আল্লাহ তা’আলা প্রিয় বান্দাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। যেই পবিত্র আয়াতের মাধ্যমে এই ঘোষণা এসেছে তা হচ্ছে এই, “হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো (সূরা বাকারা: ১৮৩)।” অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা শুধুমাত্র হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং সুস্পষ্ট ভাষায় হুকুম দেওয়ার উদ্দেশ্য, তাৎপর্যও বর্ণনা করেছেন। স্রষ্টার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রিয় বান্দাদের ‘মুত্তাকী’ বানানো।
একজন মুসলমানকে কখন ‘মুত্তাকী’ বলা যায়? যখন তার মধ্যে তাকওয়ার পূর্ণতা আসে। সুতরাং এখন আমরা বলতে পারি আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দার অন্তরে ‘তাকওয়া’ সৃষ্টি করা, তাকওয়ার পূর্ণতায় পৌঁছানো। এখন আমাদের জানতে হবে, ‘তাকওয়া’ কী? তবেই আমরা রমজানের সাথে তাকওয়ার সংযুক্ততা যাচাই করতে পারব।
‘তাকওয়া’ শব্দটি আরবি। অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। পরিভাষায়, অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় রেখে সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকাই ‘তাকওয়া’। অভিধান প্রণেতা এবং বিভিন্ন জ্ঞানীগণ আপন আপন ভাষায় ‘তাকওয়া’র যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তার মূল অর্থ এটাই। এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও ‘তাকওয়া’কে একই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “শিরক, কবীরা গুনাহ্, অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত থাকাই তাকওয়া (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম; ই.ফা.বা. ৬৯৫)।”
এখন আপনি রমজান এবং তাকওয়াকে সমানুপাতে বিচার করুন। কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন। ‘তাকওয়া’ অর্জনের জন্য যেসব থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক তদ্রুপ রমজানের রোজা আদায়ের ক্ষেত্রেও সেসব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা আবশ্যক।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দেওয়া ‘তাকওয়া’র সংজ্ঞার সাথে রমজানের রোজা আদায়ের শর্তের সাথে হুবহু মিলে যায়। তিনি বলেন,‘অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত থাকাই ‘তাকওয়া’। আর রোজা পরিপূর্ণ আদায়ের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং এ জাতীয় অশ্লীল কর্ম ত্যাগ করবে না তার পানাহার ত্যাগ করার উপর আল্লাহর কোনো উদ্দেশ্য নেই (বুখারী শরীফ)।” অর্থ্যাৎ এরূপ রোজা রাখাতে ঐ ব্যক্তির কোনো ফায়দা নেই। ‘বেহুদা’ উপবাস যাকে বলে। এক্ষেত্রে তাকওয়া অর্জন এবং রোজা আদায় উভয়টির শর্ত এক সুথোয় গাঁথা।
একজন বান্দা ‘তাকওয়া’ অর্জনে সবচেয়ে বেশী বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তার ‘নফস’ তথা আত্মা থেকে। নফস যত শক্তিশালী, সুঠাম হয় সে তত বেশী নিষিদ্ধ কর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়। আর নফস যত দুর্বল, পরিশ্রান্ত হবে বান্দা তত বেশী ভালো কাজের প্রতি স্ব-ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই নফসকে দমন করার সুবর্ণ সুযোগ মেলে রমজান মাসে। সারাদিন কোনো সুস্বাদু খাবার দুরের কথা এক গ্লাস পানিও যখন কপালে জুটে না তখন ঐ শয়তানি নফস এমনিতেই দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাবে। আর পাশাপাশি রোজা আদায়ের জন্য অশ্লীল কাজকর্ম থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান তো অপরিহার্য।
সব মিলিয়ে নফসের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ‘তাকওয়া’ অর্জনের পথ সুগম করে দেয় পবিত্র মাহে রমজান। এ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস শরীফ রয়েছে। হযরত আলকামা রাদ্বিয়ল্লাহু আনহু হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে বিয়ে করার সে যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে চোখ অবনমিতকারী এবং গুপ্তাঙ্গের হেফাজতকারী। আর যার বিয়ের সামর্থ্য নেই তার উচিত রোযা রাখা। কেননা, রোজা যৌন তাড়নাকে দমিয়ে রাখে (বুখারী শরীফ)।”
সুতরাং, রমজান মাসে নিয়মিত রোজা রাখার ফলে যখন যৌনতা দমন হবে তখন তার দ্বারা অশ্লীল কাজকর্ম হওয়া দুষ্কর হবে। এটাই বান্দার ‘তাকওয়া’ অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। বান্দাকে ‘মুত্তাকী’র বিশেষ স্তরে উন্নীত করতে স্রষ্টার কত প্রবল আকাঙ্খা, বাসনা। এজন্যই তো বান্দার তাকওয়া অর্জনের অসামান্য, কঠিন কাজটাকেই সহজ, সাবলীল করে দিলেন রমজানের রোজা ফরজ করার মাধ্যমে। রোজা রাখা ফরজ এবং এই ফরজ আদায়ের মাধ্যমেই তাকওয়া বাসা বাঁধবে আপন নীড়ে।