তার নাম সেতাফুল ইসলাম। কিশোরগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি প্রায় ১৪ কোটি টাকা বস্তায় ভরে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যান। বিষয়টি জানজানি হলে তার নামে মামলা হয়। গত ১৭ জানুয়ারি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।
অত্যন্ত কামেল ব্যক্তি এই সেতাফুল ইসলাম। তিনি বদলি-প্রমোশন সব ঠেকিয়ে দিতে পারতেন। গত ১৯ অক্টোবর শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তদবির করে পদোন্নতি বাতিল করান। পরে তার পছন্দের পদ ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে তাকে পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এই বদলির পরই তিনি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সেতাফুল ইসলামের আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ নাকি অর্ধশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে!
সরকারি হিসেব থেকে নিজের হাতে চেক নিজ নামে লিখে হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে পাস করিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়াকে ঘুষ গ্রহণ না বলে চুরি বা ডাকাতি বলে আখ্যায়িত করাই উত্তম। আইনের ভাষায় হয়তো এটা হবে সরকারি টাকা আত্মসাৎ। আত্মসাতের অনেক রকম ফের আছে। তবে বর্ণিত ঘটনাটি অনেকটা অভিনব, অন্যদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জকও বলা যায়!
নিজ নামে এই কর্মকর্তা এত টাকা তুলে নিচ্ছেন, এতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ ও আপত্তি থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সবই ঠিকঠাক চলল। শেষাবধি ১০ কোটি টাকার চেকটি আটকে যায়। আর তিনিও সটকে পড়েন। অনেক বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি দেশে হচ্ছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক উজাড় করে টাকা দেওয়া হচ্ছে ঋণের নামে। বেসরকারি মালিকানার কোনো কোনো ব্যাংকও যোগ দিয়েছে সেই কাতারে। তবে জেলা প্রশাসনে এ ধরনের আত্মসাতের ঘটনা বিরল। বাংলাদেশ সত্যিই এগোচ্ছে!
দেশে ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট যে কী ভয়ঙ্কর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তার সামান্য নমুনা হয়তো এই ঘটনা। একজন জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তা সরকারি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা বস্তায় ভরে পালিয়ে যায়, অথচ ব্যাংক কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্ন করেন না, কেউ কিছু জানতে পারেন না-এটা সত্যিই বিস্ময়কর।
এ ঘটনায় একটি প্রশ্ন মনে জাগছে, তা হলো, একজন মানুষের কত টাকা প্রয়োজন? এক বস্তা? দুই বস্তা, দশ বস্তা?
আজ থেকে বহু বছর আগে বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান রিকয়্যার’ শীর্ষক এক প্রসিদ্ধ গল্প লিখেছিলেন। গল্পটি এ রকম, একদিন এক দরিদ্র মানুষ এসে রাশিয়ার সম্রাটের কাছে বললেন, তার কোনো জমিজমা বা খেটে খাওয়ার মতো কোনো সম্পদ নেই। তিনি চলতে পারছেন না। তখন সম্রাট তাকে বিশাল এক প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে বললেন, সামনে যা জমি আছে, সব আমার। তুমি এই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড় দিয়ে যতটুকু জমির চারধারে ঘুরে আসতে পারবে, ঠিক ততটুকু জমি তোমার হবে।
