দেশে সবকিছুর দাম বেড়েছে, কমেছে শুধু মানুষের জীবনের দাম। দ্রব্যমূল্য বা যেকোনো কিছুর দামের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রায় সব মানুষের কাছেই এমন কথাই শোনা যাবে। সড়কে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ডেঙ্গু। চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি এডিস মশার কামড়ে হওয়া এই জ্বর এখন ক্রমেই মরণঘাতী হয়ে উঠছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ৫ বছর বয়সী লাবন্য।
অবশ্য শুধু লাবন্য নয়, লাবন্যের পথ ধরে এর আগেও অনেকে মারা গেছেন। এরমধ্যে একজন চিকিৎসকও রয়েছেন। তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে এই রোগে ১০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি।
এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তার সন্তান সাকিব আল হাসানের কথাই ধরা যাক। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই হাসপাতালে ডেঙ্গুর সাথে লড়াই করছেন। অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। এমনই হাজারও মানুষ প্রতিনিয়ত হাসপাতালের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। সরকারি হিসাবে, গত তিন মাসে এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি।
এখন প্রশ্ন করা যায়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে মরতে হবে কেন? মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে কেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে? একটা সময় দেশ যখন পিছিয়ে ছিল, তখন কলেরা এবং মহামারীতে বিনা প্রতিরোধ কিংবা চিকিৎসার অভাবে লাখ লাখ মানুষ মরেছে। কিন্তু এখনও এমনটা হবে কেন? এর দায় কার? সাধারণ মানুষকে মরণঘাতী এই মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার?
এসব প্রশ্ন আসলে করার কথা ছিল না। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অর্থাৎ এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতো, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন এই পর্যায়ে পৌঁছাতো না। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ কর দিচ্ছে কিন্তু তার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। এর ফলে এখন এমন একটা কারণে মানুষ মারা যচ্ছে, যে বিষয়টা চাইলে একেবারে নির্মূল সম্ভব। ঠিকমতো মশা মারলে, মশার উৎপাদনস্থল ধ্বংস করে দিলে, অর্থাৎ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে এভাবে মা-বাবার কোল খালি হতো না। বাবা-মাকে হারিয়ে এতিম হতো না কোনো শিশু। কিংবা দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না ভুক্তভোগীদের।
ডেঙ্গু নিয়ে সাধারণ মানুষ কতোটা অতিষ্ঠ একটি ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ১১ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। কারণ একটাই। আর তা হলো ডেঙ্গুর প্রকোপ। লিগ্যাল নোটিশে এই আইনজীবী উল্লেখ করেন, ‘২৯ জুন আমার স্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর পাঁচ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। যেহেতু এডিস মশা নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরোপুরি ব্যর্থ, তাই এর দায়ভার তাদের (মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) নিতে হবে। এ কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে এই নোটিশ পাঠানো হলো।’ ওই নোটিশে তিনি মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে।
মেয়র সাঈদ খোকন অবশ্য এতে অখুশি হননি। তিনিও মনে করেছেন, এটা আসলে তারই কাজ। সেই দায়িত্ব তিনি আসলে ঠিকমতো পালন করতে পারেননি। তাই তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে দেখতে ফলমূল নিয়ে ওই আইনজীবীর বাসায় গিয়েছেন, ডেঙ্গু নিধনে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ কারণে তিনি অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারেন।
তবে এসব যেন কথার কথা বা লোক দেখানো বিষয় না হয়। কারণ ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন আরও বেড়েছে। এটা আরও পরিষ্কার হয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদের কথায়। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন: ‘২০০০ সালে এই শহরে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এখন দিনে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন ডেঙ্গুর রোগী ভর্তি হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে। এত রোগী কখনো ভর্তি হতে দেখিনি।’ তার এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, ডেঙ্গু এখন কোন পর্যায়ে আছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী ডেঙ্গুর আক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার কোনো আয়োজন আছে কি? না, এমনটা দেখা যাচ্ছে না।
কথায় আছে, নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না। অর্থাৎ আগুনে দেবালয়ও পুড়ে। ডেঙ্গুর বিষয়েও এ কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপে যে শুধু সাধারণ মানুষ মারা গেছেন, তা নয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট ঘোষণার কয়েক দিন আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন বলে তিনি নিজে জানিয়েছেন। এ কারণে তিনি বাজেট বক্তৃতা সম্পন্ন করতে পারেননি।
শুধু অর্থমন্ত্রী যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাও নয়। টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। এমন আরও অনেকেই আছেন। এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য হচ্ছে- তারা উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেন, কিন্তু সবার এই সামর্থ্য নেই। যাদের নেই, তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন। এর মধ্যে অনেকেই সাধারণ চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। আবার বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যে দিকে যাবে, সেদিকেই তার সামনে মৃত্যু হাজির হচ্ছে।
এখন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এই প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই বলা যায়, যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। যথাযথভাবে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর নিজের কাজটা ঠিকমতো করলে জনগণকে এই ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। যেহেতু এখন ডেঙ্গুর প্রবল মৌসুম তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর কেন হয়, এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে এডিস মশার প্রজননস্থল জমে থাকা পানি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
এছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ আক্রান্ত সব এলাকার এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশের সব হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সুচিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অনুগ্রহ করে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচান। করের বিনিময়ে মানুষ কি আপনাদের কাছে এসব সেবা চাইতে পারে না? নাকি জনপ্রতিনিধিদের কাছে এটা খুব বড় চাওয়া হয়ে যায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)