১৯৭১ সালে বাংলার মাটিতে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও কল্পনাতীত বর্বরতা সংঘটিত হয়েছিল, নয় মাস জুড়ে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যে নিধন অভিযান পরিচালিত হয়েছিল তার ভয়ঙ্করতা ও ব্যাপকতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ বিশেষ ছিল না। পাকিস্তানিরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিল হত্যাযজ্ঞের বাস্তবতা আড়াল করে রাখতে, কিন্তু কূটনীতিক মহল, আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সূত্রে খবর পৌঁছেছিল বিশ্ববাসীর কাছে। আর তাই সামরিক আঘাতের শিকার বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল সংহতি আন্দোলন। বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটা যে জেনোসাইড বা গণহত্যা, তা শনাক্ত করে ধিক্কার জানাবার মতো মানুষ তখন অনেক মিলেছিল। এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড। হত্যাভিযান শুরুর পরপর, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও প্রাপ্ত তথ্য থেকে তার অভিমত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানাতে তিনি কালবিলম্ব করেন নি। ২৯ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা থেকে প্রেরিত টেলেক্স বার্তার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’, গণহত্যা তখনও পুরো চেহারা মেলে ধরেনি, আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে ওয়াকেফহাল কূটনীতিক তাই হয়তো কিছুটা রক্ষণশীলভাবে ‘সিলেকটিভ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন, তবে ‘জেনোসাইড’ অভিধা তিনি সচেতনভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। পরে তার স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছিলেন, ‘জেনোসাইড শব্দটি পূর্ব পাকিস্তানের সংকট বোঝাতে সেই প্রথম ব্যবহৃত হলো, তবে আমি বুঝেছিলাম এটাই শেষবারের মতো প্রয়োগ হচ্ছে না।’
বস্তুত নয় মাস জুড়ে বিভিন্ন সংবাদদাতার ভাষ্যে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, সংহতি সভা-সমাবেশে ‘গণহত্যা’ শব্দবন্ধ উচ্চারিত হয়েছে বারবার, এর মধ্যে সবচেয়ে শিহরণ জাগিয়েছিল সানডে টাইমসের সম্পাদকীয় পাতার দুই পৃষ্ঠা জুড়ে বিশাল হরফের শিরোনাম- জেনোসাইড। আরো স্মর্তব্য, বাইরের দুনিয়ায় আলোড়ন না জাগালেও ইতিহাসের পথ বেয়ে ক্রমে মহিমান্বিত হয়ে ওঠা জহির রায়হানের কালজয়ী তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, যে শিরোনাম তখনই স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল বিশ্বসমাজের দায়বদ্ধতা এবং আজও তা স্মরণ করিয়ে চলছে একই কথা।
বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে আলোড়িত, শিহরিত ও উদ্বেলিত হয়েছিল বিশ্বসমাজ, কিন্তু এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা জাতিসংঘ এবং বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশ গণহত্যা ও মানবতার চরম অবমাননা সম্পর্কে ছিল সচেতনভাবে নীরব। শরণার্থী সংকট এবং এই সমস্যার সমাধান-কল্পে বিভিন্ন দেশের মুখপাত্র স্ব-স্ব অভিমত ব্যক্ত করলেও তা ছিল বিশ্ব-রাজনীতির ক্ষমতা-দ্বন্দ্বের নিরিখে নেয়া অবস্থান, এর বাইরে গিয়ে গণহত্যার বাস্তবতা মোকাবিলার কোনো উদ্যম কোথাও ছিল না। বস্তুত, স্নায়ুযুদ্ধ-পীড়িত বিশ্ব ছিল বিভাজিত, পারস্পরিক এই দ্বন্দ্বে জেনোসাইড-এর মুখোমুখি হয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রশ্ন কোনোভাবে বিবেচ্য হয় নি। ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হওয়ার পরপরই শুরু হওয়া পশ্চিমী বিশ্ব ও সমাজতন্ত্রী বিশ্বের দ্বন্দ্ব জেনোসাইড ইস্যু পাঠিয়ে দিল হিমঘরে, যে দীর্ঘ-পর্ব অভিহিত হয়েছে ‘ফিফটি ইয়ার্স অব সাইলেন্স’ হিসেবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা হয়েছিল বিশ্বসমাজের এমন নীরবতা ও অন্ধতার শিকার।
কেবল যে নীরবতা ছিল তা নয়, ছিল বৈরিতাও, যে-বৈরিতা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছিল গণহত্যাকারী গোষ্ঠী তথা পাকিস্তানি সেনানায়কদের বিচারের প্রশ্নে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর ন্যক্কারজনক পরাজয় ও সদলবলে আত্মসমর্পণ অভূতপূর্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। গণহত্যাকারী গোষ্ঠীর এমন পরাজয় ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয় এবং জার্মান ও জাপানি সমরনায়কদের আত্মসমর্পণ ও বন্দিত্ব বরণের পর অনুরূপ ঘটনা আর বিশেষ ঘটেনি। কাম্বোডিয়ার গণহত্যাকারী খেমার-রুজ নেতৃত্ব ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। পূর্ব তিমুরে যে গণহত্যা ঘটিয়েছিল ইন্দোনেশীয় বাহিনি তারা ফিরে গিয়েছিল নিজ দেশে, জাতিসংঘের হাতে ক্ষমতা দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে নব্বই সহস্রাধিক পাকিস্তানি-সৈনিক, সহায়ক বাহিনির সদস্যসহ সামরিক নেতৃত্ব, নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনি ও ভারতীয় সেনাদলের সম্মিলনে গঠিত মিত্রবাহিনির কাছে। গণহত্যার শিকার জাতি তথা ভিকটিম নেশন হিসেবে বাংলাদেশ একেবারে সূচনাকাল থেকে জেনোসাইডের বিচারের ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানাতে থাকে। ১০ জানুয়ারি মুক্ত কিন্তু রক্তস্নাত বাংলাদেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তার আবেগ-মথিত ভাষণের সমাপ্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনি বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে তার তদন্ত ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে সমভাবে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হয়। ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২ কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা চাপ সৃষ্টি করতে চাই যেন জাতিসংঘের হিউম্যান রাইট্স কমিশন যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিবিধানের জন্য অবিলম্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে।’ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকবাহিনীর দোসর আলবদর-কৃত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের সদস্যরা ১৭ মার্চ ১৯৭২ শহীদ মিনারে সমবেত হয় এবং মিছিল সহকারে গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্মারকলিপি প্রদান করে।
