শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা আর গানের ‘সোনালী দশক’ বলা হয় গত শতাব্দীর নব্বই দশককে! সেই সময়ে বিভিন্ন অঙ্গনে ছিলো প্রতিভাধরদের ছড়াছড়ি। কী গানে, কী সিনেমায়!
নব্বই দশকের শেষ দিকে বাংলার শ্রোতা মহলে তেমনি প্রতিভা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এক তরুণ কণ্ঠশিল্পীর। নাম তার নাফিস কামাল!
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এর তুমুল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে প্রথমবার দেশের শ্রোতা দর্শকদের সাথে তার পরিচয়। সেই অনুষ্ঠানে গানের বদৌলতে তৎকালীন শ্রোতাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় তার গান। কিন্তু সেই সময়ে এমন একজন অপরিচিত তরুণ শিল্পী এমন জনপ্রিয় প্লাটফর্ম পেলেন কী করে?
চ্যানেল আই অনলাইনকে এর পেছনের গল্প বলতে গিয়ে নাফিস কামাল ফিরে গেলেন আশির দশকের শুরুতে। যখন তিনি বেড়ে উঠছিলেন এই শহরের জল হাওয়ায়! জানালেন, যখন তার বয়স বছর পাঁচেক তখন থেকেই তাকে ‘বাধ্য’ হয়ে গান শিখতে হতো! নাফিস মজা করে জানান, মায়ের কণ্ঠশিল্পী হওয়ার অপূর্ণ ইচ্ছার কারণেই সেই শিশু বয়সে গানের তালিম নিতে হয়েছে তাকে। মায়ের হাত ধরে তাকে যেতে হয়েছে কচি-কাচার মেলায়।
গান শেখার শুরুটা ‘বাধ্য’ হয়ে হলেও পরবর্তীতে নিজের সাথে জড়িয়ে যায় সুর, সংগীত। স্কুলের বন্ধু-বান্ধবের বাহবা আর উৎসাহ পেয়ে গান নিয়ে ধীরে ধীরে আরো সিরিয়াস হতে শুরু করেন নাফিস।
তিনি বলেন, সেই সময়ে গান আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। এতোটা প্যাশনেট ছিলাম। যা আরো পোক্ত করে দেন সংগীতশিল্পী ও গানের প্রিয় শিক্ষক মোহাম্মদ হান্নান। নাফিস বলেন, তিনিই আমার সংগীত গুরু। অত্যন্ত প্রচার বিমুখ এই মানুষটির কাছেই আমার যতো ঋণ। শিল্পী হিসেবে তিনিই আমার ব্যাসিক তৈরী করে দেন। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
এরপর থেকেই স্কুল কলেজ কিংবা বন্ধুদের বিভিন্ন আড্ডা মানেই নাফিসের গান। আশপাশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে তার। এভাবেই এক সময় বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর বাসনা তৈরী হয় নাফিসের। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব, তা জানা নেই। এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে বিদেশে পাড়ি দেয়ার তাড়া। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে অন্তত একটা অ্যালবাম প্রকাশ করে যেতে চান!
সেই বাসনা নিয়েই দিন পার করছিলেন। চেষ্টা করেছেন গানের অ্যালবাম প্রকাশেরও। কিন্তু চাইলেই কি আর সব হয়! বন্ধু প্রতীকের বাবা প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী। নানাজনের পরামর্শে তার সঙ্গে একদিন সাক্ষাতের সুযোগ তৈরী হয় নাফিসের। বন্ধুর বাবাকে মনের কথা খুলে বলেন তিনি। তাকে জানান, তিনি গান গাইতে চান। প্রকাশ করতে চান অ্যালবাম। এসব শুনে কাওসার আহমেদ ছেলের বন্ধুর পরীক্ষা নিলেন। তাকে গাইতে বললেন। গাইলেন নাফিস। তার কণ্ঠ, গায়কী সবই পছন্দ হলো।
এই পরীক্ষায় পাস করে শিল্পী জীবনের দরোজা কিছুটা খুলে গেলো নাফিসের। তিনি নিজের লেখা ‘এলোমেলো’ নামের গানটি দিলেন নাফিসকে। শুধু নিজের লেখা গানই নয়, কবি কাজী রোজী, নির্মলেন্দু গুণদের মতো গুণী মানুষদের লেখা মৌলিক গানও তুলে দিলেন। শুধু তাই নয়, গান নিয়ে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাছ থেকে খুব দারুণ গাইডলাইন পেলেন তিনি।
১২টা গান নিয়ে অ্যালবামের উদ্যোগ নিলেন। সংগীতে যেখানে কাজ করেছেন লাকী আখন্দ, নকীব খান, ফোয়াদ নাসের বাবু, আশিকুজ্জামান টুলু, এস এম খালিদ ও সৈয়দ কল্লোলের মতো মানুষেরা। গান তৈরী হওয়ার পর আরো একবার অথৈ সাগরে পড়লেন নাফিস। এতো গুণীজনরা গানের কথা লিখলেন, সুর করলেন অথচ অডিও কোম্পানিগুলো কেউ এই গানগুলো পছন্দ করছেন না! কেউ অ্যালবাম প্রকাশের রিস্ক নিলেন না। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে আবার তিনি শরণাপন্ন হন কাওসার আহমেদ চৌধুরীর।
গুণী এই গীতিকার এবার নাফিসকে গান নিয়ে নানা পরামর্শ দেন। রেকর্ড সম্পন্ন হওয়া গানগুলো নিয়ে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যান ‘ইত্যাদি’র হানিফ সংকেতের কাছে। গানগুলো নিয়ে হানিফ সংকেতের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তটা নাফিসের ভাষায়, ‘এটাও ছিলো এক বিস্ময়। যে মানুষটিকে এবং তার অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখতে বাংলার মানুষ তিনমাস অপেক্ষা করেন, তার সামনে আমি বসে আছি!’
এদিকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার বিষয়টিতে বাধা হয়ে দাঁড়ান নানী। নাতীকে কোনোভাবেই দেশের বাইরে যেতে দেবেন না। স্থগিত হয় নাফিসের বিদেশ পড়তে যাওয়া। ভর্তি হন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হানিফ সংকেতের কাছে গানগুলো দিয়ে আসার কয়েক দিন পরেই কাওসার আহমেদ চৌধুরীর একটি ফোন পান নাফিস। জানতে পারেন, ১২টি গানই হানিফ সংকেতের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু কোন গানটি ‘ইত্যাদি’তে দেখাবেন, এটা নিয়ে দ্বন্দ্বে আছেন! এমনটা শোনার পর নাফিসকে আর পায় কে!
ঠিক হলো কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এবং নকীব খানের সুর ও সংগীতে ‘এলোমেলো’ শিরোনামের গানটি রেকর্ড হবে ‘ইত্যাদি’র জন্য। হলোও তাই। গানটিতে মডেল হিসেবে দেখা যায় তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোমানাকে। সঙ্গে নাফিস কামাল নিজেই!
‘এই দেশে এক শহর ছিল
শহরে এক রাস্তা ছিল
রাস্তার ধারে এক বাড়ী ছিল
বাড়ীর নাম এলোমেলো’
১৯৯৮ সালে বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে হানিফ সংকেত বাংলার শ্রোতা দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেন নবীন কণ্ঠশিল্পী নাফিস কামালকে। সেই শো’টিতে গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘এলোমেলো’ গানের বদৌলতে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যেতে থাকে অখ্যাত নাফিস কামালের নাম।
নিজের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ নিয়ে সংশয় থাকলেও ইত্যাদিতে গান গাওয়ার পর সব সংশয় দূর হয়। অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডাক পেতে থাকলেন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। যাদের কাছে অ্যালবাম প্রকাশের জন্য বার বার অনুরোধ করেছেন, তারাই এবার পাল্টা অনুরোধ জানালেন যেন অ্যালবামটা তাদের কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়।
সেই বছরেই নাফিস কামালের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘এলোমেলো’ গানের নামেই রাখা হয় অ্যালবামটির নাম। এই গানটির পাশাপাশি অ্যালবামের বাকি গানগুলোও সেসময় বেশ শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠে। খুব কম সময়ের ব্যবধানে নিজের দ্বিতীয় ও শেষ অ্যালবাম ‘অনুভবে একা’ প্রকাশিত হয়। সেই অ্যালবামের গানগুলো লেখেন মো. রফিকুজ্জামান, শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, লিটন অধিকারী রিন্টু প্রমুখ। অ্যালবামের দুটি গান নিজেই লেখেন নাফিস কামাল।
‘অনুভবে একা’র পর গানের দুনিয়া থেকে সবার অজান্তেই একদিন হঠাৎ ডুব দিলেন নাফিস কামাল। আবার ফিরলেন প্রায় দুই দশক পর। মাঝখানের সময়টায় কোথায় ছিলেন তিনি, কেনই বা হারিযে গিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নে এক কথার জবাব তার। জানালেন, ‘জীবন ও জীবিকার তাগিদেই ডুব দিতে হয়েছিলো।’
নতুন করে ফিরে আসায় গানের মানুষেরা বরণ করে নিয়েছেন দু দণ্ড মুখোমুখি’র এই শিল্পীকে। এযাত্রায় নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে তার সেই বিখ্যাত গান ‘এলোমেলো’। গানটি প্রকাশিত হয়েছে চ্যানেল আইয়ের ইউটিউব চ্যানেলে। নতুন করে তৈরী গানটির ভিডিও নির্দেশনা দিয়েছেন ইজাজ খান স্বপন।
কৃতজ্ঞচিত্তে নাফিস বললেন, গান থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর যারা প্রতিনিয়ত আমাকে আবারও গানের সংস্পর্শে আনতে চেষ্টা করেছেন, তাদের একজন ইজাজ খান স্বপন। তার প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সেই সঙ্গে জানালেন, নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘নাফিস কামাল’ এ তার পুরনো গানগুলো শ্রোতারা খুঁজে পাবেন, এমনকি সামনে থেকে পাওয়া যাবে একেবারে নতুন গানও!