ছোটবেলায় বাবা-মা আর ভাই-বোনদের সাথে আমি থাকতাম হিরোশিমার কাছের ছোট্ট একটা মফস্বল শহর সাক্কাতে। আমাদের বাড়িটা ছিলো সমুদ্রের একেবারে কাছে। সৈকতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। ভালো লাগতো বাগান থেকে ফুল তুলতে আর গ্রামময় ঘুরে বেড়াতে। কখনো আবার আমি উঠে যেতাম গাছের মগডালে, যেন সাগরের পানিতে রোদের ঝিকিমিকি মন ভরে দেখতে পারি।হিতোশি, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, গাছের নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করতো।
সেখানে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প করতাম, ভাবতাম বড় হয়ে আমরা কে কী করবো, কী হবো।হিতোশিকে আমার খুব ভালো লাগতো। তাই হিতোশি যখন বললো বড় হয়ে ও লেখক হতে চায়, আমি বললাম, ‘আমি তাহলে কবি হবো’।৬ অাগস্ট। সেদিনের সকালটা ছিলো আর দশটা সকালের মতোই। স্পষ্ট মনে আছে, মা ঘরে ছিলো; আর আমি নাস্তা করে তৈরি হচ্ছিলাম কাজে যাওয়ার জন্য। হিরোশিমায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে কাজ করতাম আমি। বয়স মাত্র চোদ্দ, তবুও চাকরি করতাম। বেশিরভাগ ছেলেই তখন যুদ্ধে গিয়েছে, সবখানে লোকবলের অভাব। তাই আমার মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
আমি চারতলার একটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র এক আলোর ঝলকানিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। মনে হলো যেন আমার চোখের সামনে সূর্যটা আকাশ থেকে খসে পড়েছে! সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ জুড়ে চারদিকে শুধু রংধনু খেলা করতে দেখলাম। সেটা আর কিছু ছিলো না, ছিলো এক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ।
নিশ্চয়ই আমার জ্ঞান ছিলো না। কারণ এরপর যখন চোখ মেললাম, দেখলাম আমি আর জানালার কাছে নেই। টের পেলাম আমার মাথায় আঘাত লেগেছে। কীভাবে জানি না, আমি উঠলাম, নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম বাইরে। একজন মহিলা আমাকে হাসপাতালে যেতে সাহায্য করলেন। আশপাশে তাকিয়ে আমার সেই চিরচেনা শহরকে দেখতে পেলাম না। শহর আর শহর নেই। কোন বিল্ডিং নেই, নেই একটা কুকুর বা বিড়ালও। আকাশে উড়ছে না কোন পাখি বা প্রজাপতি। সব শেষ হয়ে গেছে। শুধু আছে কিছু মানুষ, আহত, গায়ে ছাই আর কালিঝুলি মাখা। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠেই মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম আমার শহরে। তখনও সবখানে শুধু আগুন আর আগুন। সাবধানে এগিয়ে গেলাম আমার বাড়ির দিকে, বা যেখানে আমার বাড়িটা ছিলো। কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেলাম তিনজন মানুষ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ‘এটা কি সত্যিই তুমি??’ প্রশ্ন করলো একজন। মানুষটি আমার মা। তার সাথে ছিলো আমার বড় বোন আর আমার ফুপু। আমার ভাইটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। বিস্ফোরণের আঘাতে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। সবকিছু মনে হচ্ছিলো এক বিশাল দুঃস্বপ্নের অংশ। বুঝতেই পারছিলাম না ঠিক কী হচ্ছে।
বিশ বছর বয়সে আমি হিরোশিমা ছেড়ে চলে আসি। বহু বছর আমি হিরোশিমার ঘটনা নিয়ে কিছু বলতেই পারতাম না। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে বোঝালো, যেন আমি আমার কাহিনী সবাইকে বলি। একসময় আমি কবিতা লিখতে শুরু করলাম। ছোটবেলায় হিতোশিকে বলেছিলাম আমি কবি হবো। কখনো ভাবিনি তা বাস্তবে রূপ নেবে।
পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় তীব্র মাথাব্যাথা, ক্লান্তিসহ আমার নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে থাকে। তবে টোকিওর ডাক্তাররা নিয়মিত আমার চিকিৎসা করতেন। একসময় আমি বিয়ে করলাম। আমার তিনটা ছেলে হলো। এখন আমার চারজন নাতি-নাতনিও আছে। আমি তাদের কাছে আমার জীবনের কাহিনী সবসময় বলি।
এতকিছুর পরও যারা আমাদের শহরে বোমা ফেলেছিলো, তাদের আমি ঘৃণা করি না। তাদের কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সব হারানোর পর মানুষ কতোটা অসাধারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি কখনো এটাও ভুলবো না যে, মানুষই মানুষের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলেছিলো।”
এই ছিলো ৮৪ বছর বয়সী বুন হাশিজুমে’র আত্মকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ বিস্ফোরিত হয়। তখন বুনের বয়স ছিলো মাত্র ১৪ বছর। নিজের অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন বিবিসি’র কাছে।