এখানে স্মরণ করা দরকার, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর থেকে বাংলাদেশে মিত্রবাহিনি অবস্থান করছিল এবং রাতারাতি এই অবস্থা পাল্টাবার মতো পরিস্থিতি তখন ছিল না। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি ধারণ করবার মতো অবকাঠামো ও ব্যবস্থা বাংলাদেশের ছিল না। আর তাই যুদ্ধবন্দিদের ভারতের বিভিন্ন সেনা-শিবিরে স্থানান্তর করা প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকা থেকে শরণার্থীরা দ্রুত দেশে ফিরে এলেও দূরবর্তী অনেক ক্যাম্প থেকে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ছিল ব্যাপক আয়োজন-সাপেক্ষ। তদুপরি দেশের ভেতরে, বিশেষভাবে অবাঙালি অধ্যুষিত কতক অঞ্চলে পাকিস্তানি এনক্লেভ বা ছিটমহল-সদৃশ বাস্তবতা উদ্ভূত হয়েছিল, যেমন ছিল মিরপুর এলাকা, যা মুক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। এমনি পরিস্থিতিতে ১০ জানুয়ারি কলকাতা সফরে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাদলের বাংলাদেশ ত্যাগের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে।
সেই মোতাবেক প্রথম স্বাধীনতা-বার্ষিকী তথা ২৬ মার্চের আগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা-প্রত্যাহার সমাপ্ত হয়। এই সেনা-প্রত্যাহার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার সংঘটনের নৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এখানে ইতিহাসের তুলনামূলক আরেক ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কম্বোডিয়ায় ক্ষমতাসীন খেমার-রুজ কমিউনিস্ট শাসকদলের পরাজয় ঘটে ভিয়েতনাম-সমর্থিত কম্বোডিয় জাতীয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। নমপেন মুক্ত করে দেশে হান সেনের নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু ভিয়েতনামী সৈন্য কম্বোডিয়ায় অবস্থান করছে এই অজুহাতে হান সেনের সরকারকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে চিন-মার্কিন আঁতাত। জাতিসংঘে কম্বোডিয়ার আসন দখল করে রাখে গণহত্যাকারী খেমার রুজ গোষ্ঠী, যদিও কম্বোডিয়ার মাটিতে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তারা নামে মাত্র ছিল সরকার। অনেক পরে ১৯৯৬ সালে ভিয়েতনামী সেনাদল প্রত্যাহারের পরই কেবল পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী মহাসচিব উ থান্টের কাছে প্রেরিত পত্রে সকল পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির প্রত্যাবর্তনে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এই পত্রে আগা শাহী বাংলাদেশের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ভারতকে চিহ্নিত করেন যুদ্ধবন্দিদের ‘আটককারী কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে এবং ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। এভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাদলের অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান ঘোঁট পাকাতে চেয়েছিল। ১৯৭২-এর মার্চের মধ্যেই ভারতীয় সেনাদল বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিলে পাকিস্তানের ঐ অবস্থান গ্রহণের সুযোগ আর রইলো না।
এই পটভূমিকায় ১৯৭২ সালের এপ্রিলে জেনেভাস্থ ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস-এর মহাসচিব নিয়াল ম্যাকডেরমট ঢাকা সফরে আসেন এবং গণহত্যাকারীদের বিচার বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন। পাকবাহিনির নৃশংসতার পরিচয় তারা নানাভাবে নিয়েছিল এবং নৃশংস গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের দাবি জুরিস্ট সংস্থা হিসেবে তারা নাকচ করতে পারে নি। ব্যাপক নৃশংসতা যে ঘটেছে তার স্বীকৃতি দিয়ে আইসিজে অভিমত প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশ যদি বিচারে অগ্রসর হতে চায় তবে দেশীয় দণ্ডবিধির পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের আওতায় এই বিচার হতে হবে এবং এমন এক আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠন করা দরকার যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক হবেন নিরপেক্ষ দেশ থেকে আগত।
তো এই হচ্ছে পটভূমি, সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন তুলে ধরেছিল এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ৪ এপ্রিল ১৯৭২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ১২ জুলাই ১৯৭২ সিমলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কোনো উল্লেখ থাকে না। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ব্যতীত এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়, এটা ছিল ভারতের অভিমত এবং পাকিস্তানকে তা মেনে নিতে হয়, প্রকারান্তরে যা ছিল যুদ্ধবন্দিদের আটককারী হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া।
সঠিক ও যথাযথ কূটনীতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেয়া হলেও চরম প্রতিকূল পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতিহীন অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সফলকাম হওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। পাকিস্তান স্বীয় অবস্থানের পক্ষে বিশেষভাবে সমবেত করে চিন, তুরস্ক, ইরান ও সৌদি আরবকে। চিন তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নতুন সদস্য। ১৯৭২ সালের আগস্টে চিন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশ রোধ করতে। ইতিমধ্যে বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো এ-থেকে বিরত থাকে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার যখন অস্বীকার করা হলো, তখন বিশ্বসভার কাছে বিচার চাইবার অধিকার ও সুযোগ বাংলাদেশের জন্য সীমিত হয়ে আসে। পাশাপাশি নানাভাবে চলছিলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি- বিচারের দাবি থেকে সরে আসা এবং যুদ্ধবন্দিদের ফেরৎ পাঠানোর জন্য। এমনি চাপের মুখে বাংলাদেশ কখনো নতশির হয় নি, বরং বিচারের সম্ভাব্যতা আরো জোরদার করে যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে চিহ্নিত ১৯৫ জনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
১৯৭২ সালে গণহত্যার বিচারের জন্য বাংলাদেশের সরকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক সমাজ যে দাবি তুলে ধরেছিল, যেভাবে আবেদন জানিয়েছিল জাতিসংঘ ও বিশ্বনেতাদের কাছে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাতে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতো তবে নতুনভাবে লেখা হতো ইতিহাস। আমরা ভালোভাবে জানি ইতিহাসে ‘যদি’-র কোনো স্থান নেই, তারপরও আমরা কল্পনায় সেই দৃশ্যপট যদি এক নজর দেখি তাহলে বুঝতে পারবো বাংলাদেশের অবস্থানের মাহাত্ম্য। বাংলাদেশের বিচারের দাবি নিয়ে আলোচনা হতে পারতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদে। আমরা ধরে নিতে পারি নিরাপত্তা পরিষদের কোনো স্থায়ী সদস্য ভেটো প্রয়োগ করতেন না, ভোটদানে বিরত হয়তো কেউ থাকতেন। সাধারণ পরিষদে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হতো সিদ্ধান্ত। এর ফলে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যেমন প্রদত্ত হতো, তেমনি এর থেকে যথাযথ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ তৈরি হতো। সর্বোপরি গণহত্যার বিচারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে তৎপর হতে হতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। সেজন্য প্রয়োজন ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী নুরেমবার্গ ও টোকিও আদালত, জেনোসাইড কনভেনশন এবং ১৯৫০ সালের নুরেমবার্গ নীতিমালার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংজ্ঞায়িত করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ সংজ্ঞায়িত করে আদালত পরিচালনার পদ্ধতি, বিচারের স্থান নির্ধারণ, প্রসিকিউটর নিয়োগ ও অভিযোগনামা গঠন এবং বিচারবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শুরু হতে পারতো বিচার কার্যক্রম। ১৯৯১-৯২ সালে পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারের জন্য যে অ্যাডহক আদালত প্রতিষ্ঠা করেছিল জাতিসংঘ তার বহু আগেই বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারে আদালত গঠিত হতে পারতো। ২০০২ সালে রোম-সংবিধি গ্রহণের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেসব কার্যক্রম ১৯৭২ সালেই সূচিত হতে পারতো। তাই যদি হতো তবে বিশ্বসমাজ সত্যিকার অর্থে শক্তিপ্রাপ্ত হতো গণহত্যা প্রতিরোধে এবং মানবসমাজ ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা থেকে উত্তরণের পথে যাত্রা শুরু করতে পারতো।
বাস্তবে বাংলাদেশে গণহত্যার বিচারে নৈতিক অবস্থান নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি থাকা সত্ত্বেও এই গণহত্যা পৃথিবীর এক দূরপ্রান্তে দরিদ্র অসহায় জনগোষ্ঠীর ট্র্যাজেডি হিসেবে গণ্য হয়ে বিশ্বনেতাদের বিবেচনার বাইরে রয়ে গেল। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসনের জন্য একাত্তরের ঘটনাবলি হয়ে ছিল বিবেকের কাঁটা, সেটা বিস্মৃত হওয়া কিংবা উপেক্ষার অন্তরালে সেই ঘটনাধারা ঠেলে দেয়া তাদের কাছে হয়েছে বিশেষভাবে কাম্য। ফলে নিভৃতে কেঁদে-ফেরাটাই যেন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারের দাবির বিধিলিপি। কিন্তু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশ ত্রিশ লক্ষ শহীদের আকাংক্ষা ও অগণিত নারী-পুরুষের হাহাকার স্মরণে রেখে প্রায় একাকী পথরেখা কাটতে শুরু করলো। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হলো দালাল আইন, প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুযায়ী সে-আইনে দেশীয় অপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে নব-নির্বাচিত সংসদে গৃহীত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইন, যা গণহত্যার বিচারের আইনগত ভিত্তি তৈরি করলো, বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম এমন আইনী দলিল। নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল যে পথ দেখিয়েছিল তা পরিণতি পায় নি বিশ্বসমাজের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতায়, বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে সক্রিয়তা ও সফলতার নিদর্শন স্থাপন করলো এই আইন প্রণয়ন দ্বারা। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হয়ে এমন জরুরি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারে তার উদাহরণ বিশেষ নেই। বাংলাদেশ সেই উদাহরণ তৈরি করেছিল ১৯৭৩ সালে এবং ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর দ্বারা। তবে এক্ষেত্রেও দেখা গেছে আস্থাহীনতা ও অবজ্ঞা, তৃতীয় বিশ্বের এক পশ্চাৎপদ দেশ যে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে করতে সক্ষম সেটা মেনে নিতে অপারগ হয়েছে অনেকে।
দুই
স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বিছানো হয়েছিল নানা কাঁটা। ১৯৭৩ সালের মধ্যে শতাধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘে দেশটির প্রবেশাধিকার ছিল অস্বীকৃত। এর কারণ ছিল ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য বাংলাদেশের দৃঢ়বদ্ধ অবস্থান। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সংঘাত শেষে বন্দিবিনিময় ঘটাবার জন্য ভারতের ওপর চাপ ক্রমে প্রবল হচ্ছিল, কিন্তু জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রসঙ্গ কেউ উত্থাপন করে নি। ভারত ন্যায়সঙ্গতভাবে যুদ্ধবন্দিদের স্বীয় দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশের বক্তব্য ছিল সর্বাগ্রে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তারপর ১৯৫ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত সকল যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফেরৎ পাঠানো হবে। যেহেতু যুদ্ধবন্দিরা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তাই তাদের মুক্তি কিংবা বিনিময় প্রশ্নে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ছিল স্বাভাবিক। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে আঁতাত করে চরম অনৈতিকভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার ঠেকিয়ে রেখেছিল, যুদ্ধাপরাধীসহ সকল যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণ ছাড়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে চীন-পাকিস্তান যোগসাজশ গণহত্যার অস্বীকৃতির জের ধরে বিচারের অধিকারকেও অস্বীকার করছিল। এই পরিস্থিতি তৈরিতে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না, কিন্তু এমন নীতিহীন পদক্ষেপের বিপরীতে তারা কোনো অবস্থান নেয় নি, বরং এক ধরনের অনুমোদন তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ও আইন অনুসারে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির বিচার করতে চাইছিল। এর বিপরীতে পাকিস্তানের বক্তব্যে কেবল অসারতা ছিল না, তাদের পদক্ষেপে ছিল মানবাধিকারের চরম অবমাননা। বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতিশোধ-স্বরূপ পাকিস্তান ১৯৭৩ সালের মে মাস থেকে সেদেশে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক করতে শুরু করে। বাংলাদেশ গণহত্যার অভিযোগে ১৯৫ যুদ্ধবন্দির বিচার শুরু করলে পাকিস্তানও ২০৩ জন বাঙালি অফিসারের বিচার করবে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে- এমন হুমকি প্রদান করেন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো। ১১ মে ১৯৭৩ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা দায়ের করে আদালতের হস্তক্ষেপ চায় যেন ভারত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে না দেয়। তবে এই হস্তক্ষেপ কামনা করে পাকিস্তান যে যুক্তি তুলে ধরে সেটা প্রণিধানযোগ্য। পাকিস্তান জেনোসাইড কনভেনশনের ৬ ধারার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেখানে বলা হয়েছে, ‘যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে জেনোসাইডের অভিযোগ আনা হবে তাদের বিচার হবে অপরাধ-সংঘটিত অঞ্চলের রাষ্ট্র দ্বারা গঠিত উপযুক্ত আদালতে।’ গণহত্যার বাস্তবতা ও বিচারের অধিকার দুইয়ের স্বীকৃতি এখানে প্রদত্ত হয়েছিল, তবে বিচারের অধিকার পাকিস্তানের আওতাধীন- এটাই ছিল তাদের বক্তব্য। পাকিস্তান অবশ্য পরে মামলার দুর্বলতা উপলব্ধি করে এবং সে-বছরের ডিসেম্বরে তা প্রত্যাহার করে নেয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালি। এদের মধ্যে ১৬,০০০ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সপরিবারে আটক করে বিভিন্ন বন্দিশালায় নেয়া হয়। এটা ছিল সবরকম আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জাপান-আমেরিকা যুদ্ধ শুরু হলে ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে বসবাসরত বিপুল-সংখ্যক জাপানিজ-আমেরিকানকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক করা হয়েছিল। বিলম্বে হলেও পরে এই অমানবিক কার্যক্রম নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলসে জাপানিজ-আমেরিকানদের বন্দিভাগ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে জাদুঘর, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে ভুক্তভোগী মানুষদের কাছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে আটক বাঙালিদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো নিন্দাবাদ কখনো ধ্বনিত হয় নি এবং এই ঐতিহাসিক অপরাধ মোচনের কাজটি সেদেশের জন্য অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যার্পণ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ঘিরে জাতিসংঘের গোপন কূটনীতিক তৎপরতার পরিচয় রয়েছে সংস্থার নিউইয়র্কস্থ আর্কাইভে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এসব দলিল ও চিঠিপত্রের কপি সংগ্রহ করেছে এবং সেখানে পর্দার আড়ালে আগ্রহোদ্দীপক ঘটনাধারার পরিচয় মেলে। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের আণ্ডার সেক্রেটারি জেনারেল স্যার রবার্ট জ্যাকসন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফরে আসেন এবং যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণ ঘিরে সৃষ্ট জট নিরসনে আলোচনা শুরু করেন। পর্দার অন্তরালে গৃহীত এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ তৎকালীন পরিস্থিতি উপলব্ধিতে বিশেষভাবে সহায়ক এবং গণহত্যাকারীদের বিচারে ন্যায়সঙ্গত অবস্থান গ্রহণে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এখানে নানাভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ২৩ অক্টোবর ১৯৭২ স্যার রবার্ট জ্যাকসন ‘সিক্রেট অ্যান্ড পার্সোনাল’ পর্যায়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে তার বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করেন। তিনি জানান যে, ২০ অক্টোবর শুক্রবার রাতে এবং ২১ অক্টোবর শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনি একান্ত বৈঠক করেছেন যেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। স্যার জ্যাকসনের মনে হয়েছিল মুজিব ও তাঁর মধ্যে এক প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিনি এ-ও লিখেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আনরড (জাতিসংঘের রিলিফ তৎপরতা) যে রাজনৈতিক গুরুত্ববহ সেটা মুজিব বোঝেন। তিনি পরবর্তী বছরের বিশ্ব গম উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিত, এক্ষেত্রে আনরড কার্যক্রমে আমেরিকার বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিও তিনি দেন। স্যার জ্যাকসনের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান অচলাবস্থা নিরসনে স্বীয় প্রস্তাব মেলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। এই প্রস্তাবের প্রধান দিক ছিল:
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ মহাসচিবের নির্ধারিত দিন যুগপৎ বিবৃতি প্রদান করে পারস্পরিক স্বীকৃতি প্রদান করবে। এরপর মহাসচিবের উপস্থিতিতে কোনো নিরপেক্ষ দেশে উভয়ে আলোচনায় মিলিত হবেন। উভয় দেশের নাগরিকদের বিনিময় এবং সম্পদ ও দায় ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হবে। সেই সাথে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছাড়া অন্য যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফেরার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে জানানো হয়, গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছাড়া অন্য যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ আপত্তি করবে না। রবার্ট জ্যাকসনের নোটে লেখা রয়েছে : ‘Prime Minister of Bangladesh would not oppose the return of any Prisoners of War except those alleged to be guilty of genocide. Such prisoners will face trial according to established international convention.’ লক্ষণীয়, জাতিসংঘ দূতের নোটে ‘যুদ্ধাপরাধ’ উল্লেখ না করে ‘জেনোসাইড’ শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি প্রকাশ করে।
এরপর আমরা পাই ২৬ অক্টোবর ১৯৭২ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে জাতিসংঘ দূতের আলোচনার গোপন রিপোর্ট। ১৩ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে দেখা যায় ভুট্টো স্বভাবসিদ্ধভাবে নানা কথা বলেছেন এবং কোথাও ছাড় দিয়েছেন আবার কোথাও শক্ত অবস্থান নিতে চেয়েছেন। উভয় নেতার বৈঠক বিষয়ে তিনি সম্মতি জানান, তবে এর জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পূর্বশর্ত মানতে রাজি ছিলেন না। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘He (Bhutto) did not reject the position of the Prime Minister that such accused Prisoners of War should be tried by internationally recognised procedures, ‘If they have committed barbarities as all soldiers do’ then such trials should take place in Pakistan.’
আলোচনার জের ধরে নভেম্বরে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কৌতূহলোদ্দীপক একটি বার্তা জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, জেনোসাইড কাকে বলে? জবাবে ১৫ নভেম্বর, ১৯৭২ জাতিসংঘ দপ্তর থেকে জেনোসাইড কনভেনশনের কপি পাঠানো হয় পাকিস্তান দূতাবাসে, আরো কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা হয়,
‘Persons committing genocide or any of the other acts enumerated in Article III shall be punished whether they are constutionally responsible rulers, public officials or private individuals (Article IV). Such persons shall be tried by a competent tribunal of the state in the territory of which the act was committed, or by such international panel tribunal as may have jurisdiction with respect to those contracting parties which shall have accepted its jurisdiction.’
জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে জেনোসাইড-এর ব্যাখ্যামূলক বার্তায় আরো বলা হয়,
‘In view of statement,mentioned in your cable under reply and of doubt as to whether state of warlegally existed in
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ‘যুদ্ধাপরাধ’ কথাটি যুদ্ধকালে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করে পূর্ব পাকিস্তানে একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধাবস্থা ছিল কিনা এমন কূটতর্ক উত্থাপন করতে চেয়েছিল বলে অনুমিত হয়। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সদর দপ্তর স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়, যুদ্ধাপরাধের চাইতে গণহত্যা অভিধার ব্যবহারই কাম্য এবং গণহত্যা শান্তিকালে যেমন সংঘটিত হতে পারে তেমনি যুদ্ধাবস্থাতেও হতে পারে, যে-অবস্থাতেই ঘটুক না কেন জেনোসাইড আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
এই আলোচনার ফলাফল হিসেবে আমরা দেখি সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে জাতিসংঘ কর্মকর্তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন। উভয় সরকার প্রধানের যুগপৎ বিবৃতি এবং আগামী পদক্ষেপের একটি কর্মপরিকল্পনাও তারা তৈরি করেছিলেন যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপায়ে গণহত্যাকারীদের বিচারে পাকিস্তান সম্মত হবে বলে আশা করা হয়। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয় নি, জাতিসংঘও বিচারের জন্য প্রকাশ্য কোনো অবস্থান নেয় নি।
বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চূড়ান্ত ব্যর্থতার পটভূমিকায় ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ প্রণয়ন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন।’ বিচারের লক্ষ্যে সরকার একটি প্রসিকিউশন টিমও গঠন করেছিল, তবে বিচারকার্যে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় নি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নানা দিক দিয়ে নাজুক হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের স্বীকৃতি দেশটির জন্য ছিল বিশেষ জরুরি। এমনি পটভূমিকায় ১৯৭৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে লাহোরে আয়োজিত হলো ইসলামী দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলন ঘিরে আবারও সামনে আসে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং সকল যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণের বিষয়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন পাকিস্তানের স্বীকৃতি হতে হবে নিঃশর্ত এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিতে তিনি কখনো সম্মত ছিলেন না।
ও.আই.সি মহাসচিব স্বয়ং ঢাকায় এসে আহুত শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু এই সুবাদে তাকে বলেন যে, প্যালেস্টাইনি জনগণের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য তিনি লাহোর যেতে আগ্রহী, তবে যাবেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে এবং পাকিস্তানের স্বীকৃতি সেজন্য প্রদত্ত হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে কুয়েতসহ বেশ কিছু দেশ পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য, অন্যদিকে এই স্বীকৃতির সঙ্গে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের শর্ত যুক্ত করতে মরীয়া হয়ে ওঠে ভুট্টো। লাহোর যাবার পথ ঘুরিয়ে কুয়েতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী শেখ সাবাহ আসেন ঢাকায়, গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে পাকিস্তানের স্বীকৃতির আয়োজন করেন। শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে টেলিপ্রিন্টারে খবর আসে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির প্রশ্ন নিষ্পত্তি না করেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান। শর্তহীন এই স্বীকৃতি ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক নৈতিক বিজয়। এই স্বীকৃতির পরই বঙ্গবন্ধু যোগ দেন লাহোর সম্মেলনে এবং ইসলামী দেশের নেতৃবৃন্দ দ্বারা বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। সেই সাথে এটাও লক্ষণীয়, সম্মেলনে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এসে বাংলাদেশকে অভিনন্দিত করে বঙ্গবন্ধুর কাছে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার আবেদন জানান।
পাকিস্তানের স্বীকৃতির পরও জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রবেশাধিকার পায় নি, চিন তখনও দাবি করছিল যুদ্ধাপরাধীসহ সকল যুদ্ধবন্দি প্রত্যার্পণের। অন্যদিকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি প্রদানের পর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপর নেমে এসেছিল প্রবল চাপ। এই পটভূমিকায় ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে যুদ্ধপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আজিজ আহমেদ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, যদি অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে তবে পাকিস্তান এর বিচার করবে। পাকিস্তানই পাক-যুদ্ধপরাধীদের বিচার করবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে তাদের দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে সমর্পণ করতে সম্মত হয়। এর ফলে নিশ্চিত হয় জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার যা অচিরেই ঘটে এবং সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে বাংলায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রয়াসী হওয়ার জন্য এভাবেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, যার মূল্য বিপুলভাবে দিতে হয়েছে বিশ্বসমাজকে, গণহত্যার থাবা বিস্তার পেয়েছে দেশে দেশে, সভ্যতার অবমাননা রয়েছে অব্যাহত এবং আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা গণহত্যার মোকাবিলার চেষ্টা পিছিয়ে গিয়েছিল আরো অন্তত দুই দশক।
তিন