দরিদ্র মানুষটি অমনি দৌড় শুরু করল। যতদূর যাবে, সে তত জমির মালিক হবে। তার অনেক অনেক জমি চাই। সে দৌড়োচ্ছে আর ভাবছে, আর একটু, আর একটু। আর একটু হলে বেশি চাষাবাদের জমি পাওয়া যাবে, অন্যকে বর্গা দিয়ে নিজে বসে খেতে পারবে। তারপর আবারও একটু দৌড় দিয়ে ভাবে, আরও একটু বেশি জমি থাকলে বাড়িটা পাকা করা যাবে, সম্রাট তো বলেছে, যতোটুকু জমি সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়ে সীমানা দিয়ে ঘুরে আসতে পারবো, ততটুকুই আমার। ওঃ বড্ড ক্লান্ত হয়েছি। একটু জিড়িয়ে নিই। সামান্য জিড়িয়ে নেবার পরই সে ভাবে আজ আমার বিরতি নেবার দিন নয়, আজ আমার বিজয়ের দিন, যতোটা খাটবো, ততটা পাবো, সুতরাং দে দৌড়, আজ কোনো বিরতি নেই। সে দৌড়িয়েই চলছে। দৌড় দিয়ে সে জমিগুলোর অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে সম্রাটের রাজ্য দেখাই যায় না। এদিকে সূর্য্য প্রায় ডুবু ডুবু। এখন তার ফিরবার পালা। সে ডান দিকে ঘুরে একটি আয়তক্ষেত্র আঁকবার চেষ্টা করল। সূর্য পশ্চিমে আরো হেলে পড়েছে। এবার তার ফিরতে হবে। সে দৌড় দিল। সূর্য ক্রমাগত পশ্চিমে নেমেই আসছে। সে আরো দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে, তার আর সময় নেই, তাকে সম্রাটের প্রাসাদের সীমানায় যেতে হবে। সে আরো জোরে দৌড়োচ্ছে। কিন্ত লোকটি সীমানা প্রাচীরের কাছে এসেই আর টিকে থাকতে পারল না। দড়াম করে পড়ে গেল! বুকের ভেতর থেকে শেষ বাতাসটুকু বেরিয়ে গেল। লোকটি মারা গেল। কিন্তু কি পেল সে? এখানেই পাঠকরা লেখক টলস্টয়কে বলে ঋষী লেখক।
আর ঋষী লেখক টলস্টয় তার এ লেখার মধ্য দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, একজন মানুষের প্রকৃতপক্ষে কতটুকু জমি প্রয়োজন?
উল্লিখিত গল্পটি আমরা শিক্ষিত মানুষরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু না, আমরা কারও কাছ থেকে কিছু শিখিনি। শিখেছি কেবল মেরে দেবার, আত্মসাৎ করবার শিক্ষা। যার সুযোগ যত বেশি, সে এখানে তত বড় চোর। আমাদের সবখানে ঘুষ লাগে। দুর্নীতি ছাড়া আমাদের প্রশাসন অচল। সমাজ-সংসার সব অচল। আমরা মুখে বড় বড় বুলি উচ্চারণ করি। কিন্তু বাস্তব জীবনে একেকজন অসততার প্রতিমূর্তি। যে যেভাবে পারছি, মেরে, কেটে, আত্মসাৎ করে কেবল ধনসম্পত্তি বাড়ানোর ধান্দা করছি। যে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি অত্যন্ত ডাটের সঙ্গে জীবন চালায়, আমরা তার অর্থের উৎস কখনও জিজ্ঞেস করি না। যে কর্মকর্তার স্ত্রী দামি শাড়ি-গয়না পরে, সন্তানদের বিলাসী জীবনে তামিল দেয়, সে নিজেও কখনও এই বিলাসের উৎস জিজ্ঞেস করে না। আমরা দামি বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমির মালিক হই। কিন্তু আয়ের উৎস প্রকাশ করি না। তার দরকারও হয় না! আমাদের ফুটানি চলে অবৈধ আয়ে। কিন্তু এসবের কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের দেশে দামি রেস্তোঁরায় কারা যায়? কারা দামি গাড়ি ব্যবহার করে? কারা দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়, কাদের সন্তানরা দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে? কারা কারণে-অকারণে বিদেশ সফর করে? কারা নামে-বেনামে ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক হয়? কারা বিদেশে টাকা পাচার করে? বিদেশে জমির মালিক হয়? তাদের আয়ের উৎস কী? টাকা কোত্থেকে আসে? কে কতটাকা ট্যাক্স দেয়? এসব ব্যাপারে আমরা ভীষণ উদার। আমাদের সরকার বাহাদুর আরও উদার। যারা নানা ফিকিরে অবৈধ টাকায় ‘করে-কম্মে’ খাচ্ছেন, সরকার তাদের টুটি টিপে ধরা তো দূরের কথা পারলে ন্যাপকিন টিসু এগিয়ে দেয়! মাঝে-মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু মুখস্ত বুলি আওড়ান বটে, কিন্তু তা যেন বলার জন্যই বলা। এই বুলিতেই তাদের দায়িত্ব শেষ। তারপর তারা নিজেরাই ভেড়ার পালে গা ভাসিয়ে দেন। আমাদের একটা দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। এই কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কী করে আল্লাহ মালুম।
