মহান আল্লাহ তাআলা ‘আকমালতু লাকুম দ্বী-নুকুম’ বলে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
সেই হিসেবে ইসলাম কেবলই ধর্ম নয়; বরঞ্চ পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আর জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতায় পূর্ণ। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, “এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই” (তিরমিজি-১৯২৭)।
ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের ওপর পিতামাতা থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সকলের প্রতি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। সেই ধারা অনুযায়ী এক মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অপর মুসলমানেরও বেশকিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের রয়েছে নানাবিধ কর্তব্য। মানবতার ধর্ম ইসলামে মানবতার উৎকৃষ্ট নজির নিচের হাদিস শরিফটি।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের ছয়টি কর্তব্য রয়েছে।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সেই কর্তব্যগুলো কী কী?
তিনি বললেন,
(১) তার সাথে তোমার সাক্ষাত হলে সালাম দিবে।
(২) সে তোমাকে দাওয়াত করলে তার দাওয়াত গ্রহণ করবে।
(৩) সে তোমার কাছে পরামর্শ চাইলে তুমি তাকে পরামর্শ দিবে।
(৪) সে হাঁচি দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলে তুমি তার জবাব দিবে।
(৫) সে অসুস্থ হলে তুমি তাকে দেখতে যাবে।
(৬) সে মারা গেলে তুমি তার জানাযায় ও দাফনে অংশগ্রহণ করবে।” (বুখারি ও মুসলিম)।
উল্লিখিত হাদিসের মর্মবাণী হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমান অন্য মুসলমান ভাইয়ের সাক্ষাতে তার সাথে সালাম বিনিময় করতে হবে। পরস্পর কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে সুখ-দুঃখের খবরা খবরা নিতে হবে। অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যেতে হবে।
প্রয়োজনে সেবাশুশ্রূষার নজিরও রয়েছে মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম জীবনাদর্শে। দাওয়াত করলে অযথা ব্যস্ততা না-দেখিয়ে তা সাদরে গ্রহণ করাও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কোনো বিশেষ কাজে যদি কেউ পরামর্শ চায় তবে তাকে সাধ্য অনুযায়ী উত্তম পরামর্শ দিতে হবে।
হাঁচি দেওয়ার পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলে মহান আল্লাহর কাছে তার জন্য দুআ করতে হবে। আর যদি কোনো মুসলমান ভাই মারা যায়, তবে তার জানাযায় শরিক হয়ে তার জন্য দুআ করা এবং তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা মুসলিম হিসেবে অপর মুসলিমের প্রতি কর্তব্য।
উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও আরো বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব ও অধিকারের কথা বিভিন্ন হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। সহিহ মুসলিম শরিফের বর্ণনা, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের করণীয় বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার সাথে কোনরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তার প্রসঙ্গে মিথ্যা বলবে না। তাকে অপমান করবে না।
প্রত্যেক মুসলমানের মান-সম্মান, ধন-সম্পদ ও রক্তের (জীবনের) উপর হস্তক্ষেপ করা অপর মুসলমানের উপর হারাম। তাকওয়া এখানে (আঙুল দিয়ে ইশারা করে অন্তরের দিকে দেখিয়ে দিলেন)। কেউ মন্দ বলে প্রমাণিত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার অপর মুসলিম ভাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।”
বুখারি শরিফের এক বর্ণনায় দেখা যায় নবীজি মুসলমান ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপনকারীর ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে হাদিসটি বর্ণিত। নবীজি বলেছেন, “মুসলমান মুসলমানের ভাই। তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করে দেবেন। যে কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (সহিহ বুখারি-২৪৪২)
আবু হুরায়রা রা. থেকে প্রায় একই ধরনের অপর বর্ণনার দারুণ সব প্রতিদানের কথা উঠে এসেছে। নবীজি ইরশাদ করেছেন, “যে লোক কোন মুসলমানের দুনিয়াবী বিপদাপদের মধ্যে একটি বিপদও দূর করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার পরকালের বিপদাপদের কোন একটি বিপদ দূর করে দেবেন।
যে লোক দুনিয়াতে অন্য কারো অভাব দূর করে দেয়, তার দুনিয়া ও আখিরাতের অসুবিধাগুলোকে আল্লাহ তাআলা সহজ করে দিবেন। যে লোক দুনিয়ায় কোনো মুসলমানের দোষক্রটিকে গোপন রাখে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষক্রটি গোপন রাখবেন। যে পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকে, সে পর্যন্ত আল্লাহ তাআলাও তাঁকে সহযোগিতা করে থাকেন।” (তিরমিজি-১৯৩০)
মোটকথা, মুসলমানের প্রতি মুসলমানদের অনেকগুলো নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী এ কথাও স্পষ্ট হয়েছে যে, দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করলে দুনিয়া ও আখেরাতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল পুরস্কার রয়েছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আলোচ্য বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে এ সমস্ত বিষয়ের মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় থাকে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো ইসলামী অনুশাসন মেনে পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ও সর্বোচ্চ সদ্ভাব রক্ষা করে চলা।