ধনী, গরীব, চাকর, কুলি, মেথর, মুচি সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই সুবিধাবাদী প্রবণতা বিরাজমান। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, চেয়ারম্যান, মেম্বার, ভোটার, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, সাংবাদিক, লেখক নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী সকলেই অন্যের অসুবিধায় নিজেরা সুবিধা গ্রহণ করেন। সচিব থেকে পিয়ন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা অন্যের অসুবিধায় সুবিধা গ্রহণের অভ্যাসে ও নেশায় পরিচালিত হন।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ব্যবসায়ীকে অসুবিধায় ফেলে অপর ব্যবসায়ী সুবিধা নিতে তৎপর থাকে। গরীব বেকায়দায় পড়লে ধনী টাকা ধার দিয়ে তাকে বশীভূত রাখা ও তার জমি বন্ধক অথবা কিনে নেয়ার ফন্দি করে। আবার ধনী বেকায়দায় পড়লে গরীব মজুররাও তার অসুবিধায় সুবিধা নিতে চায়। যেমন, ধনী গৃহস্থের ফসলী ধানী জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ধানগুলো কাটতে হলে গরীব মজুরের দরকার। আর মজুর গৃহস্থের অসুবিধায় অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করতে মজুরি বাড়িয়ে দেয়। কারও রোগ হলে ডাক্তার তার অসুবিধায় ফি নেয়ার সুবিধা ভোগ করে। চেয়ারম্যান,মেম্বার ও সাংসদদের যখন ভোটের প্রয়োজন হয় তখন ভোটাররাও তাদের অসুবিধায় সুবিধা গ্রহণ করে। তারা চা মিষ্টি খায়। প্রার্থীর নিকট হতে টাকাও নেয়। প্রার্থীরা তখন ভোটারদের পা ছুঁয়ে সালামও করে। আবার পাশ করে গেলে তারা বদলে যায়।
কারও জন্মনিবন্ধনের কার্ড দরকার কিংবা ওয়ারিশান সনদের দরকার। চেয়ারম্যানরা বুঝে যান এই দু’টো কাগজের জন্য তাদের অসুবিধা হচ্ছে। সুতরাং তাদের এই অসুবিধাই সুবিধার পুঁজি হয়ে ওঠে। বলেন, এগুলো নিলে পাঁচশো অথবা হাজার টাকা লাগবে। শুধু কি তাই? হতদরিদ্র বিধবা ও বয়স্কদের বিধবা ভাতা কিংবা বয়স্কভাতা দিতে গিয়েও তারা টাকা নেন।
সাংসদের কাছে গেল কেউ চাকরির সুপারিশের জন্য। তখন তাদের বাধ্য করা হয় টাকা দিতে। মামলার আসামী হয়ে উকিলের কাছে যায় মানুষ। উকিল বুঝে যান বেচারা বিপদে পড়েছে। দাবি করেন মোটা অংকের অর্থ। বাড়ির ল্যাট্রিনের ট্যাংকি ভরে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে তা পরিস্কার করা দরকার, মেথর এমনটি বুঝে গেলে বেশি টাকা দাবি করবে। এখানেও অসুবিধা মেথরের অতিরিক্ত সুবিধার পুঁজি হবে।
জমির রেজিস্ট্রির জন্য জমা খারিজ করা দরকার। তহশিল অফিসে গেলে তহশিলদার তার অসুবিধাকে সুবিধার পুঁজি করে নিজেরটা আদায় করে নেবে। প্রতি গ্রামেই এমন কিছু অসুবিধাকে পুঁজি করা লোক আছে যারা দূর্দশাগ্রস্ত, অসুবিধাগ্রস্ত ও সাময়িক জরুরি অর্থচাহিদার টেনশনগ্রস্ত – তাদের অসুবিধায় সুবিধা নিতে তৎপর থাকে। তারা হলো একশ্রেণীর সুদখোর গোষ্ঠী।
হয়তো মেয়ের বিয়ে অথবা চিকিৎসার টাকার জোগার হচ্ছে না। জরুরি টাকার দরকার। তখন সুদখোররা তাদের উচ্চসুদে টাকা ধার দিয়ে মুনাফা সুবিধা নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কোনো এলাকায় গেলে তার নিরাপত্তা সুবিধার জন্য হাজার হাজার মানুষকে রাস্তা বন্ধের অসুবিধায় পড়তে হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী অথবা মন্ত্রীদের মামলা দিয়ে, জেল দিয়ে তাদের জীবন বাস্তবতায় নানা অসুবিধা সৃষ্টি করে বর্তমানরা তাদের সুবিধা ভোগ করে। সর্বত্রই চলছে একের সুবিধা হরণ করে অন্যের সুবিধা ভোগের প্রতিযোগিতা।
যে আমলা ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ায় না সে-ই যখন রেলস্টেশনে মালামালের বস্তা নিয়ে আসে তখন তাকে কুলির স্মরণাপন্ন হতে হয়। কুলিও বুঝে যায় ভদ্রলোক অসুবিধায় পড়েছে। সুতরাং তার এই অসুবিধাকেই তার বেশি করে আর্থিক সুবিধার পুঁজি বানাতে হবে। আমলা তখন কুলির আবদার পূরণ করতে বাধ্য হবে। যে দারোগা মানুষের চামড়া ছিলে পয়সা আদায় করে। প্রতি ঈদেই সন্দেহজনক আসামী ধরে থানা হাজতে ভরে মানুষকে বেকায়দায় ফেলে ঈদ বোনাস আদায় করতে। কে চোর, কে ডাকাত, কে সাধু এসব তার বিবেচ্য নয়। টাকা পেলে সাধুকেও যিনি চোর বানাতে পারে। এমন দারোগাও যদি বউ বাচ্চা ও ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে রাস্তার মোড়ে আটকে যায় রিক্সা অথবা সিএনজি, অটোর জন্য। তখন রিক্সাওয়ালা বুঝে যাবে ব্যাটা বিপদে পড়েছে। তখন ডাবল ভাড়া দাবি করবে। নইলে যাবে না। দারোগাও তখন রিক্সাওয়ালার কাছে হার মানতে বাধ্য। কারণ সে বেকায়দায়। বউ বাচ্চা সহ ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে যেতেই হবে।
এই অসুবিধা ও সুবিধার দ্বন্দ্ব নিয়েই মানুষের সর্বত্র বেঁচে থাকা। গ্রাম, গঞ্জ, শহর, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন সবার মধ্যেই অন্যের অসুবিধায় সুবিধা দখলের আকাঙ্ক্ষা। কেবল শ্রেণী অবস্থান অনুযায়ী অসুবিধা সুবিধার ধরণে পার্থক্য মাত্র। তা উচ্চবিত্তের বেলায় একরকম, মধ্যবিত্তের বেলায় একরকম ও নিম্নবিত্তের বেলায় একরকম আবার বিত্তহীনের বেলায় একরকম।
সাংবাদিকরা মানুষের দুর্দশা, প্রতারণা, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ বিস্ফোরণের খবরের জন্য মুখিয়ে থাকে। অসুবিধায় পড়া মানুষের কাছ থেকে কেউ কেউ উপঢৌকন সুবিধাও নিয়ে থাকে। লেখকদের মধ্যেও আরেকজনকে লবিংয়ের অসুবিধায় রেখে নিজের বিভিন্ন পদক প্রাপ্তির সুবিধাকে নিশ্চিত করতে দেখা যায়। সুবিধা আদায় ও সুবিধা হরণ নিয়েই চলছে সর্বমহল। শুধু সুবিধা, অসুবিধার রকমফেরের পার্থক্যটাই চলমান বাস্তবতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)