চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

একটা গান লিখ আমার জন্য

বীণা নামক বাদ্যযন্ত্রটির নাম সবাই জানে। কিন্তু এর সুর শুনেছেন ক’জন? রাজার দরবারে বীণা হাতে কেউ গাইছেন এমন চিত্র অনেক বইয়ে দেখি, কিন্তু বাস্তবে বীণা, নাহ্‌! ভারত, পাকিস্তানে হাতেগোনা দু চারজন থাকতে পারে, বাংলাদেশে নেই এ যন্ত্র বাজানোর মতো কোন শিল্পী! হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কেবল দেবী বীণাপাণির হাতেই এই বাদ্যযন্ত্রটিকে দেখা যাবে!

এমন অনেক বাদ্যযন্ত্র ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, আরও কিছু বিলুপ্তির পথে! এসব বাদ্যযন্ত্র একেকটি জাতি-উপজাতি, সমাজ, সংস্কৃতির খাঁটি ধারক-বাহক। একেক ধরণের উৎসবে আবার একেক ধরণের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে। বিয়েতে এক রকম, যুদ্ধে এক রকম, পূজায় এক রকম, শোকে এক রকম ইত্যাদি। এক সময় বাংলাদেশেও বীণা, রবাব, বেনজো, সরোদ, সারেঙ্গী, সানাই, একরডিয়ন, এসরাজ, বেহালা বাজানোর মতো অনেক গুণী শিল্পী ছিলেন। এখন কয়েকটির একজনও নেই, আর কয়েকটির হাতেগোনা ২/১ জন।

এখন এসব অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদ্যযন্ত্রের স্থান জবরদখল করেছে কি-বোর্ড নামক এক যন্ত্র! যারা বাজাচ্ছেন তারাও অনেকক্ষেত্রে মানসম্পন্ন নন। অর্থাৎ আমাদের প্রিয় স্বর্ণযুগের যেসব গান এখনো সমান জনপ্রিয় ও শ্রুত, সেসব গানে যে ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল তার অনেকগুলোই এখন আর সেভাবে নেই!

আচ্ছা, ভাবুন তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ’ গানটির আগে বেহালার যে সুরটি তার কি কোনো বিকল্প হয়! অথবা মান্না দে’র ‘ও চাঁদ সামলে রাখো’ গানের প্রিলিউডে সানাইয়ের সুর, হেমন্তর ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’র বাঁশির সুর। এই যন্ত্রগুলোর যে অপার্থিব সুর, আর সেকালের শিল্পীরা যেভাবে বাজিয়েছিলেন, তার কি কোনো তুলনা মেলে! আর সেই সব ক্ষণজন্মা music-collageসুর-স্রষ্টারা, কমল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, হিমাংশু দত্ত, শচীন দেববর্মণ, নচিকেতা ঘোষ, সুধীরলাল চক্রবর্তী, সুধীন দাশগুপ্ত, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, মান্না দে, সত্য সাহা, খান আতাউর রহমান, আবদুল আহাদ, দেবু ভট্টাচার্য আরও কত! এঁদের অনেকের সৃষ্টি ইতিমধ্যে তিন প্রজন্ম শুনেছে। আমার নানী/দাদী, মা-বাবা আর আমরা এখনো শুনি!

এসব গানের সৃষ্টির পেছনের যে সব কাহিনী আমরা শুনতে পাই, তা এখন আর ভাবাই সম্ভব না! প্রত্যেকটি গানের পিছনে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্র শিল্পী, শব্দ-গ্রাহক প্রত্যেকের যে নিরলস প্রচেষ্টা ও ভালোবাসা, সে বিস্ময়কর বটে! ‘ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না’ এবং ‘দেহেরি পিঞ্জিরায় প্রাণ পাখি কাঁদে’ এই গান দু’টি মুকেশের কণ্ঠে জনপ্রিয় বাংলা গানগুলোর অন্যতম। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় রতু মুখোপাধ্যায়ের অন্তর ছোঁয়া সুর।

