ছোটবেলায় খেলার সাথীদের নিয়ে ইট দিয়ে শহীদ মিনার বানাতাম। শহীদ মিনার বানানোর জন্য অনেক দিন থেকেই প্রিপারেশন নিতাম সবাই। একেক জনের উপর একেকটা দায়িত্ব থাকত। একটা নির্দিষ্ট জায়গা পরিস্কার করার। তারপর ইট জোগাড় করা। কার কার বাগানে ফুল ফুটেছে সেটা দেখার জন্যও একজনকে দায়িত্ব দেয়া হতো। বাবার চাকরির সুবাদে আমরা থাকতাম সুগার মিল কলোনীতে। সে সময় সবার বাসায় সবার অবাধ যাতায়াত ছিল। প্রায় সবার বাসায় লাগায়ো সবজি বাগান আর সাথে ফুল গাছ থাকত। আমার মাও করতেন। সে সময় বিটিভিতে শাইখ সিরাজের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার মা আমাদের বাসার সাথে ফাঁকা বড় জায়গাটাতে সবজি আর ফুলের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে সারা বছর নানা রকম সবজি ফলত। ফুলও ফুটত। আমার বাবাকে দেখেছি সকালে অফিস যাওয়ার আগে বাগানের পরিচর্যা করতে। গাছে পানি দিতেন। সার দিতেন। তারপর ঠিকঠাক রেডি হয়ে অফিসে বেরিয়ে যেতেন।
শীতকালে ডালিয়া, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুটত আমাদের বাগানে। সে সময় টা ২১ আসত শীতে। তখন তো আর মোড়ে মোড়ে ফুলের দোকান ছিল না। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্য সবার বাগানই ছিল ভরসা। বিশেষ করে জিএম বাংলোয় অনেক ফুল ফুটত। সুগার মিল কলোনীর ক্যাম্পাসেও অনেক ফুল ফুটত। আমাদের বাগান থেকে একুশের রাতে যেন কেউ ফুল ছিঁড়তে না পারে এ জন্য আমার বড় ভাইয়া অনেক রাত পর্যন্ত পাহাড়া দিত। কিন্তু কিসের কি সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম একটাও ফুল নেই। তাতে আমাদের খারাপ লাগত না। কারণ জানতাম ফুলগুলো কে ছিঁড়েছে আর কোথায় যাবে।
আমারও এর ওর বাগান থেকে ফুল ছিঁড়তাম লুকিয়ে। ফুলটা ছিঁড়তে হতো অনেক রাতে খুব গোপানে। কেউ যেন টের না পায়। সেটার জন্য এক জনকে দায়িত্ব দেয়া হতো। খুব ভোরে সবাইকে উঠতে হবে। এই উত্তেজনায় সারারাত আমরা জেগে থাকতাম। কখন ভোর হবে আর সবাই যার যার বাসা থেকে বের হয়ে এক সাথে জড়ো হবো।
খুব ভোরে ইট দিয়ে বানানো শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। তখন শুধু বুঝতাম ভাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়ে গেছেন তাদের এভাবেই শ্রদ্ধা জানাতে হয়। তখন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফ্রেবুয়ারী গানটা শুনলে চোখ ভিজে যেত অজানা আবেগে। আমরা ইট দিয়ে বানানো শদীদ মিনারে ফুল দেয়ার আগে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে গানটা গাইতাম। এই গানের মতো পৃথিবীর আর কোন গান আমাকে শিহরিত করতে পারে না। আমি দেখতাম ছোট্ট বেলার সেই খেলার সাথী, সূবর্ণা, লোপা, ফিরোজা, মায়া, মিতা, কবিতা, মুন্নি, বিকাশ, মানিক, স্বপ্না, কৃষ্ণা, পার্থ ওদের চোখও চিকচিক করতো গানটা গাওয়ার সময়। ছোট বেলায় আমাদের বাসায় যে গৃহপরিচারিকা ছিল ওর নাম ছিল হাসিনা। বয়সে আমাদের বড় হলেও সেও আমাদের কাছে পড়ত, খেলতও। তার কাছে আমরা চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনতাম। সে অনেক ভ’তের গল্প জানত বলে আমাদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। সেও কাজ ফাঁকি দিয়ে আমাদের প্রভাত ফেরিতে চলে আসত। হাসিনাকে আমাদের দলে নেয়ার আরেকটা কারণ ছিল, দুপুরে আমরা যে পিকনিকটা করতাম তার অনেক দায়িত্ব হাসিনাকে দেয়া হতো। রান্নাটা মূলত সেই করত।
ফুল দেয়ার পরও আমরা শহীদ মিনারের জায়গায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান খেলতাম। কেউ গান করতাম, কেউ আবৃত্তি। এসব চলত দিনভর। আমরা চেষ্টা করতাম যেন শহীদ মিনার টা ভেঙ্গে না যায়। কিন্তু কোন এক সকালে গিয়ে দেখতাম কেউ না কেউ সেটা ভেঙ্গে দিয়েছে। তখন খুব কষ্ট হতো। কেন হতো সেটা বোঝার মত বয়স না হলেও মনে হতো আহা! শহীদ মিনারটা বাঁচাতে পারলাম না!
