চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার ও বাংলাদেশ

‘গণহত্যা অস্বীকার (Genocide Denial)’ বলতে সংঘটিত কোনো গণহত্যাকে অস্বীকার বা সংঘটিত গণহত্যার নৃশংসতার মাত্রাকে স্বল্প বলে দেখানোর গর্হিত অপচেষ্টাকে বুঝানো হয়। সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করার মত অমানবিক কাজকে ‘ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা ও ইতিহাস দূষণের অপচেষ্টা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং তাদের অনুগত বিহারি ও দেশীয় দালালরা কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিলো, কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছিলো। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি এবং তাদের অনুগত বিহারি ও দেশীয় দালালদের বর্বরতা ও বিভৎসতার মাত্রা বুঝতে দু’টো বিষয়ের দিকে নজর দেয়া যায় – মাত্র নয় মাসে ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালির গণহত্যা সংঘটিত হয় এবং এই ভয়ংকর গণহত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।

১৯৮১ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা হলো বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা, স্বল্প সময়ে ব্যাপক সংখ্যায় বাঙালিকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয় এবং বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

একাত্তরের গণহত্যা

পাকিস্তান সরকার ও একাত্তরে তাদের সহযোগী দালালরা বাংলাদেশে সংঘটিত একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার করে এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে, বাংলাদেশে নিজেদের পুনর্বাসিত করে ও পরবর্তী প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে এবং এই সময়টাতে একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার, প্রোপাগান্ডা সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ব্যাপক চেষ্টা করা হয়।

২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি পুনরায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়। পরবর্তীতে একের পর এক রায় বাস্তবায়ন শুরু হলে, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত এই বিরোধী শক্তি নিজেদের অপরাধের দায় ও শাস্তি এড়াতে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা অস্বীকার করে বক্তব্য দেয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-শিবিরের পাশাপাশি প্রো-পাকিস্তানি রাজনৈতিক দল বিএনপি’র খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া, গয়েশ্বর রায় সহ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করাসহ একাত্তরে সংঘটিত ‘বাঙালি গণহত্যাকে’ অস্বীকার করে নানান সময় বক্তব্য দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার বস্তুত বাঙালির জাতিস্বত্ত্বায় আঘাত করার শামিল; তাই এই নোংরা অপচেষ্টাগুলো বন্ধে আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

একাত্তরের গণহত্যা

আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা অস্বীকারকে’ গর্হিত, অমানবিক ও বেআইনী কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এর মাধ্যমে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধকে অস্বীকার করা হয়। তাই গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে আইন রয়েছে। ২০০১ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক্সিকিউটিভ কমিশন সদস্য দেশগুলোতে জাতিগত-বিদ্বেষ বিরোধী আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেয়, যাতে গণহত্যা অস্বীকারে শাস্তি প্রদানের বিধান রাখার কথা বলা হয়।

জার্মানি ১৯৮৫ সালে, ফ্রান্স ১৯৯০ সালে, অস্ট্রিয়া ১৯৯২ সালে, বেলজিয়াম ১৯৯৫ সালে, পোল্যান্ড ১৯৯৮ সালে, চেক প্রজাতন্ত্র ২০০১ সালে, রোমানিয়া ২০০২ সালে, স্পেন ২০০৭ সালে ও হাঙ্গেরি ২০১০ সালে আইন করে গণহত্যা অস্বীকারকে অবৈধ ও অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। গণহত্যা অস্বীকার করা, মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন দেয়া, জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রচারকে অবৈধ ও অপরাধ ঘোষণা করে ইউরোপের প্রায় সব দেশেই আইন রয়েছে।

১৯৯২-১৯৯৫ সালে সংঘটিত বসনিয়া যুদ্ধে সার্বদের হাতে বসনিয়ান মুসলিমরা গণহত্যার শিকার হয়; সম্প্রতি বসনিয়া-হার্জেগভিনায় ‘বসনিয়ায় গণহত্যা অস্বীকার বিরোধী আইন’ প্রণয়নের দাবি করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও কানাডায় জাতিগত-বিদ্বেষ ও ঘৃণা-প্রচার বিরোধী আইনের মাধ্যমে গণহত্যা অস্বীকারের বিচার করা হয়।

