছিল। যুগের পর যুগ এ ধারাটাই অনেকটাই বহমান ছিল। ভালোবাসায় আড়াল, গোপনীয়তা, সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্ধ ও রহস্যময়তাই ছিল মুখ্য। এখন তো আগের সব কিছুই ভেঙেচুরে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমূল বদলে গেছে জীবনধারা। অতীতের সঙ্গে এখন কিছুই মেলে না।

তখন তো এত সহজে ভালোবাসা গড়ে ওঠতো না। দু’টি হৃদয় একীভূত হতে অনেক সময় লাগতো। ভাঙতেও। খুব সামান্যতেই ভালোবাসা হয়ে ওঠতো অসামান্য। কখনো চুড়ির একটুখানি রিনঝিন শব্দ শুনতে পেয়ে, কখনো এক পলক দেখতে পেয়ে, কখনো আয়ত চক্ষুতে মুগ্ধ হয়ে, কখনো মুক্ত ঝরানো হাসিতে অভিভূত হয়ে, কখনো একটি চিরকুট পেয়ে, কখনো একটু কথা বিনিময় হলে বুকের মধ্যে জ্বলে ওঠতো ভালোবাসার দীপাবলি। ঝগড়াঝাটি বা তিক্ততা থেকেও সূত্রপাত ঘটেছে ভালোবাসার। আসলে কার সঙ্গে কীভাবে গড়ে ওঠেছে ভালোবাসা, সেটার রকমারিতা, বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যতা ছিল অন্তহীন। কে কীভাবে, কোথায়, কখন ভালোবাসার মায়াডোরে বাঁধা পড়েছে, তা একমাত্র জানতেন প্রেমের দেবতা কিউপিড। তবে যেভাবেই যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে ওঠুক না কেন, সেটা ভালোবাসায় পরিণত হতে ঢের ঢের সময় লেগে যেত। এজন্য কত সময়, কত অনুনয়-বিনয়, কত জট-জটিলতা, কত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে এক জীবন। তবুও অধরা হয়ে থেকেছে ভালোবাসা। দীর্ঘ দীর্ঘ প্রহর কেটেছে ব্যাকুলতা নিয়ে, মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলাও হয় নি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের মতো, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি/আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি।’ এই দেখা, এই চেয়ে থাকা কিংবা মনে মনে ছবি এঁকে যাওয়াটাই ছিল ভালোবাসা।

অনেক অপেক্ষা, অনেক অস্থিরতা, অনেক দ্বিধা-দ্বন্ধ, অনেক যাতনা সয়ে বাইতে হতো ভালোবাসার তরি। সব সময় তরি তীরে ভিড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠতো না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুয়ে দুয়ে চারও হতো না। দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকেই যেত বেশি। তারপর কারো পথ হতো আলোয় ভরানো। আবার কারো পথ আঁধারে যেত ঢেকে। আঁধারে ঢেকে গেলেও ভালোবাসাটুকু একদমই উবে যেত না। না পাওয়ার সেই বেদনাটুকু বুকের মধ্যে থেকে যেত। মনের মধ্যে চিরকালীন একটা দাগ অন্তত কাটতো। পারতপক্ষে একজনকে হৃদয় দেওয়ার পর সেই হৃদয় অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা সম্ভব হতো না।

সাধারণত এক জীবনে একাধিকবার ভালোবাসা জড়ানো হয়ে ওঠতো না। এটা ছিল আবেগগত ব্যাপার। কবি জসীমউদ্দীনের কলমে ফুটে ওঠেছে এই আবেগ, ‘মন সে তো নহে কুমড়ার ফালি/যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলান যায়’। তখনকার সময়টাই ছিল এমন। হয়তো সামাজিক নিয়মে অন্য কারো সঙ্গে সংসার হয়েছে। জীবনও একরকম কেটে গেছে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিটা হারিয়ে যায় নি। বিরহের রেশও থেকে গেছে। তা সযতনেই সাজানো থাকতো হৃদয়ের সিন্ধুকে। কখনো কখনো একান্তে নিভৃতে ভালোবাসার সেই অনুভূতি, সেই যাতনা হয়ে ওঠেছে যেন মধুময় ভিনটেজ। তাতে না পাওয়ার কষ্টটুকু যেমন থাকতো, তেমনিভাবে থাকতো ফেলে আসা সেই দিনগুলোর মৌতাত। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘প্রেম কি কখনও জীবনের পিছ ছাড়ে?’ নিখাদ ভালোবাসা আদপেই ছাড়তে পারে না। আবার এর রেশ কাটিয়ে ওঠতে না পেরে অনেকের জীবন হয়ে যেত এলোমেলো।

এখন তো বদলে গেছে ভালোবাসার ধরন। অবশ্য সময় তো সব কিছুই বদলে দেয়। ভালোবাসাইবা বদলাবে না কেন? এখন তো ভার্চুয়াল জগত। বিভিন্ন মাত্রিক এক দুনিয়া। ভালোবাসাও হয়ে ওঠেছে ভার্চুয়াল। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সামান্য হেরফের হলেই সৃষ্টি হয় বিভ্রম। ভালোবাসা গড়ে ওঠতে খুব বেশি সময় নেয় না। চোখে চোখ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কথাও বলতে হয় না। জানা-শোনাও লাগে না। গভীর-গোপন অনুভূতি না থাকলেও চলে। সব কিছুই এখন ঝটপট হয়ে যায়। ইনস্ট্যান্ট নুডলসের মতো।

