যখন তুমি ব্যাটিংয়ে- উইকেটে যাও, প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চড়াও হও, দরকার পড়লে একটু সমঝোতা করো, সময় হলে আবারও চড়াও হও। যখন তুমি বোলিংয়ে- প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের রান আটকাও, হাঁসফাঁস করে ছাড়ো, উইকেট দিতে বাধ্য করো। বুঝিয়ে দাও পার্থক্যটা, কেনো তুমি বিশ্বসেরা।
সাউদাম্পটনের রোজ বোলে সোমবার সাকিব বোঝালেন সেটাই। দলের প্রয়োজনের সময় উইকেটে এসে জুটি গড়েছেন, দারুণ এক ফিফটিতে চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহের ভিত গড়ে দিয়েছেন। আবার যখনই ডাক পড়েছে বোলিংয়ে, কেবল ত্রাতাই হননি। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের চোখের-নাকের জল এক করে টপাটপ উইকেট তুলে নিয়েছেন।
তাতে আফগানিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ৭ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট টাইগারদের। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের দুম্যাচ লাল-সবুজদের। জিতলে হিসাব থাকবে সেমিফাইনালের লড়াইয়ে পৌঁছারও! যদিও রানরেট আর অন্য প্রতিপক্ষের জয়-পরাজয়ের দিকেও নজর রাখতে হবে সেজন্য!
ব্যাটে-বলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এক পারফরম্যান্সের দিনে সাকিব আল হাসান হয়েছেন ম্যাচ সেরাও। প্রথমে ব্যাটে এক চারে ৬৯ বলে ৫১ রানের ঝলমলে সময়োপযোগী ইনিংস। পরে বলে ১০ ওভারের কোটা পূরণ করেছেন এক মেডেনে ২৯ রানে ৫ উইকেট নিয়ে। যেটা তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। আগের সেরাটি ছিল ৪৭ রানে পাঁচ উইকেট।
সাকিবের কীর্তি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথমবার ৫ উইকেটের স্বাদ এনে দিয়েছে। সঙ্গে যুবরাজ সিংয়ের পর প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একই ম্যাচে ৫ উইকেট ও ফিফটির কীর্তি গড়েছেন। আর যুবরাজ ও কপিল দেবের পর একই বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেটের কীর্তি ছুঁয়েছেন।
এদিন বিশ্বকাপে এক হাজার রানের মাইলফলকও ছুঁয়েছেন সাকিব। বাঁহাতির ব্যাটসম্যান ২৭ ম্যাচ ও চার বিশ্বকাপ মিলিয়ে বিশ্বমঞ্চে হাজারির অভিজাত ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন। তাতে ইংল্যান্ড আসরে আবারও উঠে এসেছেন রান সংগ্রাহকের শীর্ষে। ওয়ার্নারকে (৪৪৭) টপকে সর্বোচ্চ ৪৭৬ রান এখন সাকিবের।
সাকিবের নামের পাশে এবার আছে অনবদ্য দুটি সেঞ্চুরি ও তিনটি ফিফটি। সঙ্গে ছয় ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার দৌড়ে আছেন ভালোভাবেই। এদিন প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে এক হাজার রান ও ৩০-এর বেশি উইকেট পাওয়ার কীর্তিও গড়েছেন লাল-সবুজের মহাতারকা।
রোজ বোলে যখনই অধিনায়ক তলব করেছেন, এসেই আফগানদের নাচাতে শুরু করেন সাকিব। মন্থর উইকেটে ২৬৩ রানের লক্ষ্য দেয়া। প্রতিপক্ষের জন্য কঠিনই। সেটি আরও কঠিন করতে ঝটপট উইকেট তুলে নেয়া দরকার। কিন্তু উইকেট আসছিল না।
তখন অধিনায়কের ডাক পড়ল। হতাশ করেননি সাকিব। ব্রেক থ্রু এনে দেন আক্রমণে এসেই। মোসাদ্দেক তখন আরেক উইকেট এনে স্বস্তি দ্বিগুণ করেন। কিছুপর আবারও বিপদ! উইকেটে জমে যেতে থাকেন আফগানিস্তানের পরের দুই ব্যাটসম্যান। এবার?
যা করতে হত সেটাই করেছে বাংলাদেশ। আফগানদের রান তুলতে না দিয়ে গলায় ফাঁস পড়িয়েছে! পরের কাজ সেই ফাঁস কাজে লাগিয়ে উইকেট তোলা। তাতে আবারও অগ্রণী ত্রাতা সাকিব।
অন্যদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খানিক চেষ্টা করে তখন আবারও সাকিবের হাতে বল তুলে দেন মাশরাফী। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ম্যাচের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছেন ব্যাটে-বলে দারুণ সময় কাটাতে থাকা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ঝটপট ৩ উইকেট তুলে নেন সেসময়।
টাইগার স্পিনাররা আক্রমণে আসার পর রানের গতি কমেছিল, তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সাকিবই। রানের গতি মন্থর করে আনার জন্য আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং দরকার ছিল। টেস্ট ক্রিকেটের আদলে ব্যাটসম্যানের চারপাশে ছাতার মতো ফিল্ডার দাঁড় করিয়ে সাকিবকে বল ঘোরাতে দেন মাশরাফী।
সাফল্য আসতে দেরি হয়নি। ৪৭ রান করে ফেলা গুলবাদিনকে লিটনের ক্যাচ বানিয়ে দলের তৃতীয় সাফল্য আনেন বাঁহাতি স্পিনার। সেটি ২৯তম ওভারের প্রথম বলের কথা। ওই ওভারের তৃতীয় বলে আবারও সাফল্য। এবার অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবিকে সাজঘরের পথ দেখান সাকিব, রানের খাতা খোলার আগেই আফগান তারকাকে করেন এলবিডব্লিউ।
কিছুপর আসগর আফগানকে ক্যাচ বানান বদলি ফিল্ডার সাব্বিরের। তাতে ৭ ওভারে ১ মেডেনে ১০ রানে ৪ উইকেট হয় সাকিবের নামের পাশে। শেষদফা আক্রমণে এসে বোলিং ফিগারকে নিয়ে যান ক্যারিয়ার সেরাতেই।
ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়রারের মতো পাঁচ উইকেট, ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং, আর হরেক কীর্তি ছোঁয়ার দিনে বাঁহাতি এ স্পিনার নিজের করা প্রথম ওভারেই সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। সেই শুরু। শেষটা করেছেন নাজিবুল্লাহ জাদরানকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে। আসলে বাংলাদেশকেই শক্তি দেখানো এক জয়ের পথ দেখিয়ে!