যে কোনো সংক্রামক ভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার নাম জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউট (এনআইএআইডি)। এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রধান ড. অ্যান্টনি স্টিফেন ফৌসি। ১৯৮৪ সাল থেকে পরিচালক হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ।আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধে দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন গবেষক তিনি।
বিভিন্ন সময়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এইচআইভি/এইডস, সার্স, মার্স, ইবোলা প্রভৃতি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে তিনি সামনে থেকে দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় অবদান রেখেছেন। ফৌসির অনন্য অবদান ও অভিজ্ঞতার কারণে নিউইয়র্ক টাইমস সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করেছে। দেশের মানুষের কাছেও একইভাবে পরিচিত তিনি।
দীর্ঘ পেশা জীবনে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৫ জন প্রেসিডেন্ট এর সঙ্গে। বর্তমানে উন্মাদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ছাড়া পূর্বের ৪ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রত্যেকেই যেকোনো বিপদে তার দ্বারস্থ হয়েছেন।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ছিল তার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। আশির দশকের কথা সেটি। বুশ তখনও ভাইস-প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌঁড়ে ছিলেন। একদিন বুশ তার অফিসে চলে গেলেন। বললেন ড. ফৌসির বন্ধু হবেন এবং সংক্রামক রোগ সম্পর্কে ধারণা নিবেন। সেই থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দুজনের। ড. ফৌসিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানালেন বুশ। একসঙ্গে আড্ডা দিলেন, আলাপ করলেন নানা সংক্রামক রোগ নিয়ে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের সঙ্গে ও ড. ফৌসির দারুণ সম্পর্ক ছিল। ক্লিন্টন নাকি সংকটের সময় কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা ভালোই জানতেন।
একইভাবে জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় অ্যানথ্রাক্স আঘাত হানলে একত্রে কাজ করেছেন দুজনে। তাদের মধ্যে গড়ে উঠে দুর্দান্ত সম্পর্ক। বিশ্বকে এইডসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সাথে নিয়ে অনবদ্য অবদান রেখেছেন ফৌসি। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাতেই লক্ষ লক্ষ জীবন রক্ষা পায়।
আরেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইবোলা এবং জিকাসহ নানা সংক্রামক রোগের সময় উদ্বিগ্ন ছিলেন। ফৌসিই সেই উদ্বেগের লাগাম টেনে ধরেছিলেন। তার সঙ্গে দারুণ কাজ করার অভিজ্ঞাত হয়েছে ফৌসির। ওবামার প্রশংসায় পঞ্চমুখ এই ফিজিশিয়ান।
অতীতের সকল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও ডোনাল্ট ট্রাম্পের সঙ্গে রসায়ন নাকি মিলছে না ড. ফৌসির। সমস্যাটা ট্রাম্পেরই। যদিও ডিসেম্বরে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় হোয়াইট হাউস কর্তৃক গঠিত টাস্ক ফোর্সের শীর্ষস্থানীয় সদস্য ড. ফৌসি। সেই সুবাধেই ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা হয়েছে ইদানিং। তবে প্রথম তিনটা বছর ডোনাল্ট ট্রাম্পের সঙ্গে নাকি কোনো আলাপচারিতা ছিল না তার। নিজের কাজটিই করে যাচ্ছিলেন। করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এখন প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সময় কাটাতে হয় দুজনকে।
ট্রাম্প হুজুগে, পাগলাটে। ভুল-ভাল তথ্য ছড়ান। ড. ফৌসি অভিজ্ঞ মানুষ। চিন্তাশীল, দক্ষ, গ্রেট গবেষক, ফিজিশিয়ান। সেসব ভ্রান্ত তথ্যে বাধ সাধেন। ফৌসি নাকি বারবার বলেছেন, এত মানুষ নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করা ঠিক হচ্ছে না প্রেসিডেন্টের। তার কথা কর্ণপাত করেননি ট্রাম্প। শুরুতে যখন করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, বারবার সতর্ক করার পরও ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্ব দেয়নি। পরে এসে ঠিকই ফৌসি ছাড়া চলা যাচ্ছে না।
ট্রাম্পকে কেউ চ্যালেঞ্জ করবে, তা ঠিক পছন্দ নয় তার। সত্য হলেও নিজের বিপক্ষে গেলে তিনি মানতে নারাজ। এমন দুর্দিনেও তাই দুজনের মধ্যে শীতলযুদ্ধ চলেছে শোনা গেছে।। তবে করোনা মোকাবিলায় একজন মহান গবেষক, ড. ফৌসি শীতলযুদ্ধকে পাত্তা দিতে চান না। তার লক্ষ্য, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষকে যতোটা সম্ভব বাঁচানোর চেষ্টা চালানো।
করোনার মূলকেন্দ্র এখন আমেরিকা। বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটছে ভাইরাস। হাজারে হাজারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। করোনায় এখন এক নম্বর যুক্তরাষ্ট্র। সর্বোচ্চ আক্রান্ত-১ লাখ ৯১ হাজার, মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ১৩৮ জন (১এপ্রিল,২০২০, রাত ১০টা)। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনে যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। স্বয়ং ট্রাম্পই নিজ মুখে সেটা বলেছেন। দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে বলেছেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে। তার মানে ঘোর দুর্দিন আমেরিকার। বিপদসংকুল এই সময়ে পাগলাটে একজন প্রেসিডেন্টকে সাথে নিয়ে দেশের মানুষের জন্য কীভাবে কী করবেন ড. ফৌসি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)