পাশ্চাত্যের সভ্যতার দম্ভ চূর্ণ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পতাকা বহন করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বিশ্বসম্প্রদায় যখন গণহত্যাকারীদের বিচার রোধে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রবল থেকে প্রবলতর করছিল সেই পটভূমিকায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছিল ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন। এরপর খুব বেশিদিন পার হতে পারে নি, ১৯৭৫ সালের আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-নিধন পালা সম্পন্ন করলো ঘাতকদল, শুরু হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়। সেই কৃষ্ণ সময়ে ১৯৯১ সালে গণহত্যার অন্যতম প্রধান হোতা জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের দেশে ফেরা এবং রাজনৈতিক অধিষ্ঠানের প্রতিবাদে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন অভূতপুর্ব এক গণজোয়ার বইয়ে এনেছিল দেশব্যাপী। আন্তর্জাতিকভাবে যা হয়েছিল উপেক্ষিত ও বিস্মৃত, জাতীয়ভাবে অস্বীকৃত ও পদদলিত, গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের সেই প্রশ্ন আবার পরিণত হলো জাতীয় ইস্যুতে। গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠান জনগণের শক্তির নতুন উদ্ভাবন বয়ে আনলো। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ক্রমান্বয়ে পৌঁছে যাই ২০০৮ সালের নির্বাচনী রায় এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে বিচারকাজ সূচিত করবার প্রক্রিয়ায়।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বিশ্বজনীন তাৎপর্য অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। এই বিচার একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতা নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে গণহত্যাকারীদের সমর্থক দেশ ও গোষ্ঠী পরোক্ষভাবে বিশেষ অবদান রেখেছে এবং এটা সার্বজনীন স্বীকৃতি অর্জন করেছে যে, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটেছে এবং তার জন্য দায়ীদের বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। সমালোচকরা ইতিহাস অস্বীকার করতে পারে নি, ইতিহাসের নব-স্বীকৃতি প্রকারান্তরে তারা দিয়েছে, তবে বলার চেষ্টা করেছে এই বিচার যথাযথ হচ্ছে না, বিচার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা যারা ঘটায় তারা সমাজ থেকে উদ্ভূত পরাক্রমী শক্তি। অন্ধকার এই শক্তি যখন পরাভূত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয় তখন সমাজ থেকে তারা নির্মূল হয়ে যায় না। এই অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্যই চলে সভ্যতার সংগ্রাম এবং সেই লড়াই কোনো সহজ কাজ নয়। ফলে বিচারের বাণী যখন নিভৃতের ক্রন্দন ঘুচিয়ে আপন শক্তিতে জেগে ওঠে তখন তা প্রশ্নবিদ্ধ ও নস্যাৎ করবার আয়োজনও নানাভাবে তৎপর হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদীরা হালে পানি বিশেষ পায় নি, বরং একাত্তরকে লোকস্মৃতিতে আবার তারা ফিরিয়ে এনেছে এবং এর ঐতিহাসিক স্বীকৃতির পথ উন্মোচন করেছে। উল্লেখ্য, গণহত্যার স্বীকৃতি কোনো ফোরাম বা কর্তৃপক্ষের দ্বারা আদায় হওয়ার নয়, বরং তা ইতিহাসে স্বীকৃত হওয়ার বিষয়, যে প্রক্রিয়া এখন নানাভাবে সূচিত হয়েছে। একাত্তরে বিশ্ব-সমাজ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশে গণহত্যা ঘটে চলেছে এবং তা রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আজ সচেতন বিশ্ব-সমাজ বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে বিচারকাজে ন্যায়ের প্রতি বাংলাদেশের আনুগত্য কামনা করছে। এর লক্ষণ আমরা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠতে দেখছি। বিচারের বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, এমন কি সমালোচনা ব্যক্ত হলেও বিচারকাজের প্রতি সমর্থন রয়েছে দ্বিধাহীন। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে এমনটা স্বাভাবিকভাবে লক্ষিত হয়। কোনো আদালতই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, কাম্বোডিয়ার ইসিসিসি বা মিশ্র আদালতে হাতে-গোনা কতক অভিযুক্তের বাইরে আর কাউকে অভিযোগের আওতায় না আনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তা বিচার-প্রক্রিয়াকে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ করে না। হেগে অবহিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আফ্রিকা-বিদ্বেষে ভারাক্রান্ত হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছে কোনো কোনো মহল দ্বারা, যেন আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে তারা কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এই সমালোচনা আদালতের এখতিয়ার বা বিচারপ্রক্রিয়া ক্ষুণ্ণ করছে না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিষয়ে সমালোচনা মূলত উত্থাপিত হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ঘিরে এবং আন্তর্জাতিক মানের ফাঁকা বুলি তুলে। এসবের দ্বারা জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তারা ক্ষুণ্ণ করছে এবং বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়া বিতর্কিত করবার চেষ্টা নিয়েছে। কিন্তু এমত চেষ্টা ভাড়াটে লবিস্ট, মুখচেনা মহল, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে অজ্ঞ কতিপয় মানবাধিকার সংস্থার মধ্যে সীমিত থাকছে। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে আল-জাজিরা কিংবা ইকনমিস্ট-এর মতো গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার রীতি-নীতি বিবর্জিত প্রচারণা। এটা দুঃখজনক যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শক্তিশালী গণমাধ্যম সেল গঠনে উদ্যোগ নেয়া হয় নি, আন্তর্জাতিকভাবে বিরুদ্ধবাদীদের সংগঠিত প্রচারণা মোকাবিলায় সরকারের সংগঠিত উদ্যোগও দৃষ্ট হয় নি। তারপরও দেখা গেছে ট্রাইবুন্যাল কিংবা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যেটুকু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে সাড়া পাওয়া গেছে বিপুলভাবে। সেইসাথে রয়েছে বিশ্বসমাজের অবস্থান, একাত্তরে যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে দেশে দেশে নাগরিক সমাজের সংহতি গড়ে উঠেছিল মানবতার বিপর্যয়ে মানবিক সহমর্মিতার, বর্তমান পটভূমিকায় আমরা উপলব্ধির ও সংহতির তেমনি এক বিস্তার লক্ষ্য করতে পারি। বিগত দশকগুলোতে গণহত্যা প্রতিরোধে বিশ্বসমাজের কর্মকাণ্ড অনেকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, গণহত্যা সংক্রান্ত ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চার ক্রমবৃদ্ধি ঘটছে এবং সেখানে একাত্তরের গণহত্যা ক্রমে বিস্মৃতির আড়াল ঘুচিয়ে উঠে আসছে স্মৃতিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরের বাস্তবতা নিয়ে। গ্যারি জে. বাস, শ্রীনাথ রাঘবন, সলিল ত্রিপাঠি, নয়নিকা মুখার্জি প্রমুখ উচ্চতর-মানসম্পন্ন তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা-বই প্রকাশ করেছেন। এর বিপরীতে গণহত্যার সাফাই গাইবার একমাত্র গ্রন্থের রচয়িতা, দুর্ভাগ্যক্রমে বাঙালি নারী শর্মিলা বসু, যা গবেষণা কিংবা রচনামানে একান্ত নিম্নশ্রেণীর, ফলে সাময়িক বিতর্কের খোরাক হওয়ার বাইরে এর কোনো প্রভাব সঞ্চারিত হয় নি। গণহত্যা-বিষয়ক গবেষণা কিংবা গণহত্যা-প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে যারা সক্রিয় তাদের কাছে একাত্তর এখন বিশেষ অধ্যয়নের বিষয় হয়ে উঠছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের বিগত সম্মেলনগুলোতে, ইতালি, কানাডা কিংবা আর্মেনিয়ায় যা অনুষ্ঠিত হয়েছে, দেখা গেছে একাধিক পেপার উপস্থাপিত হয়েছে একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ঘিরে অ্যাকাডেমিক আগ্রহের বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি। আমেরিকা, ইংলণ্ড, কানাডা ও জার্মানির একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি পর্যায়ের গবেষকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন। এই প্রবণতার