২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। দিনটি এক ভয়াবহ দু:স্বপ্ন হয়েই এসেছিলো হৃদয়, হারবানু এবং সাদ্দামের মতো মানুষগুলোর কাছে।
আগের দিনই ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছিলো। তাই অন্য সব অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শুধু বাকি ছিলো গার্মেন্টস কারখানাগুলো। ফ্যাক্টরির পক্ষ থেকে জোর করে পরের দিন পোশাককর্মীদের আসতে বাধ্য করা হয়, এমনটাই জানান সেই দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক মাহমুদুল হাসান হৃদয়।
তিনি বলেন, তখন আমার বিয়ের বয়স মাত্র ৭ দিন আর চাকরির বয়স ১৩ দিন। এরমধ্যেই এতো বড় ঝড় আমার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এই ঘটনাকে আমরা দুর্ঘটনা বলবো না, বলবো হত্যাকাণ্ড।
‘সেই ঘটনায় আমি আমার পা হারিয়েছি। আজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছি। নিজেকে শেষ করে দিতে বিষও খেয়েছি, কিন্তু মরতে পারিনি। বাবার বয়স ৮৮ বছর। এই বয়সে এসে তিনি কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন, আর সেটা আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে।’ এভাবেই নিজের দু:খের কথা বলছিলেন হৃদয় ভাঙা হৃদয়।
আগের দিন ২৩ এপ্রিল ফাটল দেখা গিয়েছিলো ৯ তলা উঁচু বিশাল সেই ভবনে। সেদিনই ছুটি দিয়ে দেয়া হয় ভবনে থাকা বাকি সবগুলো অফিসে। কেবল খোলা থাকে গার্মেন্টস কারখানাগুলো।
চাপা আতঙ্ক নিয়ে কাজ করতে এসে পরদিনই ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন পোশাককর্মীরা। নিমিষেই পুরো ভবন ধসে পড়ে চোখের সামনে। ভবনের নিচে চাপা পড়ে সাড়ে ৫ হাজার পোশাকশ্রমিক।
ওই ঘটনায় ১,১৩৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত ও পঙ্গু হয় প্রায় দুই হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় ২,৪৩৮ জনকে।
হৃদয়ের মতো একই পরিস্থিতিতে হারবানু বেগম। ভবন ধসে পড়ার সময় মাথায় আঘাত পান তিনি। নিতে হয় ১৫টি সেলাই। আর এই আঘাত এখনো তাকে ভোগায় প্রতিনিয়ত। হাতে কোনো কাজ করতে পারেন না। জীবনই বলতে গেলে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার।
সাদ্দাম হোসেন লস্করের গল্পটা একটু ভিন্ন। রানা প্লাজায় তার অফিস ছিলো না। পাশের ভবনে নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের ডিলার পয়েন্ট। সেখানেই চাকরি করতেন সাদ্দাম।
সেসময় মিটিং চলছিলো। হুট করে ভবনটি কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প মনে করলেও পরে বুঝতে পারেন পাশের ভবনটি ধসে পড়েছে এই ভবনের উপর। টেবিল আর চেয়ারের মাঝে একেবারে চাপা পড়ে যান সাদ্দাম।
প্রথমে টেনেও বের করতে পারেনি স্থানীয় জনগণ। পরে সবকিছু সরিয়ে তাকে বের করে আনা হয়। কিন্তু কাটা পড়ে ডান হাত। ডান পায়েও অপারেশন করতে হয়। মাথার আঘাতটাও বেশ তীব্র ছিলো। মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। কান পুরো ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেটা সেলাই করে জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডান হাত ছাড়াই আরেকজনের সাহায্যে মাস্টার্স পরীক্ষায় বসেছেন সাদ্দাম। কিন্তু এখন চাকরি ছাড়া বেকার সময় কাটাচ্ছেন তিনি। বাকি জীবন নিয়ে শুধুই হতাশায় সাদ্দাম হোসেন।
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১৪ মে পর্যন্ত চলে উদ্ধার অভিযান। শুধু সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস নয়, উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউটসহ অনেক সাধারণ মানুষও।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারও ছিলেন উদ্ধারকর্মীদের দলে। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ভবন ধসে অনেক মানুষ নিহত হয়েছে। তবে সেসময় আমাদের মনে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা আসছিলো সেটা হলো অনেক মানুষ আহত, নিশ্চয়ই অনেক রক্তের দরকার হবে। সেই চিন্তা থেকেই শুরু হলো রক্ত সংগ্রহ। শাহবাগে দিনভর চললো রক্ত সংগ্রহের কাজ।
তিনি বলেন: পরের দিন সাভারে আমরা তৈরি করলাম ফিল্ড হাসপাতাল। সেখানে যাদেরকেই উদ্ধার করা হতো সবাইকে যেন প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তারপর হাসপাতালে পাঠানো যায়, সে চেষ্টা করা হতো। এরপর ঢাকা মেডিকেল ও সাভারের অনেক চিকিৎসক সেখানে ফ্রি ওষুধও বিতরণ করেন।
ইমরান বলেন, ভবনের ভেতরে ভেতরে আটকা পড়ে গিয়েছিলো অনেক মানুষ। তাদের উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি কাজ করে গেছে প্রশিক্ষিত কেউ নয় বরং সাধারণ মানুষ। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ভবনের ভেতরে ঢুকে উদ্ধার অভিযানে নেমেছিলেন তারা।
ভবন ধসের পরে সবাই যখন ধীরে ধীরে প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন, যখন নিখোঁজদের স্বজনেরা কাউকে ফেরত পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছেন; তখন ১৭ দিন পর ভবনের ভেতর থেকে এক নারীকে উদ্ধার করা হয় জীবিত। তার নাম রেশমা। সেই রেশমাই যেনো শত ট্র্যাজেডির পরও বেঁচে থাকার স্বপ্নের এক নাম।