আমাদের দেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের বৃদ্ধিতে যে বস্তুটি সার হিসেবে কাজ করেছে, তার নাম লোভ। দুই অক্ষরের এই শব্দটি বাংলাদেশের মানুষকে গ্রাস করতে উদ্যত। আমাদের সম্মিলিত লোভাগ্নির কাছে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ সব আজ জ্বলে-পুড়ে ছাই। পাওয়া আর পাইয়ে দেওয়ার নেশা, অবৈধ উপায়ে টুপাইস কামানো, আবার অবৈধ টাকার জোরে সেই দুর্নীতির ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া, এই চক্রে আমাদের জাতীয় জীবন বাঁধা পড়ে গেছে। লোভ-মোহ-প্রলোভনে পড়ে আমরা হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে টাকার বস্তার দিকে ছুটছি।
কোথাও কোনো রক্ষাকবচ নেই। যাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তারা নিজেরাই অন্যায়ের সমুদ্রে নিমজ্জিত। লোভের পরিণাম বিষয়ে শাস্ত্রে এবং প্রবচনে সেই আদিকাল থেকে বিভিন্ন সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবু লোভ দুর্মর।
আপতত ‘নীতিদর্শন’ চর্চা ছাড়া পরিত্রাণের কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের ভাবতে শিখতে হবে। শেখাতেও হবে। ভাবনাটি জীবন নিয়ে, বেঁচে থাকার মানে নিয়ে। এই জীবন নিয়ে আমরা কী করব-এই মৌলিক প্রশ্নটি করতে শিখতে হবে। জীবনে কত টাকা চাই, কত উপার্জন চাই? অসৎ উপায়ে হোক আর সৎ উপায়ে হোক যে টাকা কাজে লাগানো যায় না সে টাকা মাটির ঢেলা ছাড়া আর কী? বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে আমরা কী করব? দামি মদ গিলব? বালি দ্বীপে গিয়ে ফুর্তি করব? জেট বিমানে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াব? দামি অট্টালিকা বানাব? তারপর? গরিব মানুষের কাছে প্রশ্নটির খানিক সদুত্তর রয়েছে। তারা বলতে পারেন ভালো-মন্দ খাব, দামি পোশাক পরব, গাড়ি চড়ব, বাড়ি বানাব। কিন্তু চাহিদা মিটে যাবার পর যদি আরও আরও দেওয়া হয় তখন? তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি প্রথম যে পাত্র থেকে জল পান করেন সেই পাত্রটি তৃষ্ণার্তের উদগ্র পিপাসার স্পর্শ পায়। তৃষ্ণার্তও প্রথম বারের জল পানে অপূর্ব তৃপ্তি পান। পরে সেই প্রথম বারের মতো তৃপ্তি কিন্তু আর হয় না। ক্রমাগত জলপানে বাধ্য হলে তা শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমহ্রাসমান উপযোগিতার তত্ত্ব অর্থনীতির শাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক ভূমিকা পালন করে। অর্থের ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটে? আরও আরও পেতে পেতে তখন এই প্রশ্নটি যন্ত্রণা দেয়: টাকা নিয়ে কী করব? এর সদুত্তর না থাকিলে কিন্তু বিপদ। রূপকথার সেই রাজার কথা মনে পড়বে। তার স্পর্শে সকলই সোনা হয়ে যায়। এত সোনা নিয়ে তিনি কী করবেন? সোনা তো আর চিবিয়ে খাওয়া যায় না।
কাজেই একজন মানুষের কত টাকা চাই- সেটা যেমন ভাবা দরকার, আর আমাদের ক্রমবর্ধমান লোভের মুখেও লাগাম টানা দরকার। তা না হলে সমূহ বিপদ!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)