চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

একজন ‘কলিজা খেকো’ খলিলউল্লাহ আর আমাদের সাংবাদিকতা

এক
নানাবাড়ি আজিমপুর কলোনিতে থাকার সময় আমরা ছোটরা ভূতের চেয়ে বেশি ভয় পেতাম যে মানুষটাকে তার নাম খলিলউল্লাহ।  আমরা থাকতাম দুই নম্বর বিল্ডিঙের বি তে। খলিলউল্লাহ দেখতে তাল গাছের মতো লম্বা। পরনে সব সময় থাকত ঢিলেঢালা দুমড়ানো মোচড়ানো রকম শার্ট।

সেই শার্টের বেশিরভাগ বোতাম আবার খোলা থাকত। লুঙি পড়ত বুকের কাছে গিট দিয়ে। আলাভোলা চেহারার খলিলউল্লাহকে দেখতাম আজিমপুরের রাস্তায়। কখনো কবরস্থানের ওদিকটায়। খুব নির্বিকার দৃষ্টি ছিল। আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।

লোকটার নাম কী? সবাই তাকে বলত কলজে খেকো খলিলউল্লাহ। কি আশ্চর্য! ভাবলে অবাকই হতাম, একটা মানুষের নামও এরকম হতে পারে! পরে এলাকার বড়দের কাছে শুনেছি এই খলিলউল্লাহ নাকি আজিমপুর কবরস্থানে কাউকে কবর দিয়ে গেলে সেই কবর থেকে মানুষের কলিজা বের করে খেত।

খলিলউল্লাহর এই কলিজা খাওয়ার কাহিনি তখনকার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বের হয়েছিল প্রচ্ছদ কাহিনি হিসেবে। বড়দের কাছে এরকম শুনেছি। খলিলউল্লাহকে নিয়ে এসব কাহিনি তখন মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরত। আশির দশকে অনেকবার খুব কাছে থেকে খলিলউল্লাহকে দেখেছি। তাকে দেখলে আমার মনে হতো মানুষ কিভাবে কলিজা খায়!

অনেক পরে সাংবাদিকতা করতে এসে ছোটবেলার পুষে রাখা সেই কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারিনি। কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম স্বাধীনতার পর বিশেষ একটি সাংবাদিক মহলের প্ররোচনায় দরিদ্র, আলাভোলা টাইপের খলিলউল্লাহকে আর্থিকভাবে ম্যানেজ করা হয়েছিল।

তারপর রিপোর্টার লাগিয়ে তাকে দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে লাশের কলিজা খাওয়ার ছবি তুলে একটি মারাত্মক স্টোরির সূচনা করেছিল পত্রিকাটি। ব্যস আর যায় কোথায়? রাতারাতি সাপ্তাহিকটি হিট।  খলিলউল্লাহর সেই প্রচ্ছদ কাহিনি হিট। হাজার হাজার কপি বিক্রি।

বিচিত্রার পাশাপাশি তখন হিট হয়ে গেল অসহায়, টাকার বিনিময়ে কলিজা খাওয়ার ডামি শটের খলিলউল্লাহও।  ঢাকা শহরে তখন খলিলউল্লাহ রাতারাতি আলোচনার শীর্ষে। এরপর পত্রিকাটি আর খলিলউল্লাহর খোঁজখবর রাখেনি। পরে খলিলউল্লাহ অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। কেউ তার খোঁজ নেয়নি।

দুই
কলিজা খেকো খলিল উল্লাহ্‌র প্রচ্ছদ কাহিনি ছেপে হয়ত সেই পত্রিকাটির অনেক কাটতি হয়েছিল। দেশ বিদেশে আলোচিতও হয়ত হয়েছিল। কিংবা সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্য নজিরও বা স্থাপন করেছিল। কিন্তু এরপর? এরপর অনেকদিন আমরা খলিলউল্লাহকে ঐভাবেই দেখেছি আজিমপুরের পথেঘাটে। দোকানে ,ফুটপাথে। তাকে দেখলে আমরা ছোটরা ভীষণ কুঁকড়ে যেতাম ভয় আর আতংকে।

আমাদের জন্য পত্রিকাটি খলিলউল্লাহকে উপস্থাপিত করেছিল একজন কলিজা খেকো মানুষ হিসেবে। আমরা যতদিন তাকে দেখেছি একধরনের আতংক আমাদের মধ্যে কাজ করেছে। শুধু কি আতংকই কাজ করেছে! নাকি আরও কিছু?

তিন
খলিলউল্লাহর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। কিছুদিন আগে আজিমপুরের এক প্রবীণ খলিলউল্লাহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের লালবাগের সন্তান সুলতান ও তার নববিবাহিত সম্মন্ধি হানাদারদের গুলিতে নিহত হলে লাশ বহন করে আনার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক তখনই সহজ-সরল, বর্তমান সময়ের প্রচলিত প্রতিবন্ধি মানুষ খলিলউল্লাহকে সুলতান পরিবার কেরানিগঞ্জে নিয়ে যায়।

পরে খলিলউল্লাহর নেতৃত্বে লাশ বাসায় এনে আজিমপুরে দাফন করা হয়।’ এই লেখাটি পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ছোটবেলায় খলিলউল্লাহকে দেখে আমি যেরকম ভয় আর আতংকে কুঁকড়ে যেতাম তার চেয়েও বেশিরকম আতংকে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম এই লেখা পড়ে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ‘কলিজা খেকো’ খলিলউল্লাহ লোকজন নিয়ে একজন শহীদের লাশ কেরানিগঞ্জ থেকে আজিমপুরে এনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেছে।

আর সেই মানুষটাকেই কিনা দেশ স্বাধীনের পর আমরা তার দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে দুটো টাকা-পয়সা দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে লাশের কলিজা খাওয়ার ছবি তুলে বানোয়াট কাহিনি লিখে বিক্রি করলাম! আর একজন মানুষকে রাতারাতি বানিয়ে ফেললাম কলিজা খেকো!

চার
আজিমপুর কবরস্থানের গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকা খলিলউল্লাহর সাদাকালো ছবিটির দিকে মানুষের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে যিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনির হাতে নিহত একজন শহীদের লাশকে দায়িত্বের সঙ্গে কেরানিগঞ্জ থেকে আজিমপুরে বহন করে নিয়ে এসে কবর দিয়েছিলেন।  আর স্বাধীনতার পরে সেই মানুষটাকে আমরা প্রতিদান হিসেবে কি দিলাম? ভাবা যায়!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)