সঙ্গে মিলে জাতীয় কর্তব্য জোরদার করা এখন বিশেষ গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রেক্ষপটে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্ন বহন করে বিশেষ গুরুত্ব। একাত্তরের গণহত্যার বিচারের অসমাপ্ত কর্তব্য কোনোভাবেই ইতিহাসের ও বিশ্বসমাজের বিবেচনার বাইরে থাকতে পারে না, কিংবা আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তা পার পেয়ে যেতে পারে না। ভুক্তভোগী জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে এই দাবি জোরের সঙ্গে বিশ্বসমাজের সামনে পেশ করতে হবে, আর সেজন্য অনেক গবেষণা, প্রকাশনা, বক্তব্য-বিবৃতি সামনে আনতে হবে। এই বিচার নিছক আইনের প্রশ্ন নয়, নৈতিকতা ও ন্যায়ের প্রশ্ন এখানে মুখ্য এবং গণহত্যা থেকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পাকিস্তান গণহত্যাকারী দেশ, পাকিস্তান গণহত্যা-অস্বীকারকারী দেশ। যারা গণহত্যার সংঘটক তারা যে গণহত্যা অস্বীকার করবে সেটা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ঐতিহাসিকরা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করেন। অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় ঘাতক মানস। জেনোসাইড-ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স-এর এককালের সভাপতি গ্রেগরি স্ট্যানটন গণহত্যার তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন এবং কীভাবে গণহত্যা সংঘটিত হয় তার দশটি ধাপ চিহ্নিত করেছেন। তার এই সোপানের সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে ‘ডিনাইয়াল’ বা ‘অস্বীকৃতি’। গণহত্যা সম্পাদন করে স্বাভাবিক রীতিতে পাকিস্তান এখন দশম ধাপে অবস্থান করছে এবং তারস্বরে অস্বীকার করতে চাইছে তাদের কৃত গণহত্যার বাস্তবতা। ঘাতকের এই মানসিকতা থেকে পাকিস্তান মুক্তি পাবে না যতদিন না সেই দেশটি একাত্তরে তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের স্বীকৃতি প্রদান করবে। পাকিস্তান যদি সভ্য দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় দাঁড়াতে চায় তবে তাদের চিহ্নিত করতে হবে জেনোসাইডের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের এবং বিচারের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড় করিয়ে সম্পন্ন করতে হবে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া। যতদিন এটা না ঘটবে ততদিন পাকিস্তান রাষ্ট্র জেনোসাইডের কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে না। নুরেমবার্গ ট্রায়াল এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন স্মারক পদক্ষেপের মাধ্যমে জার্মান জাতি নাৎসি দল, গোষ্ঠী ও মতাদর্শের সঙ্গে নিজেদের ফারাক রচনা করতে পেরেছে। ষাট বছর পরে হলেও বার্লিনে প্রতিষ্ঠা করেছে হলোকাস্ট মেমোরিয়াল এবং জুয়িশ মিউজিয়াম, ক্ষতিপূরণ দিয়েছে নাৎসি শিবিরে নির্যাতিত, নিহত, আটককৃত সকল ব্যক্তি ও পরিবারকে এবং এভাবেই রচনা করেছে দায়মুক্তি। পাকিস্তান সে-পথে অগ্রসর হওয়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারে নি, পারে নি বলেই সংঘাত ও সন্ত্রাসের দুষ্টচক্র থেকে দেশটি বেরিয়ে আসতে পারছে না এবং পৃথিবীর কাছে চিহ্নিত হচ্ছে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে, সহিংস ইসলামের লালনক্ষেত্র রূপে।
ধর্মকে ব্যবহার করে একাত্তরের গণহত্যা সংঘটিত করেছিল পাকিস্তান। এর অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ধারায়। জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল কীভাবে সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধর্মের নামে ব্যাপক নৃশংসতায় সেনা বাহিনীকে প্ররোচিত করলো, কীভাবে দলের তরুণ ছাত্র-সদস্যদের ঘৃণ্য ঘাতকে পরিণত করলো, জামায়াতের তৎকালীন নেতৃত্ব ও ছাত্রসংগঠনের প্রধানদের বিচারে এর স্বরূপ নানাভাবে উদঘাটিত হয়েছে। সেইসাথে পাকিস্তানি সমরনায়কদের সভ্যতার মুখোশ ও ধর্মের মুখোশ খসে পড়ে তাদের সংহারক ভূমিকা সুপ্রমাণিত হয়েছে। আদালত অবশ্য নিবিষ্ট ছিল অভিযুক্ত ব্যক্তির কৃতকর্মের প্রতি; কিন্তু জেনোসাইড ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের স্বরূপ বিচারে প্রসিকিউশন যেমন বড় ছবি মেলে ধরেছে, তেমনি আদালতও বৃহত্তর পটভূমি বিবেচনায় নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ায় জেনোসাইডের দায় থেকে পাকিস্তানের মুক্তি মেলে নি, বরং তাদের মুখ্য ভূমিকা বারবার আদালতে উঠে এসেছে। এখানে স্মর্তব্য, জেনোসাইড সংগঠিত হয় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে, আইনের ভাষায় ‘জয়েন্ট ক্রিমিন্যাল এন্টারপ্রাইজ’ দ্বারা, সেই সংগঠনে মুখ্য ও গৌণ বলে কিছু নেই, এর প্রতিটি কম্পোনেন্ট বা অংশীই সমভাবে অপরাধী, আর তাই অপরাধী হিসেবে জামায়াতের নেতা ও পাকিস্তানি জেনারেল সমভাবে দায়ী। আদালতে পরিস্ফূট ঐতিহাসিক সত্য এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন এখন বড়ভাবে সামনে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে বাস্তব সমস্যা অনেক রয়েছে, কিন্তু সমস্যা উত্তরণের পথও নিশ্চয় লভ্য।
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো আন্তর্জাতিক আইনের সীমাবদ্ধতা। ২০০২ সালে রোম সংবিধি গ্রহণের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক আদালত যাত্রা সূচনা করেছে বিধিবদ্ধভাবে তারা পূর্বতন ঘটনা বিচারের এখতিয়ার রাখে না, ২০০২ সাল থেকে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচারে পদক্ষেপ নিতে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ। অন্যদিকে বাংলাদেশের আদালত এ-দেশের নাগরিকদের বিচারের অধিকার রাখে, এমন কি অভিযুক্ত দেশের বাইরে প্রকাশ্যে বা গোপনে অবস্থান করলে সমন জারি করতে পারে; কিন্তু দেশের বাইরে থেকে এনে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার ক্ষমতা আদালতের নেই, তবে রয়েছে অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিচার করবার অধিকার। ইন এবসেনসিয়া ট্রায়ালের কোনো সুযোগ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় কিনা সেটা আইন বিশেষজ্ঞরা বিচার করবেন, আমরা নাগরিক-সমাজ থেকে কেবল এটুকু বলতে পারি এ-বিচার অবশ্যই হতে হবে।
কীভাবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী তথা জেনোসাইডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হতে পারে সে-প্রশ্ন সমাধান করে অগ্রসর হওয়ার চাইতে বড় বিষয় এই বিচারের প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম ও রায়, প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশনের ভূমিকা, সাক্ষীদের অবদান ইত্যাদি নানা বিষয় বিশদভাবে তুলে ধরা দরকার। জেনোসাইড সংঘটনের জন্য রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক শক্তির আঁতাত, মহৎ মতাদর্শের চরম অবমাননাকর বিকৃতি ও ব্যবহার এবং এসবের পেছনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শের ভূমিকা আদালতের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে তীক্ষ্ণভাবে উঠে এসেছে এবং তা ব্যাপকভাবে মেলে ধরা দরকার। বিচারের মাধ্যমে বিপুল তথ্য-উপাত্ত, দলিলপত্র এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ জড়ো হয়েছে। এর সর্বাত্মক ও সার্থক ব্যবহার এখন বিশেষ জরুরি। এসব উপাদান নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্ম, তারা সংগঠিতভাবে যত দুর্বলই হউক, তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি নাগরিক সমাজের সেইসব প্রতিনিধিদের যাদের সঙ্গে শাহরিয়ার কবির ও নির্মূল কমিটির যোগাযোগ রয়েছে। আরো স্মরণ করি আহমেদ সালিমের কথা, যার উদ্যোগে লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র উর্দু সংস্করণ।
