কে ভেবেছিল ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মে বাঙালির কপালে মুক্তির রেখা আঁকতে শিল্পির চৌকস পথে পা ফেলে জাতির পিতা হতে প্রেরণা ঢেলে দেবে? কে ভেবেছিল একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীকরূপে আসীন হবেন এ ধরণীর বুকে। এর জন্যই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন “পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবের জীবনে তার প্রতিফলন ধ্রুব সত্যের মত। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্নজীবনীতেও। বঙ্গবন্ধু কারাগারে রাজবন্দি থাকাবস্থায় তাঁর আত্নজীবনী লিখেছেন। যার ফলে আমরা জানতে পেরেছি অনেক অমূল্য ঘটনা। আত্নজীবনীর শুরুতে বঙ্গবন্ধু লিখেন “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী”। জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেলে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’
বঙ্গবন্ধুর মুখে এ রকম জবাব শুনেও বেগম মুজিব কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়েকটা বঙ্গবন্ধু কে দেন। তার কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে বেগম মুজিব আবারও অনুরোধ করেন। তারপরই বঙ্গবন্ধু আত্নজীবনী লিখতে শুরু করেন। আজ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, সে সময় কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তা করতেন বেগম মুজিব। পুরো পরিবারকে আগলে রেখে তিনি স্বামীকে লেখালেখির জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লেখেন তাঁর স্ত্রীর ডাক নাম রেণু।
১৯২৭ সালে ৮ অগাস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। মাত্র ৩ বছর বয়েসে তার পিতা শেখ জহরুল হক মৃত্যু বরণ করেন। দুই কন্যার জনক শেখ জহরুল হকের সকল সম্পদের মালিক দুই বোনই বলে তার দাদা দুই নতনীরই বিয়ে দিয়ে দেন। রেনুর তিন বছর বয়সে বিয়ে হয় শেখ মুজিবের সঙ্গে ১৯৩০ সালে এবং আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ১৯৩৮ সালে। এত কম বয়সে বিয়ে হয় যে বাবার অভাব দূর করতে বঙ্গবন্ধুর মাতা নিজেকে বাবা ডাকতে বলেন
সেই থেকে রেনু শ্বাশুরীকে বাবা ডাকতেন।এমনকি তার ছেলে-মেয়ে বড় হলে অসতর্ক অবস্থায় ‘বাব’ ডেকে তিনি সকলের হাসির পাত্র হতেন মাঝে মাঝে। প্রথমে রেনু একটি পূত্র সন্তান প্রসব করেন কিন্তু সন্তানটি বাঁচেনি, এরপর টুঙ্গি পাড়ায়ই জন্ম হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ৫ই আগস্ট ১৯৪৯ সালে আসলো শেখ কামাল ও ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিলে শেখ জামাল।এবার রেনু দীপ্ত প্রতিষ্ঠিত গৃহিনী। তখন রেনু ভাবতে লাগলেন স্বামীর জন্য কোথায় যেন তার কর্তব্যের অবহেলা হচ্ছে, স্বামীর দিনে দিনে জেলের অন্ধকারের ছবি তার চোখে ভেসে উঠছে।
রেনুর যাত্রা এবার ঢাকায় ১৯৫৪ সালে। ঠাঁই হল গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের এক বাসায়। ততদিনে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াহিদুজ্জ্বামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে সাংসদ ও পরে বন ও কৃষি দপ্তরের মন্ত্রী হলে রেনু গেন্ডারিয়ার বাসাকে সালাম জানিয়ে উঠে আসেন ৩ নং মিন্টু রোডের সরকারী বাংলোয়।মাস দুই পর ২৯ মে মন্ত্রী সভা বাতিল হলে পুলিশী অত্যাচারের ভীড়ে চৌদ্দ দিনের নোটিশে রেনুকে ফিরে যেতে হয় নাজিরা বাজারের ৬০ টাকার বাসায় এবং এখানেই জন্ম হয় শেখ রেহেনার।
১৯৫৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীত্ব পান শেখ মুজিব এবং রেনু এলেন এবার ১৫ নম্বরের মিন্টু রোডের বাসায়। এবার সেগুন বাগিচায় ঠায় রেনুর।এভাবেই চলছিল তার ভাগ্যের নৌকা। গ্রামের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এই মহীয়সী নারী শৈশব থেকে ছিলেন সহজ, সরল ও নিরহঙ্কার। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, অসীম ধৈর্য ও সাহসের অধিকারী। যেকোনো পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন।
রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে স্বামীর কারাবরণকালীন সময়ে তিনি হিমালয়ের মতো স্থির ও অবিচল থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সবাইকে মূল্যবান পরামর্শ ও সহযোগিতা করতেন। জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, এজন্য অনেক কষ্ট-দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাঁকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তৎকালীন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। তবুও তিনি অবিচল থেকেছেন।