অনেক সময়ই অযোগ্যর হাতে চেয়ার চলে গেলেও শেষ পর্যন্ত যোগ্যতারই জয় হয়। তৃণমূলের নির্বাচনে সারাদেশের আড়ালে থাকা এমন শরীফ আর এখলাসরাই জয়ী হোক। পাঁচ বছর আগেও রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সরকারের নির্দলীয় নির্বাচনগুলোতে কখনো ছায়া কখনো আবছায়া হিসেবে পাশে থাকতো। এবার আইন বদল করে আপাদমস্তক পুরোপুরি দলীয় ঝাণ্ডা তুলে দিয়েই মাঠে প্রান্তরের নির্বাচনে শুরু হয়ে গেছে দলীয় প্রতীক যুদ্ধ।
তবে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে দলের টিকেট পেতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ আর ধানের শীষের প্রার্থীদের। নৌকা কিংবা ধানের শীষ পাওয়াটা এতো সহজ গল্প না যতোটা দূরে বসে দেখা কিংবা অনুমান করা যায়। যেদিন থেকে আইন পাল্টে গেলো সেদিন থেকেই মাঠের রাজনীতিতে ভর করলো ক্ষমতা আর টাকার দাপট। কারণ একটাই: দলের টিকেট চাই। এই টাকা, ক্ষমতা আর লবিং এর জোর খাটাতে কিংবা দেখাতে চটির তলা খসাচ্ছেন অনেকেই। তৃণমূলের আজন্ম ত্যাগী নেতাদের ত্যাগের পাল্লাই ভারীর দিকে।
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া-নেয়ার প্রক্রিয়া জাতীয় নির্বাচনকেও হার মানাচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে পথে প্রান্তরের ভুক্তভোগী প্রার্থীরা দলের টিকেট না পেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দিকে অভিযোগ অথবা আক্ষেপের আঙ্গুল উঠাচ্ছেন না। বরং তারা বলছেন, দলের সুবিধাবাদী অসাধু নেতাদের কারণেই মনোনয়ন দেয়ার ঘটনা নেত্রীদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। তাদের বিশ্বাস দলের শীর্ষ নেত্রীরা এমন খবর পেলে ঠিকই বদলে যেতো তৃণমূলের টিকেট নিয়ে অনিয়মের বাণিজ্য।
সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে পাওয়া না পাওয়ার গল্প সবখানে প্রায় একইরকম হলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশের এমনও অনেক জায়গার বহু গল্প আছে যেখানে জয় হয়েছে সত্য আর ত্যাগের। সব চিত্র হয়তো সবসময় নাগালে আসে না। তবে এর মধ্য থেকেই দুয়েকটা চিত্র খুঁজে পেলে আশা জাগে: হয়তো আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে এমন গল্প যা নজরের বাইরে থাকে মানুষ আর গণমাধ্যমের।
অনেক ঘুরে ফিরে অনেক অনিয়মের দেখা পেলেও এই গল্পটি নিয়মের।
জায়গার নাম মহেশখালী। সাগর জনপদ কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী উপজেলা মহেশখালীর বাঁকে বাঁকে এখন নির্বাচনী হুল্লোড়। নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে অসন্তোষ-অস্বস্তি আর ক্ষোভ কেটে স্বস্তির হাওয়া। যেখানকার ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ ছিলো সেটি হলো মহেশখালী উপজেলার এক ইউনিয়ন, নাম কালারমারছড়া।
ক্ষোভ কাটার কারণ: বহু ত্যাগ তিতীক্ষার পর কক্সবাজার জেলার প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফ চেয়ারম্যানের নাতি তারেক বিন ওসমান শরীফের নৌকা প্রতীক ফিরে পাবার আনন্দ। মনোননয়ন বাণিজ্যের চক্করে আর জেলা আওয়ামী লীগের ফন্দি ফিকিরের কারণে শহীদ পরিবারের হাত থেকে ফসকে নৌকা চলে গিয়েছিলো এলাকার কুখ্যাত রাজাকার পরিবারের সেলিম চৌধুরী হাতে। যে সেলিম চৌধুরীর পরিচয় একাধারে রাজাকারের সন্তান ও বসন্তের কোকিলরূপী আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে।
নিরুপায় শহীদ শরীফ পরিবারের হাতে নৌকা ফিরিয়ে দিতে লড়াই চালিয়ে যায় মহেশখালী থানা আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে সব আশা ভরসা যখন ডুবতে বসে সেসময় সাহস করে শহীদ পরিবার সব ঘটনা জানিয়ে দেখা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তারা খুলে বলেন সব কথা, প্রধানমন্ত্রী সব জেনে-শুনে রাজাকার পরিবারের হাত থেকে সম্মানের নৌকা ফিরিয়ে দেন শহীদ পরিবারের কাছে।
২৯ বছরের তরুণ তারেক বিন ওসমান শরীফ নৌকা হাতে পেয়ে এখন হাট বাজারে আর মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট চাইছেন নৌকাকে জিতিয়ে দিতে। তবে একই ইউনিয়নে যে আরও একটি চমক অপেক্ষা করছিলো সেটিও আরেক বড় বিস্ময়। এ ঘটনার নায়ক কালারমারছড়া ইউনিয়নের ৬২ বছরের এখলাসুর রহমান। এই মানুষটি শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আদর্শ নিয়ে পথে ঘাটে জীবন পার করে দিয়েছেন।
শেষ বয়সে এসে এখলাসুর ধরেই নিয়েছিলেন যে দল তাকে আর কোনোদিন মূল্যায়ন করবে না। ত্যাগের রাজনীতিতে উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি পদটা নিয়ে নানা স্বপ্নভঙ্গের মধ্য দিয়ে রাজনীতির জীবন পার করছিলেন। কিন্তু শেষ সময়ে এসে সব ষড়যন্ত্রকে পেছনে ফেলে এতোদিন পর দল তাকে মূল্যায়ন করায় কৃতজ্ঞ এখলাসুর রহমান। বিএনপির টিকেট পেয়ে এখন তিনিও মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউপিতে ধানের শীষের পক্ষে মানুষ টানতে কেবলি ছুটে বেড়াচ্ছেন মানুষের দ্বারে।
চেয়ারের গল্পগুলোতে অনেক সময়ই অযোগ্যর হাতে চেয়ার চলে গেলেও এমন দুয়েকটা ঘটনার জের ধরেই চেয়ারের গল্পে শেষ পর্যন্ত যোগ্যতারই জয় হয়। ২২ মার্চ শুরু হতে যাওয়া তৃণমূলের নির্বাচনে সারাদেশের আড়ালে থাকা এমন শরীফ আর এখলাসরাই জয়ী হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)