রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ১৬ থেকে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে আর্জেন্টিনা। ১৯৮৬ সালে ডিয়াগো ম্যারাডোনার চমকপ্রদ নৈপূণ্যে বিশ্বকাপ জয়ের পরে আর বিশ্বকাপ জেতা হয়নি আর্জেন্টিনার। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে কোটি আর্জেন্টাইন ভক্তদের ‘আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়’ দেখার আকাঙ্খা লিওনেল মেসির জাদুতে পূরণ হবে, এমনটাই আশা করা হচ্ছিল। তবে সেই আশাতেও গুড়েবালি!
এর মধ্য দিয়ে আবার প্রশ্নও উঠেছে, ৩১ বছর বয়সী লিওনেল মেসির কি এটাই শেষ বিশ্বকাপ? যদিও তিনি যে ফর্মে আছেন, তাতে করে ৩৫ বছর বয়সে আরেকটি বিশ্বকাপ খেলা অসম্ভব নয়। তবে বিশ্বকাপ জয়ের জন্য সেই ফর্ম যথেষ্ট কিনা, তা সময় বলে দিতে পারে।
আর্জেন্টিনা দলসহ সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের জন্য লিওনেল মেসি একজন ফুটবলারের বাইরেও অনেককিছু। ম্যারাডোনার পরে তিনি একমাত্র খেলোয়াড় যার ক্রিড়া দক্ষতা ও নামের কারণে সাদা-নীলের পতাকার ভক্ত অনেকে।
১৯৮৭ সালে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্ম নেয়া ওই বিরল প্রতিভার ফুটবলারের শৈশব মোটেও মসৃণ ছিল না। বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক আর মা একজন পার্ট-টাইম ক্লিনারের কাজ করে সংসার টানছিলেন। এরপরেও ছেলেবেলা থেকেই মেসির ফুটবল আগ্রহের কারণে পরিবার তাকে স্থানীয় বয়সভিত্তিক ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেয়।
সেখানেও দেখা দেয় নানা বিপত্তি, ১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোন সমস্যায় হুমকির মুখে পড়ে তার ফুটবল স্বপ্ন। তবে সেই বয়সে তার ফুটবল প্রতিভার ঝলক অনেক ক্লাবের নজরে আসে। কিন্তু প্রতি মাসে ৯০০ ডলার খরচের ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে ক্লাবগুলো অনাগ্রহ দেখাতে থাকে মেসিকে নিয়ে। সেসময় এগিয়ে আসেন স্পেনের ফুটবল জায়ান্ট ক্লাব বার্সেলোনার সেসময়ের স্পোর্টিং ডিরেক্টর চার্লস রেক্সাস। মেসির চিকিৎসার দায়িত্বভারসহ বার্সেলোনার যুব একাডেমিতে থাকার সুযোগ পান মেসি। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মেসিকে। ফুটবল জাদু ছড়িয়ে গেছেন বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব ফুটবলের এখন অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড ‘লিওনেল মেসি’।
ক্লাব পর্যায়ের এমনকোনো শিরোপা নেই যা মেসির হাতে ওঠেনি। ফুটবল বিশ্বের নামকরা প্রায় সব পুরষ্কার তার ঝুলিতে, শুধুমাত্র বিশ্বকাপ ফুটবলে নেই কোনো সাফল্য। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা জার্মানির কাছে পরাজিত হলে হতাশা ভর করে তার জন্য। বিশ্বকাপে মেসির জন্য এটাকে সর্বশেষ সুযোগ বলে ধরা হয়ে থাকে।
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা নিয়েই ছিল আর্জেন্টিনার শঙ্কা, সেখানেও মেসির নৈপূণ্যে সেযাত্রা উৎরে রাশিয়ার টিকেট পায় আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যাশার চাপ নিয়ে তারা রাশিয়া আসলেও আর্জেন্টিনা যে এবারের বিশ্বকাপ থেকে ভাল কিছু করতে পারবে না, তা ম্যারাডোনাসহ মেসি স্বয়ং বলেছেন বিশ্বকাপ শুরুর আগে। মেসির ওই কথাকে অনেকে তার বিনয় বলে উল্লেখ করলেও তা যে ওই ফুটবল জাদুকরের অভিজ্ঞতার বয়ান ছিল, তা বিশ্ব এখন বুঝতে পারছে।
