পাকা ধান কেটে, নুয়ে পড়া সোনালী ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে সারবেঁধে কৃষক যাচ্ছেন। এমন দৃশ্যের চেয়ে আর কোনো সুন্দর দৃশ্য আমি দেখিনি। এর পাশাপাশি যা দেখেছি তা হচ্ছে পুকুরের কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে রূপালি রঙের বিশাল মাছ বুকে ধরে একজন হাসছেন। বুকের ভেতর মাছ খলবল করছে। লেজ দিয়ে ঘাই মারছে। আর দেখেছি মাচার নিচে ঝুলন্ত পুরুষ্ট সবুজ সবজির পাশ দিয়ে হাসিমুখে হেঁটে যেতে নারীকে।
তাঁরা কৃষক, তাঁরা কৃষাণী। তাঁরা ফসল ফলায়। তাঁরা সারাবছর আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। আমরা যারা একটু চালাক-চতুর তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এসেছি। আমাদের যে বোকাসোকা ভাইটি সে থেকে গেছে গ্রামে। বোকাসোকা বোনটিকেও গ্রামে রেখে এসেছি কোনো একজন বোকাসোকা মানুষের সঙ্গে বিয়ে দেব বলে।
আমরা অফিসে চাকরি করি, আমরা অফিসার। ব্যবসা করে ব্যবসায়ী হয়েছি। আমার ভাই কৃষক, বোন কৃষাণী। তারা ফসল ফলায়। গ্রামে থাকে। তাদের আমরা অবজ্ঞা করি। আমরা তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জ্ঞান দিই। কিন্তু কোনোদিন পায়ের জুতো খুলে মাঠের কাদায় পা রাখি না।
কথাগুলো বলার বিশেষ কারণ আছে। এ কষ্ট আমার দীর্ঘদিনের। যেদিন দেখলাম আমরা ভায়ে-ভায়ে, ভায়ে-বোনে, বোনে-বোনে আলাদা হয়ে গেলাম। সমস্ত নাগরিক সুযোগসুবিধা নিয়ে আমি আর আমার মতো সুবিধাবাদীরা হলাম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে ভাই, বোন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠে, খাড়া রোদ্দুরের তীব্র ভাপ গায়ে মেখে কাজ করে, যার শরীরের চামড়া পুড়ে গেছে, স্যাঁতস্যাঁতে পানিতে ভিজে পায়ের নিচে ক্ষত, সে জন্ম থেকে অবহেলিত। তাদের দিকে আমরা কেউ তাকাই না। তাদের পক্ষে কথা বলি না। তারা একমণ ধান বিক্রি করে একমাত্র কন্যার সামান্য আবদার মেটাতে পারেন না। অগ্রহায়ণের নবান্নের ও এককেজি মাংস কিনে খেতে পারেন না। আমার শরীরের সমস্ত পশম খাড়া হয়ে যায়। নিজেকে অতি তুচ্ছ বোধ হতে থাকে।
তখন আমি মাধ্যমিকের শেষ ধাপে পড়ি। আমাদের বাড়িতে সাদাকালো টেলিভিশন আছে। আমরা আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশন দেখি। একটামাত্র চ্যানেল, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। তাতে মাটি ও মানুষ নামে অনুষ্ঠান দেখায়। কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান। সেই প্রথম দেখলাম কৃষকদের কেউ মর্যাদা দিয়ে কথা বলছেন। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেখানে একজন মানুষকে দেখলাম, অতি আন্তরিক। নাম শাইখ সিরাজ। তিনি আমার পথ প্রদর্শক হয়ে গেলেন।
তারপর একসময় টেলিভিশন রঙিন হলো। প্রাইভেট চ্যানেল হলো। চ্যানেল আইতে শুরু হলো হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান। সেই শাইখ সিরাজ। সেই আন্তরিকতা, মুখে সেই হাসি, নগ্ন পা, প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুর কাছে নিয়ে এসে কাদাভরা মাঠে নেমে গেছেন। কখনো প্যান্ট ভিজে গেছে পানিতে। তিনি ভ্রুক্ষেপ করেননি। কৃষক আর কৃষাণীর কাছে গিয়ে বসেছেন গোয়ালঘরের পাশে। যেখানে গোয়ালঘর থেকে গড়িয়ে এসে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বয়ে গেছে গোরু আর ছাগলের চোনা (পেশাব)। তিনি দিব্যি বসে আছেন, গল্প করছেন। মুখে স্বর্গীয় হাসি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে শাইখ সিরাজকে প্রথম দেখি সাদাকালো টেলিভিশনে। তখন তাঁর শার্টের রঙ বুঝতে পারিনি। পরে যখন কালার টেলিভিশন এসেছে তখন দেখেছি। গাঢ় শ্যাওলা সবুজ রঙের শার্ট। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সেই গাঢ় শ্যাওলা সবুজ রঙের শার্ট ছাড়া তাঁকে কখনো অন্য কোনো রঙের শার্ট গায়ে দিতে দেখিনি।