মুকেশ কোলকাতায় এসেছিলেন প্রোগ্রাম করতে। সেই সুযোগে গীতিকার সুরকারদ্বয় হিন্দি চলচ্চিত্রের নামী গায়ক মুকেশকে দিয়ে বাংলা আধুনিক গান রেকর্ড করার উদ্যোগ নেন। এইচএমভি’র দমদম স্টুডিওতে রেকর্ডের কাজ করতে গিয়ে হলো বিপত্তি! মুকেশ কিছুতেই কিছু বাংলা উচ্চারণ ঠিকভাবে করতে পারছিলেন না। অনেক চেষ্টার পর সবাই কেমন হতাশ হয়ে গেলেন! হাতে সময়ও নেই। মুকেশকে বোম্বে ফিরে যেতে হবে।

এমন বিপদে পুলক বাবুর একটি নাম মনে পড়ল – মান্না দে! হ্যাঁ, মান্না দে’কে অনুরোধ করা হলো বোম্বের স্টুডিওতে গান দু’টি মুকেশকে বাংলায় ট্রেনিং দিয়ে তিনি দায়িত্ব নিয়ে রেকর্ড করাবেন। সেখানে রতু, পুলক বাবু কেউই উপস্থিত থাকতে পারবেন না। মান্না দে কোনো স্বার্থ ছাড়া বন্ধুদের জন্য এই কাজ সানন্দে করেছিলেন। মান্না দে’র তত্ত্বাবধানে এই গান দু’টি বোম্বেতে মুকেশের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়েছিল। আজও সে গান নতুন শিল্পীরা গাওয়ার চেষ্টা করেন।

music2হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কত বড় মনের মানুষ ছিলেন সে সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করি – তখন সদ্য মারা গিয়েছেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর পরিবারের সাহায্যকল্পে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কলকাতায়। উদ্যোক্তারা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গান গাইতে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি তখন বোম্বাইতে থাকেন। বিমান ভাড়া এবং পারিশ্রমিক দুই-ই দাবি করলেন উদ্যোক্তাদের কাছে। কিন্তু কিন্তু ভাব করে তাঁরা হেমন্তবাবুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

অনুষ্ঠানের দিন হেমন্তবাবু মঞ্চে উঠে গৌরীবাবুর স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন, ‘‘এইখানে বৌদি আছেন কি?’’ এরপর পারিশ্রমিক এবং বিমান ভাড়ার পুরো টাকাটা তাঁর হাতে তুলে দিয়ে হেমন্ত দর্শকদের জানিয়েছিলেন, বহু সাহায্য অনুষ্ঠানের শেষে পঞ্চাশ টাকাও পরিবারের হাতে দেওয়া যায় না। তিনি তাই চেয়েছিলেন ওই টাকাটি অন্তত পরিবারের কাছে পৌঁছাক। মনের দিক থেকে এতটাই বড় মাপের ছিলেন তিনি।

হেমন্তবাবু সম্পর্কে চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের মন্তব্য: ‘‘ওঁর সঙ্গে ২৫ ধরে আমার সম্পর্ক ছিল। হেমন্তবাবু সম্পর্কে যত শব্দই বলি বা লিখি না কেন, কম পড়ে যাবে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নীরব থাকাটাকেই আমি শ্রেয় বলে মনে করি।’’

এসব গানের পেছনে যে কি দারুণ সব কাহিনী বা ইতিহাস আছে, তা জানলে গানগুলোর অর্থ আর আবেদন যেন আরেকটু গভীর হয়! কফি হাউজ গানটি নিয়ে মান্না দে সবসময় নিজের চেয়েও বেশি music4কৃতিত্ব দেন গীতিকার সুরকারকে। বিনয়ী মান্না দে’র মতে, তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতার পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির সৃষ্টিও হয়েছিল বেশ নাটকীয়ভাবে। ১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে।

এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, “কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?” এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, “কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।”

music3এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, “তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?” সুপর্ণ তখন বলেন, “কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো।” গৌরী প্রসন্ন বলেন, “তোমার বাবা (নচিকেতা ঘোষ) কি আর সে গান গাইবেন?” এই তর্কের মাঝেই গৌরী প্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন। এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।’ সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দে’র কথা।

পরদিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে বোম্বাইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।