তাছাড়া রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা আর্জেন্টিনা দলে শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বজনিত সমস্যার কথাও গণমাধ্যমে এসেছে বিশ্বকাপ শুরুর আগে ও চলাকালীন সময়ে। আর্জেন্টাইন কোচ কোচ হোর্হে সাম্পাওলি দল পরিচালনা করতে পারছেন না, নানারকম পরীক্ষা করছেন দলের ফরমেশনে, মেসির সঙ্গে তার সর্ম্পক খারাপ, সাম্পাওলি না মেসিই গোপনে কোচের দায়িত্ব পালন করছেন..এরকম নানা খবর ছিল গত কয়েকমাস ধরেই।
বিষয়গুলো আরো জোরালো হতে থাকে প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র এবং ক্রোশিয়ার সঙ্গে ৩-০ গোলের লজ্জার হারের পরে। তবে নাইজেরিরার সঙ্গে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কিছুটা উন্নতি দেখা যায়, যা আসলে ছিল আর্জেন্টিনার জন্য সামনের পর্বে যাবার বাঁচা-মরার লড়াই। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার কোচকে অনেকটা নীরব দেখা যায়, আর মেসিকে দেখা যায় অন্য ভূমিকায়। ম্যাচে প্রথম (এই বিশ্বকাপে তার একমাত্র গোল) গোল করে দলকে এগিয়ে নেন, এছাড়া সেকেন্ড হাফে মাঠে নামার টানেলের মুখে মেসিকে দেখা যায় মোটিভেশনাল ভূমিকায়। এছাড়া মাঠে কোন খেলোয়াড়কে নামানো হবে, সে বিষয়ে কোচকে মেসির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।
এছাড়া দলের অন্যতম তরুণ ফুটবলার পাওলো দিবালা যাকে দেখা হচ্ছিল এ প্রজন্মের অন্যতম প্রতিভা হিসেবে, মেসির সঙ্গে তার রসায়ন তেমন একটা উল্লেখ করার মতো না বলেই সে পুরো রাশিয়া বিশ্বকাপে মাত্র ২২ মিনিট সুযোগ পেয়েছে বলেও সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ফ্রান্সের টিনএজ ফুটবলার এমবাপে যখন সুযোগ পেয়ে বিশ্ব আলোচনায়, তখন দিবালাকে বসে থাকতে হয়েছে মাঠের বাইরে। ইকার্দির দলে জায়গা না হবার বিষয়েও মেসিকে দায়ি করেন অনেকে। নেতিবাচক বা ইতিবাচক যাই বলি না কেনো সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপে মেসিকেই দেখা গেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়।
পাঠক হয়তো ভাবছেন, এই যখন অবস্থা তাহলে এরকম শিরোনামে কেনো লিখলাম? এই অবস্থায় কীভাবে বিশ্বকাপ জয় করবেন মেসি? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমার কাছে নেই। স্বয়ং মেসিও হয়তো জানেন না। তবে লিওনেল মেসির মতো ফুটবলার বিশ্বে একটি বিরল প্রতিভা, সেই দিকে চিন্তা করলে আগামী কাতার বিশ্বকাপে (২০২২ সালে) মেসিকে শেষবারের মতো দেশের হয়ে লড়ে বিশ্বকাপ জয় অসম্ভব না। আরেকটি আঙ্গিকে মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখার আশা করতেই পারে কোটি কোটি আর্জেন্টাইন ফ্যান, তা হচ্ছে ভবিষ্যতে মেসি যদি ম্যারাডোনার মতো কখনও কোচিং পেশায় আসেন তাহলেও সুযোগ থাকছে। তবে শুধু ভক্ত-দর্শকদের চাহিদা আর আশার উপরেতো বিশ্বকাপ জয় হবে না আর্জেন্টিনার! মেসির নেতৃত্বগুণ আর দক্ষতার আলো তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে সঠিকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে, দলের সঙ্গে খেলোয়াড় বা কোচ হিসেবে থেকে ব্যালেন্সড একটি দল গঠন করলেই হয়তো মেসি বা মেসির দেশ ভবিষ্যতে পেতে পারে কাঙ্খিত বিশ্বকাপ ট্রফি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)