ধর্ষণবিরোধী প্রবল জনমত থাকা সত্ত্বেও দেশে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কঠোর বা প্রকাশ্য শাস্তি নিশ্চিত করা হলে এসব অন্যায় নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে অনেকের দাবি। কিন্তু আসলেই কি তাই? কঠোর বা প্রকাশ্য শাস্তি কতটা কার্যকর হবে এসব অন্যায় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন: বর্তমান সময়ে ধর্ষণের তীব্রতা ও সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। যেটা উদ্বিগ্ন করছে আমাদের পরিবার এবং রাষ্ট্রকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে এই বিষয়ে কঠোর আইন আছে। কিন্তু ধর্ষণকারীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিকই কিন্তু বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে সুস্থ প্রতিকার দেখতে পাচ্ছি না আমরা।
বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন: যারা আইনটিকে প্রয়োগ করবেন তারাও অনেক সময় ধর্ষণের মামলাগুলো নিয়ে কিভাবে কাজ করবেন সেই বিষয়ে ধারণা রাখেন না। রিপোর্ট দিতেও বেশ গড়িমসি করা হয় আর রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে তাৎক্ষণিক আলামত সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। আবার দেখা যায় যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাহীন শ্রেণীর মেয়ে। তাদের সহায় সম্পত্তি আছে এমন নয়। তাদের তেমন যোগাযোগ নেই। ফলে তারা আক্রান্ত ও ভুক্তভোগী হচ্ছে বেশি।
অন্যায়কারীরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এমনকি তারা অন্যায় করে ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।
এর কারণ হিসেবে সাদেকা হালিম বলেন: দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে কিন্তু ছেলেরা সেভাবে শিক্ষা নিচ্ছে না। মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা সমাজ বা প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজ করেছি। ফলে দেখা যায় খাবার না থাকলেও সবার হাতে স্মার্ট ফোন আছে। তাতে করে সে সামাজিকীকরণ না শিখে সহজেই পর্নোগ্রাফি দেখছে। কিন্তু বয়:সন্ধিকালে সেই বিষয়টার সঙ্গে কিভাবে মানিয়ে নিবে সেসব বিষয়ে এসব ছেলেরা জানে না। ফলে তারা আরেকজনকে আক্রমণ করে বসছে।
সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন: এসব অপরাধীদের অনেককে পিটিয়ে মারা হয়েছে, এখন বলা হচ্ছে যাবৎজীবন হলে হবে না, মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেখানে কি এসব অন্যায় কমেছে? হয়তো সাময়িকভাবে প্রশমিত হতে পারে। তবে এর সঙ্গে আরো অনেক বিষয় জড়িত। যারা বেকার যুবক, স্কুল কলেজ ফাঁকি দেওয়া কিশোর বা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া সন্তান তাদের অবাধে মাদক সেবন, স্মার্টফোনের ব্যবহার কমাতে না পারলে কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? আমাদের দেখতে হবে সন্তানকে ঠিকমতো বড় করতে পারছি কিনা, মূল্যবোধ তৈরি করতে পারছি কিনা, সামাজিকতা শেখাচ্ছি কিনা।
তিনি যোগ করেন: আমরা নিরাপত্তার বিষয়ে শেখাচ্ছি কিন্তু যারা নিরাপত্তা দিচ্ছে সেসব বাসের হেলপার, গাড়ির চালকদের এসব বিষয় শেখাতে পারছি কিনা সেটাও আরো ভালোভাবে দেখতে হবে।
এ বিষয়ে একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম। তিনি মনে করেন: কঠোর শাস্তির দিকে নয়, আমাদের নিয়ম অনুযায়ী বিচারের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে একটা অন্যায় করলেও বিচারের সংস্কৃতি দেখা যায় না। এই বিচারহীনতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তারা যখন দেখবে অপরাধ করলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। তখন তা থেকে বেরিয়ে আসবে। কঠোর শাস্তি দিয়ে দুয়েকটা উদাহরণ সৃষ্টি করা যাবে। কিন্তু যে আইন আছে সেটা কার্যকর করলেই অপরাধ কমে যাবে। দীর্ঘসূত্রতা ছেড়ে তাৎক্ষণিক বিচার নিশ্চিত করলে এসব অপরাধ কমবে।
তিনি বলেন: বর্তমান সময়ে আকাশসংস্কৃতির অবাধ বিস্তার। কোনো সেন্সরশিপ নাই। কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। মা বাবাকে বাইরে কাজে থাকতে হয়। সন্তানকে সময় দিতে পারে না। ফলে তারা একা থাকছে এবং তেমন গাইডেন্স পাচ্ছে না আবার অপসংস্কৃতি তাদের হাতে। ফলে অপরাধ বাড়ছে। সেজন্য সেন্সরশিপটা আরো কড়াকড়ি করা দরকার। যেন সবার হাতে সব না পৌঁছায়। বাবা-মা বাইরে থাকলেও সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাকে ভালো মন্দের ফারাক বোঝাতে হবে।
মেয়ে সন্তানকে যেমন প্রস্তুত করতে হবে, তেমন ছেলে সন্তানকেও সবাইকে সম্মান করা শেখাতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই মনোবিজ্ঞানী।
তিনি জানান: ছেলে সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। অন্যায় হলে দোষ মেয়েদেরই, এমন ভাবনা বদলাতে হবে। সন্তানকে বোঝাতে হবে কিভাবে অন্যকে সম্মান করতে হয়। কোনটা খারাপ সেটা শেখাতে হবে আবার ভালোটাও শেখাতে হবে। খারাপ কিছু হয়তো সে করলো না, কিন্তু ভালোটাও যেন করে সেটার পথ তৈরি করতে হবে। আর ছেলে সন্তানেরা কার সঙ্গে মেলামেশা করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেদিকে নজর দিতে হবে সবথেকে বেশি।