জেনোসাইডের জন্য দায়ী পাকিস্তানিদের বিচারের দাবি আজ যখন তোলা হবে তখন তা কেবল ১৯৫ যুদ্ধবন্দি যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না, অভিযুক্তদের মধ্যে শীর্ষ পাকিস্তানি সমরনায়কেরাও রয়েছে, যাদের পাঁচজনকে দায়ী করে বিচারের কথা পাকিস্তানের হামিদুর রহমান কমিশনও উত্থাপন করেছিল। বিচারের দাবি যখন জোরেশোরে সামনে চলে আসবে তখন বিচারের পথ কোনো না কোনোভাবে খুলে যাবে। ইতিহাসে সেই নির্ভরতার পরিচয় দাখিল করে গেছেন জাহানারা ইমাম ‘গণআদালত’ গঠন দ্বারা। এই গণআদালত নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইতালি-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল বা পিপিটি। ব্যাপক নৃশংসতার যে-সব ঘটনা বিচারের বাইরে রয়ে যায় পিপিটি তা বাস্তবায়নে কাজ করে। প্রতি বছর তারা একটি করে ঐতিহাসিক নৃশংসতার শুনানি ও বিচারের ব্যবস্থা করে। বিগত বছর নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতমান বিচারকরা শুনানি শেষে প্রদান করেছেন তাদের পর্যবেক্ষণ ও রায়। জেনোসাইডের জন্য দায়ী পাকিস্তানি অপরাধীদের এমনিভাবে আন্তর্জাতিক গণআদালতে দাঁড় করাবার জন্য যথোচিত প্রস্তুতি আমাদের দরকার। সেই দায়িত্ব সম্পাদনের প্রত্যয় তো আমরা খুঁজে পাই জাহানারা ইমামের জীবনকর্মে। তাকে নিয়ে সত্য ও ন্যায়প্রতিষ্ঠায় আমাদের পথচলার তাই বিরাম নেই। তিনি ঘোষণা করেছেন সত্যের মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তির এবং সেই প্রেরণাতে আমরা পথ কেটে এগিয়ে যাব সুন্দর আগামীর দিকে যখন দূর হবে ধর্মীয় সহিংসতা, জাতিসত্তার মধ্যে মানুষ খুঁজে পাবে সম্প্রীতিতে বসবাসের নির্দেশনা, সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে মানবিক মিলন রচনার হদিশ। সেই লক্ষ্যে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘গণআদালত’, গণহত্যাকারীদের বিচারে বদ্ধ-দুয়ার ভেঙে দিয়েছিল যে আয়োজন। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও তাই তিনি আমাদের প্রেরণা ও পথ-প্রদর্শক। জয় হোক ন্যায় ও সত্যের, জয় হোক বাংলার ও বিশ্বমানবতার।
উপসংহার
এখনই সময় পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী গণহত্যাকারীদের বিচারের ও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার। ১৯৫ চিহ্নিত ও আলোচিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের যে-প্রক্রিয়া যুদ্ধ-উত্তর জটিল জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় সূচিত হয়েছিল তাতে ছেদ পড়লেও এখন আবার তার নব-উত্থান দৃশ্যগোচর হচ্ছে। ইতিহাসের চাকা পুনরায় সচল করবার পরিস্থিতি তৈরি করেছে বাংলাদেশ দীর্ঘ চার দশকের পরেও গণহত্যা ও মানবতা-বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এ-দেশীয় নাগরিকদের বিচার শুরু ও সম্পাদনের পথে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান-সহ বিচারের বিরুদ্ধবাদীরা যে শোরগোল তুলেছে সেটা প্রকারান্তরে গণহত্যার স্বীকৃতি জোরদার করেছে এবং পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন আবার সামনে নিয়ে এসেছে। সমালোচকরা যখন বলতে চাইছে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় ইতিহাসের মীমাংসিত অধ্যায়, ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে তার সুরাহা হয়ে গেছে, তখন এই বক্তব্যেই প্রকাশ পায় পাক-যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি মীমাংসিত হয় নি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া এর কোনো সুরাহা হতে পারে না।
১৯৭৪ সালে যে-পরিস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি আজ ২০১৬ সালে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তার থেকে বিপুলভাবে আলাদা। গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন অনেক অঙ্গীকারাবদ্ধ ও সংগঠিত। ধর্মকে ব্যবহার করে যারা গণহত্যা ঘটিয়েছিল তাদের বিচার না হওয়ায় যে-বিষ সমাজদেহে সঞ্চারিত হয়েছে তার কুফল উপমহাদেশ প্রতিনিয়ত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। শান্তি ও সম্প্রীতির নতুন পৃথিবী গড়বার সংগ্রাম এখন আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে অধিক গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অগ্রণী ও উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথরেখা তৈরি করতে হবে। সেজন্য আমাদের দিক থেকে আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার বিশেষ জরুরি। সেই লক্ষ্যে প্রথমত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, অতীতে তাদের চিহ্নিত করবার সময় সুনির্দিষ্ট যেসব অভিযোগ বা রহফরপঃসবহঃ দাঁড় করানো হয়েছিল সেসব দলিল-দস্তাবেজ পুনরুদ্ধার করা দরকার। সেইসাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্তদলকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব দিতে হবে ১৯৫ পাক-যুদ্ধাপরাধীর কৃতকর্মের বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির জন্য। পাশাপাশি ব্যক্তির অপরাধের সঙ্গে মিলিয়ে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বৃহত্তর চিত্র মেলে ধরা জরুরি। এই কাজ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাদের পর্যবেক্ষণ ও রায়ের মধ্য দিয়ে সম্পাদন করে গেছেন। এখন প্রয়োজন সেখান থেকে উপাদান আহরণ করে গণহত্যার প্রকৃতি, ধরন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমন্বিত ভাষ্য তৈরি, সেইসঙ্গে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের স্থানীয় পর্যায়ে অপারেশন ও নৃশংসতার বিবরণ তদন্ত তথা ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে সবিস্তার উদঘাটন। এমনি কর্তব্য সম্পাদনের পাশাপাশি চলবে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে নাগরিকসমাজের যথাবিস্তৃত সংহতি রচনা। এইসব কাজ নানাভাবে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। একে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে এখন প্রয়োজন সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ। ন্যায় ও সত্যপ্রতিষ্ঠার এই অভিযাত্রায় বাংলদেশ ও বিশ্বসমাজ সফলকাম হবে, সেটা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তবে সেজন্য সামনে আরো পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে।
জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ২০১৬
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)