আর্মেনীয় গণহত্যা

‘গণহত্যা অস্বীকারের’ দায়ে আজ পর্যন্ত অনেকের শাস্তি ও হয়েছে বিভিন্ন দেশে। যেমন – ১৯৯৩ সালে এক প্রবন্ধে ‘আর্মেনিয়ান গণহত্যা’ অস্বীকার করায় বার্নার্ড লুইসকে ফ্রান্সে এক মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক জরিমানা করা হয়, ‘হলোকাস্ট’ অস্বীকার করায় ডেভিড আরভিং ২০০৬ সালে অস্ট্রিয়ায় ১৩ মাস জেল খেটেছিলো, আমেরিকান আইন অধ্যাপক পিটার আর্লিন্ডার রুয়ান্ডার ‘তুতসি গণহত্যা’ অস্বীকার করায় ২০১০ সালে রুয়ান্ডায় জেল খেটেছিলো।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশেও ‘গণহত্যা অস্বীকার বিরোধী আইন’ প্রণয়নের দাবি জানানো হচ্ছে। এই আইনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি-বিহারি-দালালদের দ্বারা সংঘটিত ‘বাঙালি গণহত্যা অস্বীকার করাকে’ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় বেশ বড় আকারের মানববন্ধন করা হয়েছে, সমাজের বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন সংগঠন ‘গণহত্যা অস্বীকার বিরোধী আইন’ প্রণয়নের জন্য জোর দাবি জানিয়েছে। ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন-২০১৬’-এর প্রণয়নের কাজ করছে।

‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন-২০১৬’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও একই বছরের ০১ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অস্বীকার, তথ্য বিকৃতি, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার, প্রকাশনার অপব্যাখ্যা, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের পক্ষে যুক্তি দেয়া, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ-বীরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত তথ্যকে খাটো করে দেখা, একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনকে অস্বীকার করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন ও বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাকে অবৈধ ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।’

‘গণহত্যা অস্বীকার বিরোধী আইন’ প্রণয়নের দাবিতে রাজপথে

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে বিকৃত করলে ও একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার করলে তা এই আইনের আওতায় চলে আসবে। এই আইনের আওতায় বিচারে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানার সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে দ্বিগুণ।

১৯৭১ সালে বাঙালিরা রক্তের দামে স্বাধীনতা অর্জন করেছে – ত্রিশ লক্ষ শহীদ, পাঁচ লক্ষ নির্যাতিত নারী, এক কোটি শরণার্থী, বিধ্বস্ত দেশ। একাত্তরে পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালির বিরুদ্ধে এই ভয়ংকর বর্বরতা সংঘটনে সহায়তা করেছিলো দেশীয় দালালরা তথা জামাত, ছাত্রসংঘ (বর্তমানে ছাত্রশিবির), রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এইসব দালালরা আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এরা নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। সবসময় এরা একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা অস্বীকার করে এসেছে ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা করেছে।

বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধী এইসব দালালদের একাত্তরের বর্বর ও নৃশংস ভূমিকার বিচার চলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে দালালদের শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। কিন্তু দালালরা ও তাদের দুষ্কর্মের সহযোগী বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের তথ্যবিকৃতির যে অপবীজ বপণ করেছে এবং করে যাচ্ছে, তা বন্ধে ‘গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’ প্রণয়ন খুব জরুরি ছিলো।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার বন্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন-২০১৬’ পাস হলে তা হবে বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য একটি মাইলফলক। এর ফলে ‘গণহত্যা অস্বীকার’ করার মত গর্হিত ও অমানবিক যে চর্চাটি বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী প্রকাশ্যে করে আসছিলো, তা বন্ধ হবে আশা করা যায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)