একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বেলুচিস্তানকেও স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করতে বলেছিল বাংলাদেশ। ওই দিন লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে বালুচদের যুদ্ধ শুরুর পরামর্শ দিয়েছিলেন মুজিবনগর থেকে পরিচালিত বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। কিন্তু বালুচ নেতাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হয়নি।
স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ‘দ্য ওয়্যারে’ এক লেখায় এসব কথা তুলে ধরেছেন সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকা তৎকালীন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরপরই একটি বৈঠক ডাকেন আব্দুস সামাদ আজাদ। লন্ডনের ট্রাফালগায়ারের কাছে চ্যারিং ক্রস হোটেলে ওই গোপন বৈঠক হয়। সেখানে সংখ্যালঘু প্রদেশের জাতিগত-উপ-জাতীয় সিনিয়র নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৯৭০-৭১ সাল জুড়ে এসব নেতারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের আজাদ বলেন, বাংলাদেশে যেটা হয়েছে এ ধরনের চরম রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক নির্যাতন, পরাধীনতাসহ সংখ্যালঘু প্রদেশের বঞ্চনা অসহনীয় হতে পারে। এজন্য তিনি ভারতীয় সহায়তা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানান। আর এজন্য আজাদ এটাও জানতে চেয়েছিলেন সংখ্যালঘু প্রদেশের নেতারা তার পূর্বোক্ত বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত কি না।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে জানা থাকার কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর জন্য কিছু শর্তের কথাও আজাদ উল্লেখ করেছিলেন বলে লিখেছেন এস ব্যানার্জী। তিনি বলেছিলেন, ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের মতো সহায়তা পেতে হলে বালুচদের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং বহুত্ববাদ সম্পর্কে অঙ্গীকার ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া তাদের নিজ নিজ জাতীয় আকাঙ্খার জন্য স্থায়ী ধর্মীয় রহস্যবাদ, অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থাকে পরিত্যাগ করতে হবে।
সভায় উপস্থিত সকল নেতাদের অকুণ্ঠ অঙ্গীকার ছিল যে, তাদের সংগ্রামে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থার সঙ্গে কিছুতেই মিলবে না এবং জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র তাদের নিজ নিজ অর্থে আকাঙ্খার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
শশাঙ্ক লিখেছেন, গোপন আলোচনায় উপস্থিত নেতারা এক গলায় বলল এই বিষয়টি অনেক আগেই আলোচনা করা হয়েছে, যাতে তারা একটি ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিয়ে প্রস্তুত হতে পারে।
কিন্তু ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের মতো ভারতের সহায়তা পাওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বালুচ নেতারা। এর এ জন্যেই সভার প্রটোকল ভেঙ্গে নওয়াব আকবার খান বুখতি বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি যে ভারত আমাদের স্বাধীনতা নিরাপদ করার জন্য আমাদের অনুরোধে পাকিস্তানের সঙ্গে কি আরেকটি যুদ্ধ করবে। সভায় উপস্থিত অন্য দুই নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এবং খায়ের বখশ মারি বুগতির একথায় তাদের শর্তহীন সমর্থন দেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে যে ফ্লাইটে দিল্লি ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে ফ্লাইটে ছিলেন এস ব্যানার্জীও। এরপর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতকারেও লন্ডনের গোপন বৈঠক নিয়ে কথা হয়।
ওই বৈঠক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানতেন কিনা ব্যানার্জীর এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি অবগত। তবে দুর্ভাগ্য যে বালুচরা তাদের ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করেছে। আর এটা হয়েছে তাদের নেতৃত্বের মতভেদের কারণে।’
এস ব্যানার্জী লেখার শেষ দিকে বলেছেন, মুক্তিবাহিনীর জন্য ভারতীয় সামরিক সহায়তা প্রদান করা সহজ হয়েছে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভারতের কৌশলগত অবস্থানের কারণে। কিন্তু বালুচদের জন্য একই রকম সহায়তা দিলে ভিন্ন ব্যাপার হতে পারতো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লন্ডনে ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী। তিনি ২০১১ সালে প্রকাশিত রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন এন্ড পাকিস্তান: এ পলিটিক্যাল ট্রিটিস’র লেখক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২০ অক্টোবর তাকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বন্ধু’, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত করেন।