এই মানুষটিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি আরও একটা কারণে। বহুদিন আমাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। এই মাধ্যম বরাবরই রূপালী জগতের মানুষের দখলে। ঈদে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নিয়ে বিশাল আগ্রহ আমাদের। শোবিজ তারকাদের নিয়ে মাতামাতি। হকচকিয়ে গেলাম টেলিভিশন চ্যানেলে কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে। উপস্থাপন করছেন শ্রদ্ধেয় শাইখ সিরাজ। সেই গাঢ় শ্যাওলা সবুজ রঙের শার্ট গায়ে, পরনে ধূসর রঙের গ্যাবাডিনের প্যান্ট। খালি পা। প্যান্ট গুটিয়ে এনেছেন খানিকটা ওপরে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মাঠের ভেতর ঘুরছেন। কৃষক-কৃষাণীদের সঙ্গে কথা বলছেন। কৃষক-কৃষাণীদের জন্য নানাধরনের খেলার আয়োজন করা হয়েছে। কলাগাছ পোঁতা আছে। কলাগাছ বেয়ে তরতর করে উঠে যেতে হবে ওপরে। নিচে পানি, ওপরে বাঁশ। সেখানে বসে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রী এসেছেন জোড়ায়-জোড়ায়। নৌকাভরতি পেয়ারা। স্ত্রী দৌড় দিয়ে গিয়ে নৌকা থেকে দুহাত ভরে পেয়ারা এসে স্বামীর হাতে দিচ্ছেন। স্বামী পেয়ারা ছুড়ে দিচ্ছেন উঁচু বাঁশের মাথায় বাঁধা ঝুঁড়িতে। নির্ধারিত সময় পরে গুনে দেখা হবে কার ঝুড়িতে মোট কয়টা পেয়ারা জমা হয়েছে।
আহা কী আনন্দ, কী আনন্দ! এর আগে কবে কে এমনভাবে ভেবেছে কৃষক আর কৃষাণীদের কথা! তাঁদেরও বলার কিছু কথা আছে। তাঁদেরও জীবনে ঈদ আসে, আনন্দ করতে ইচ্ছে হয়। শাইখ সিরাজ গেলেন তাঁদের কাছে। তাঁদের কথা শুনলেন। ঈদ আনন্দে অংশীদার করলেন কৃষক-কৃষাণীকে। তাঁরা হয়ে উঠলেন শোবিজের প্রধান তারকা। কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন প্রত্যেককে উপহার দিয়েছেন। আর যাঁরা খেলায় জিতেছেন তারা টেলিভিশন, বাইসাইকেলের মতো দামী পুরস্কার পেয়েছেন।
শাইখ সিরাজ বিপ্লব ঘটালেন শহরে। আমরা সবুজের জন্য হাহাকার করি। মাটি স্পর্শ করার জন্য আমাদের অন্তর পোড়ে। আমরা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলি। শাইখ সিরাজ আমাদের জন্য নগর কৃষির ব্যবস্থা করলেন। বাড়ির ছাদে টবে শুরু হলো চাষ। ছাদ কৃষিকে জনপ্রিয় করে তুললেন শাইখ সিরাজ। অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ সবজি, ফল আর ফুলের গাছে সবুজ হয়ে উঠল। এখন যেকোনো বাড়ির ছাদে দাঁড়ালেই আশপাশের সব বাড়ির ছাদ দেখা যায় সবুজ। আগে সেসব ছিল মরুভূমির মতো রুক্ষ। কেমন করে এমন পরিবর্তন হলো! শাইখ সিরাজ চ্যানেল আইতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের ছাদ কৃষিতে তুলে নিয়ে এলেন যাঁরা ছাদে ফল, ফসলের চাষ করেছেন তাঁদের উদ্যোগ। উষ্ণায়ন থেকে নগরকে রক্ষা করতে যে উদ্যোগ তার প্রচারে লেগে পড়লেন তিনি। মানুষ যেন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করলেন। বললেন, যদি ভাড়া বাড়িতে ছাদে জায়গা না পান, একচিলতে বারান্দা থাকে কেবল তবে সেখানে টবে একটি মরিচ বা লেবুগাছ লাগান। কী সুন্দর কথা!