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তার অবর্তমানে মামলা পরিচালনা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা ও আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়াসহ প্রতিটি কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ছাত্রলীগের ছেলেদের তিনি নিজের অলংকার বিক্রি করেও টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আন্দোলন চলমান রাখতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তার ঘরের বাদ্যযন্ত্র আর রেকর্ডগুলো কখনো হাতছাড়া করেননি তিনি। এতে তার সাংস্কৃতিক মনেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মত যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হন। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারায় ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেন। সেই পরিস্থিতির বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভালো করে সংসার গোছাদে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিসভা ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছ।’
এ রকম পরিস্থতিতেও বঙ্গমাতা বেগম মুজিব শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছেন। সন্তানদের মানুষ করেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করেছেন। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে ছিলেন, শ্বশুরের অসুস্থতার খবর টেলিগ্রাম মারফত জানতে পেরে দায়িত্ববোধ পালনে বাড়িতে ছুটে যান। যাওয়ার আগে অসুস্থতার খবর পাওয়া টেলিগ্রামের কপি সংযুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আবেদন করে যান। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিও লাভ করেন। কি প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন বেগম মুজিব। কে ভেবেছিল স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষায় যার দু পাতা বাংলায় পড়ার সুযোগ হয়নি, সে জাতীয় রাজনীতিতে ইংলিশ, উর্দু জানা শহুরে বুদ্ধিওয়ালাদের প্রতিহত করবে পর্দার আড়াল থেকে।
বেগম মুজিবের দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণতা ছিল অত্যন্ত প্রখর। ১৯৬৯ সালে সারা দেশে চলছিল গণ-অভ্যুত্থান। বঙ্গবন্ধুকে অবৈধভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক করে রাখে আইয়ুব সরকার। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সারা দেশ উত্তাল। এ অবস্থায় আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন যে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোল টেবিল বৈঠক করবেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইয়ুবের সামরিক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হবে। তেজগাঁও এয়ারপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে বহন করার জন্য বিমান প্রস্তুত ছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাই বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের সঙ্গে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের পক্ষে ছিলেন। বেগম মুজিব একটি চিরকুট দিয়ে হাসিনাকে পাঠালেন, কর্নেল নাসির এসে ঠিঠিটি বঙ্গবন্ধুর হাতে পৌছে দিলেন।
তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তুমি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যাবা না। নিঃশর্ত মুক্তি নিয়ে তারপর বীরের বেশে গোল টেবিল বৈঠকে যাবা। সেদিন অনেকেই এই যুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। বেগম মুজিবের কথাই বঙ্গবন্ধু রাখলেন, তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইউবের সাথে গোলটেবিলে যান নি। তার কিছুদিন পরেই ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান।
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পান। এর পরেরদিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুকে ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বেগম মুজিবের পরামর্শই অবশেষে সঠিক প্রমাণিত হয়। আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করে গদি ছাড়তে হয়, আর বঙ্গবন্ধু বীরের বেশে মুক্ত হয়ে আসেন।
এভাবে প্রতিটি সংগ্রামে, দুঃসময়ে বেগম মুজিব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাহস-অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানে কারাবন্দি স্বামীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মাঝেও তিনি অসীম ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। দেশ ও জাতির জন্য তাঁর অপরিসীম ত্যাগ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতা তাঁকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল জাতির পিতার সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম এক অবিস্মরণীয় অনুপ্রেরণাদাত্রী। জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মহীয়সীকে…
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)