ভালোবাসার মাধ্যম হয়ে ওঠেছে মূলত কী বোর্ড। ফেসবুকের চটকদার ছবি দেখে কিংবা একটুখানি চ্যাটিং হলেই হয়ে যায় রিলেশনশিপ বা লভ। অন্যভাবেও প্রপোজ করা হয়। তবে প্যাটার্নটা একই। তারপর পিজ্জা, কোক আর সেলফি। তাতে ছয়লাপ হয়ে যায় ফেসবুক। তা দেখলে এক একটা যুগলের মনোভাব এমন মনে হবে, ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম/ছিলাম নদীর চরে/যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে’। কী উচ্ছ¡াস! কী উল্লাস! কী উদযাপন! অথচ কিছু দিন যাওয়ার পরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিলেশন ব্রেকআপ হতে সময় লাগে না। এমনকি সরাসরি নির্দ্বধায় মেসেজ দেওয়া হয়, ‘আই থিঙ্ক উই নিড টু ব্রেক আপ…..’। তা নিয়ে সাধারণত কারো কোনো কষ্ট বা মনোবেদনাও খুব একটা থাকে না। আর একান্তই যদি কারো একটু মন খারাপ হয়, তাহলে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়, ‘ফিলিং ব্যাড’। এটাই যেন খুবই স্বাভাবিক।

সময়টা এখন এমন, কেউ আর দেবদাস হন না। বরং অপেক্ষার তালিকায় থাকেন অন্য কোনো পার্বতী। আর মেয়েদের জন্য তো ফ্রেন্ড লিস্টের সার বেধে থাকা রোমিওরা আছেনই। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে ‘সিঙ্গেল’ সিলেক্ট করে দিলেই হলো। তারপর আঙুলের একটুখানি চাপাচাপিতে চোখের পলকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। ক’দিন যাবার পর আবার সেই পুনরাবৃত্তি। ফেসবুক ভালোবাসা গড়ে ওঠতে যেমন খুব বেশি সময় লাগে না, তেমনিভাবে দূরে সরে যেতেও সময় নেয় না। এই রিলেশনশিপ বা ব্রেক-আপ যেন একটা মামুলি ব্যাপার। উপরন্তু কার হিসেবের খাতায় কতটা ‘রিলেশন’ বা ‘ক্রাশ’ যোগ হয়, সেটাই হয়ে ওঠে বড়াই করার মতো বিষয়। কেউ কেউ ভালোবাসার অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও চাউর করে দিতে একটুও দ্বিধা করেন না। তাতে যদি ‘লাইক’ বা কমেন্টস বেশি পাওয়া যায়, সেটাও বড় একটা অর্জন মনে করা হয়।

এখন তো টেস্ট ক্রিকেটের রোমান্টিকতার কদর নেই। এটা উপভোগ করার মতো সেই ধৈর্য নেই। সেই আবেগও নেই। ওয়ান ডে ক্রিকেটের উত্তেজনাও ক্রমশ যেন মিয়মাণ হয়ে পড়ছে। সেই উত্তাপ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সেই উচ্ছাসও থিতিয়ে এসেছে। সময়টা এখন টি-টুয়েন্টির। সময় কম। ব্যাপক বিনোদন। উত্তেজনাও বেশি। মূলত জীবনের সব ক্ষেত্রেই অনুসৃত হচ্ছে এই ধারা। ভালোবাসাইবা কেন ক্রিকেটের ক্ষুদ্র এই সংস্করণকে অনুসরণ করবে না? দ্রুতই যদি সব কিছু পাওয়া যায়, চট করে ঘটে যায় সমুদয়, কে আর অপেক্ষার প্রহর গোনে? টি-টুয়েন্টির মূলমন্ত্র, হয় ছক্কা না হয় অক্কা। এই মূলমন্ত্রকে অনুসরণ করা হচ্ছে হাল আমলের ভালোবাসায়। টইটুম্বুর ভালোবাসা মুহুর্তেই নেই হয়ে যেতে একদমই সময় লাগে না। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।

এখন ফাগুন আসে বিপুলভাবে উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে। ভ্যালেনটাইন ডে আসে ভরপুর ভালোবাসা নিয়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ভার্চুয়াল লভ। সব মিলিয়ে বসন্তের টি-টুয়েন্টি জম্পেশ ককটেল। তাতে থাকে ফেনিল মদিরতা। থাকে উৎসবের আমেজ। থাকে আনন্দময় কোলাহল। রঙদার হয়ে ওঠে চারপাশ। উদ্বেলিত হয়ে ওঠে পরিপার্শ্ব। ঢেউ খেলে যায় রোমান্টিকতার। অতি সুলভে জীবনকে রাঙানোর এমন সুযোগকে কে আর হাতছাড়া করতে চায়? সঙ্গত কারণে তাতে প্রতিধ্বনিত হয় তারুণ্য আর যৌবনের উচ্ছাস, উল্লাস, উদ্দাম। তবে আমরা যারা বুকের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটের ভালোবাসার রোমান্টিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠেছি, তাদের কাছে টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার রোমাঞ্চকে ঈশপের গল্পের মতো আঙুর ফলকে টক মনে হতেই পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)