চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

একুশের অমর পাঁচটি গানের জন্মকথা

বাঙালি জাতীয়বাদকে ধারণ করে মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা  শুধু রাজধানী বা দেশের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সে আন্দোলন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, নাড়া দিয়েছিল ছাত্র-যুবাসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে। আন্দোলনে প্রেরণা যোগাতে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের কবি সাতিহ্যিক এবং সঙ্গীতজ্ঞসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব শ্রেণির ব্যক্তিত্বরা। অমর একুশের মর্মান্তিক ঘটনা দেশের প্রধান প্রধান কবি ও গীতিকারদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল,  দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আউল-বাউল, স্বভাবকবি, গ্রামীণ বয়াতি ও কবিয়ালদেরও একইভাবে আলোড়িত করেছিল। ভাষা আন্দোলনের আগে-পরে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান। তার মধ্যে কিছু গান অমর হয়ে আজও বাঙালির মুখে মুখে সুর তোলে, হৃদয়ে জাগায় শিহরণ। তারমধ্যে জনপ্রিয় পাঁচটি গানের জন্মকথা চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

‘ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি’
ভুলবো না ভুলবো না/ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি/ভুলবো না…/লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস/মিলিটারি আর মিলিটারি/ভুলবো না…’’

গাজিউল হক

অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাঁদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের লেখা এই গানটিকেই একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৩-৫৫ সাল পর্যন্ত একুশের প্রভাতফেরীতে গাওয়া হতো শীর্ষস্থানীয় ভাষাসংগ্রামীর এই গানটিই।

গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন গাজীউল হকের ছোটভাই নিজাম উল হক। সুরারোপ শেষে তারা দুজন মিলেই গানটি প্রথম গেয়েছিলেন।

‘আমার ভায়ের ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রুগড়া ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনা দেশের রক্ত রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি

আবদুল গাফফার চৌধুরী

ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে রচিত গানগুলোর মধ্যে এই গানটির জনপ্রিয়তা সর্বাধিক এবং এটিই একুশের মূল গান হিসেবে স্বীকৃতি যা এখন একুশের প্রভাতফেরীর গান। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন। প্রথমে আবদুল লতিফ গানটি সুরারোপ করেন। তবে পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫৪ সালের প্রভাত ফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি এবং এটিই এখন গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’
সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে/আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/তাদের স্মৃতির চরণে/মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/স্বাধীন আশায় পথ চলাতে/হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ/সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান/তাদের বিজয় মরণে’’

আব্দুল জব্বার

ভষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গানটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। গানটি রচনা করেন ফজল-এ-খোদা। এতে সূর দেন সদ্যপ্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে গানটি ব্যপকভাবে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর থেকে গানটি বেশি প্রচারিত হলেও মূলত ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণেই এই গান রচিত হয়। ২০০৬ সালে বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতা মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে ১২তম অবস্থানে অর্ন্তভূক্ত হয় গানটি।

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে নিতে চায়’
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতেপায়ে/ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়/কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়/এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?’’

আবদুল লতিফ

বাঙালির কথ্য ভাষায় রচিত এ গানটির স্রষ্টা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা গীতিকার- সুরকার এবং একুশের গানের প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ।জারির সুরের খুব সহজ ভাষায় এই গান যেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের কথা বলে। আজও গানটি সমান জনপ্রিয়।

‘তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’
 “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি/তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি/মা কান্দে, বাপ কান্দে, কান্দে জোড়ের ভাই/বন্ধু বান্ধব কাইন্দা কয়, হায়রে খেলার সাথী নাই/ও বাঙালি…”

লোকজ গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদ রচনা করেছিলেন মর্মস্পর্শী এই গানটি।পল্লীগীতির স্বাভাবিক সুরে সুরারোপিত গানটি এখনও বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

ভাষা আন্দোলন আলোড়িত করেছিল দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আউল-বাউল, স্বভাবকবি, গ্রামীণ বয়াতি ও কবিয়ালদেরও। এঁরা শুধু গান রচনা করেই থেমে থাকেননি, গ্রামেগঞ্জে, হাটবাজারে গেয়ে বেড়িয়েছেন। একুশের গান গাওয়ার জন্য এঁদের অনেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলেও একুশের ওপর রচিত বই এবং স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।