শাইখ সিরাজ ছাদ কৃষিতে কেবল ফল-ফসলের চাষ দেখালেন না, দেখালেন স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ। বহু মানুষ উদ্বুদ্ধ হলেন ছাদ কৃষিতে। মন্ত্রী, আমলা, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মী, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, অভিনয় শিল্পী, চিত্রশিল্পীসহ নানাপেশার মানুষজন।
যাঁদের টেলিভিশনে দেখা যায় তাঁরা মনের গভীরে আনত শ্রদ্ধায় খুব কাছের মানুষ হলেও দূরত্বের পরিমাপে দূরে থেকে যান। তাঁদের ছোঁয়া যায় না। যেমন আকাশের চাঁদ। ভালোবাসা যায়, স্পর্শ করা যায় না। একদিন সেই চাঁদ স্পর্শ করার সুযোগ আমার হয়ে গেল! তখন শীত। আবহাওয়ার অবস্থা এলোমেলো। কোনোদিন সকাল হয় রোদ ঝলমলে, কোনোদিন কুয়াশায় মোড়ানো। যে মেয়েটি আমাকে বিয়ে করেছে, রূপা, সে ছাদে বাগান করেছে। নানাজাতের গাছ আছে সেখানে। একদিন শুনলাম শাইখ সিরাজ আসবেন রূপার ছাদবাগান দেখতে। আমার নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেল। ঘনঘন নিশ্বাস পড়তে থাকল। অদ্ভুত ধরনের নার্ভাস বোধ করতে থাকলাম। কেন জানি না। সারারাত ঘুম হলো না। তিনি এলেন ভোরে। কুয়াশা আচ্ছন্ন ভোর। জানালেন বাসায় আসবেন না। ছাদে কথা বলে চলে যাবেন।
কত কথা জমিয়ে রেখেছি তাঁর সঙ্গে বলব বলে। কখন বলব বুঝতে পারছি না। দৌড়ে ছাদে গেলাম। গাঢ় শ্যাওলা সবুজ রঙের শার্ট গায়ে কুয়াশার ভেতর রূপার ছাদবাগানে দাঁড়িয়ে আছেন আমার পথপ্রদর্শক ছোটোবেলা থেকে আজ নিরবচ্ছিন্ন সময়ের নায়ক শাইখ সিরাজ। হাতে ছোটোখাটো কালো ক্যামেরা।
তিনি কথা বলছেন অতি সাধারণভাবে। যেন নিয়মিত আসেন এখানে। আমাদের সঙ্গে দেখা হয়। একটেবিলে বসে মাছের কাঁটা বেছে ভাত খেতে খেতে আমরা নিয়মিত গল্প করি। মানুষ মাটি দিয়ে বানানো শুনেছি কিন্তু একজন মানুষ কাদামাটির মতো এমন নরম মনের হতে পারেন তা চোখে দেখলাম। তিনি শাইখ সিরাজ।
হাতদুটো ধরে বললাম, ভাই, আমি অত্যন্ত কাঙাল একজন মানুষ। ভালোবাসা পেলে মিইয়ে যাই। মনে কষ্ট পেলে দুঃখ বাড়ে। আপনি একবার আমাদের বাড়ির ভেতরে চলুন। কাসার গ্লাসে পানি রেখেছি, আপনি খাবেন।
শাইখ সিরাজের মুখে হাসি। তাঁর চোখ হাসছে। সেখানে স্নেহে ভরা। তিনি বললেন, কী করেন আপনি?
লেখালেখি করি। গল্প লিখি, উপন্যাস লিখি। বেশিরভাগ শিশু-কিশোরদের জন্য।
আমাকে অবাক করে দিয়ে শাইখ সিরাজ বললেন, চলুন।
তিনি বাসায় এলেন। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসলেন না। ডাইনিঙে চেয়ারে বসলেন। চেয়ারের একপাশ ভাঙা। সেটা যাতে দেখা না যায় সেজন্য আড়াল করে রাখা হয়েছে। শাইখ সিরাজ গিয়ে সেই চেয়ারেই বসেছেন। পেরেক বেরিয়ে ছিল খানিকটা। আমি দোয়া পড়তে শুরু করলাম। পেরেকের খোঁচায় প্যান্ট ছিঁড়ে যেতে পারে। দোয়া কাজে লাগল। শাইখ সিরাজ আরাম করে চেয়ারে বসে থাকলেন। পানি খেলেন। যখন উঠলেন খেয়াল করলাম চেয়ারের বের হয়ে থাকা পেরেকে তার প্যান্ট বেঁধে ছিঁড়ে যায়নি। বুকের ভেতর আটকে রাখা দম ফস করে ছেড়ে দিলাম। শুধু তাঁকে কী কী বলতে চেয়েছিলাম সেগুলো ভুলে গেলাম। বলা হলো না।
৭ সেপ্টেম্বর শ্রদ্ধেয় শাইখ সিরাজের জন্মদিন। অন্তর থেকে এই মানুষের জন্য প্রার্থনা করছি, তিনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। তাঁকে ঘিরে থাকুক মানুষের মন। কৃষককে যে মর্যাদা তিনি দিয়েছেন তার সহস্র গুণ মর্যাদায় মর্যাদাবান হোন তিনি। সুখে থাকুন, আনন্দে থাকুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)