যখন স্কুল জীবন শুরু হলো তখনও ভোরে প্রভাত ফেরীতে খালি পায়ে হাঁটতাম। ২১ আসার ২/৩ দিন আগে দেখতাম আমাদের স্কুল মাঠে শহীদ মিনার বানানো হচ্ছে। ইট আর সিমেন্ট দিয়ে। পরে তাতে সাদা চুন দেয়া হতো ঠিক একুশের আগের রাতে। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত স্কুলের সব ছাত্র ছাত্রী খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে যেতাম। আর গাইতাম আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী…আমি কি ভুলিতে পারি। প্রভাত ফেরি শেষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হতো। এরপর সবাই ফুল দিতাম শহীদ মিনারে। ফুল দেয়ার কিছুক্ষন পরেই দেখতাম শহীদ মিনারটা ভাঙ্গা। সেই ভাঙ্গা শহীদ মিনারের ইটগুলো দিয়ে আমরা বিকেলে খেলতাম। বড় ভাইদের ফুটবল খেলা দেখার সময় দেখতাম ওটার উপরও অনেকে বসে খেলা দেখছে। কিন্তু কখনো কাউকে বলতে শুনিনি ওই স্কুল মাঠে একটা স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি হোক। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাথরিতী গান করতাম। ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ দুপুর বেলার ওক্ত। বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায় বরকতেরই রক্ত…। সবাই কোরাস গাইতাম..মা গো ভাবনা কেন..আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে….তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি.. তোমার ভয় নেই মা..আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। অথবা আবৃত্তি করতাম আসাদের শার্ট।
সকালে চ্যানেল আইতে প্রচারিত একটা নিউজ দেখে ফিরে গেলাম অতীতে। যেখানে চ্যানেল আইয়ের বেনাপোল প্রতিনিধি সাজেদুর রহমান তথ্য পাঠিয়েছেন, যে সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্বেও যশোরের বেনাপোল ও শার্শায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার নেই। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। বেনাপোল ও শার্শা উপজেলায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা মিলে মোট ২শ’ ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২৬টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮টি এবং কলেজে ৩টি শহীদ মিনার আছে। তবে ১শ’ ৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শহীদ মিনার নেই। শিক্ষার্থীদের ৫২’র ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরতে এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
ক্লাস টেন পর্যন্ত আমার জীবনে একই নিয়মে একুশ আসত। সব চলত নিময় মতো শুধু একটা শহীদ মিনার হতো না স্কুল মাঠে। একটা স্থায়ী শহীদ মিনার। এখন বড় বেলায় শহীদ মিনারে যাওয়া হয় না আর। কর্মব্যস্ত জীবনে হারিয়ে গেছে প্রভাত ফেরীও। তবুও একুশ এলেই কানে রিন রিন করে বাজে..আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী..আমি কি ভুলিতে পারি। আমি অফিসে বসে কাজ করি আর গুন গুন করি। শিহরিত হই। পেছনে হাতছানি খেলার সাথীদের। ইটের শহীদ মিনার। ঝাপসা। আমার আর ফেরা হয় না শহীদ মিনারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)