কলকাতা শহর নিয়ে ১৯৯৯ সালে লেখা ‘The City of Joy’ বইয়ে লেখক ডমিনিক ল্যাপিয়ার কলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন,“Here there is no more hope …… all that is left is anger.”
আমাদের ঢাকাও তাই। এখানে আর কোনো আশা নেই। আছে দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ। সবচেয়ে বড় হয়ে আছে আমাদের অসহায়ত্ব।
এই শহর বর্ষায় আমাদেরকে ডুবায়, শীতে উপহার দেয় ধুলোয় আচ্ছন্ন এক ‘অন্ধকার’ নগর, গরমে নগরবাসী হয়ে যায় দিশেহারা। দূষণ, যানজট, উপচে পড়া মানুষের দিগ্বিদিক ছুটে চলা, ফুটপাথ দখল, যেকোনো জায়গাকে গাড়ি পার্কিং এর জন্য ব্যক্তিগত ‘গ্যারেজ’ বানিয়ে ফেলা, ভিআইপি’দের অবাধ চলাচলের পথ করে দেওয়া, রাস্তা দখল করে মিটিং মিছিল করে ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টিসহ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এই নগরের প্রায় দুই কোটি মানুষ। প্রতিদিনের এই চিত্রের কাছে আমাদের অসহায়ত্বই শুধু প্রকাশ পায়; সমাধানের দেখা মেলে না।
এই শহরটা সবার, কিন্তু এই শহরটাই আসলে কারো নয়। এই শহর দেখার মতো কেউ নেই। এই শহরে সবাই ‘রাজা’, তাই সত্যিকারের কোনো রাজা নেই। এই ঢাকায় এতো মানুষ, সত্যিকারের ‘মানুষের’ তবু কতো অভাব! কে যেন বলেছিলেন, মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা। নানা সূচকে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান মাপা হয়। ঢাকা শহর কতোটা মানবিক শহর সেই সূচকে কখনো মাপা হয় না। দিন দিন এই শহর অমানবিক শহরে পরিণত হচ্ছে। দিন দিন এই শহরে ‘মানুষ’ কমে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু স্বার্থপর ভোগবিলাসী জীবনযাপন। নিজেকে নিয়ে বাঁচার অসুস্থ সুখের পেছনে ছুটে চলা। পরিবেশ এবং প্রতিবেশ হয়ে যায় উপেক্ষার বিষয়।
এমনই একটি নির্মম ঘটনা সম্প্রতি আমাদের নীরবে সয়ে যেতে হলো। রাজধানীর আর কে মিশন রোডের একটি বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধকে মেরে ফেলা হয়।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নিহত মো: নাজমুল হক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বাসার ছাদে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ভাতিজার গায়েহলুদ অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানকার অতি উচ্চস্বরের গান কোনোভাবেই সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত নাজমুল হক বাসার কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন দুর্ব্যবহার করেন। পরের দিন সকালে আলতাফ হোসেন ও আরও সাত আট জন নাজমুল হোসনেকে ফ্ল্যাটের নিচে ডেকে পাঠান। তারা নিচে এলে নাজমুল হকের ছেলেকে প্রথমে প্রহার করা হয়। নাজমুল হক ছেলেকে বাঁচাতে গেলে তার উপরেও হামলা করা হয়। গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।
প্রিয় পাঠক, এই হলো এই ঢাকা শহরে একটি বিয়ের গায়েহলুদ উদযাপন এবং তার জের ধরে একটি জীবন-বিয়োগের নির্মম বর্ণনা। এই শহরকে কি মানবিক শহর বলা যায়? কত সহজেই, কত অকারণেই জীবন ‘নাই’ হয়ে যায়! লক্ষ কোটি গায়েহলুদ অনুষ্ঠান দিয়েও কি একটি জীবন ফিরিয়ে আনা যায়? আরও বেশি, আরও উচ্চস্বরের হাজারো গান দিয়েও কি একটি মৃতদেহে প্রাণের স্পন্দন তৈরি করা যায়?
গান তো মোহনীয় এক ব্যাপার। গান তো জীবনের কথা বলে। সেই গান কেন মৃত্যুর কারণ হবে? উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে তার তালে তালে নৃত্য করে আপনি হয়তো সময়টাকে উপভোগ্য করে তুলছেন, কিন্তু অন্য কারো জন্য এটিই যে শব্দ দূষণের, ভোগান্তির, কষ্টের কারণ হতে পারে সেই বিবেচনা বোধ থাকবে না? আপনি আপনার ফ্ল্যাটের ছাদকে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র মঞ্চ বানিয়ে ফেলতেই পারেন, কিন্তু আপনার ‘সাজ’ অন্যকে বিঁধবে কেন?
শুধু গান নয়; এমন আরও অনেক অকারণ শব্দ দূষণে নগরবাসী জর্জরিত। রাস্তা বন্ধ করে মাইকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সভা সমাবেশ হয়। হকার উচ্চশব্দে মাইক বাজিয়ে প্রচার চালায় তার পণ্যের। প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল অহেতুক হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে চলে অহরহ। বাসার পাশেই বাজার, তবু অলিতে গলিতে ঢুকে পড়া মুরগিওয়ালার বিকট ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আমাদের। এসবের সঙ্গে শীত এলে এই শহরে আরও এক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়।
পাড়ায় পাড়ায় মসজিদগুলো আয়োজন করে বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল। খুবই ভালো কাজ। যাদের আগ্রহ আছে মসজিদে গিয়ে ওয়াজ শুনবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আয়োজকগণ নিজেদের জন্য ‘ফরজ’ করে নেন যেন পুরো এলাকার একজন মানুষও ওয়াজ শোনা থেকে বাদ না পড়ে! দূর দূরান্ত পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে দেন। তাও মানা যেত। কিন্তু সেই মাইকে অধিকাংশ সময়ই মধ্যরাত পর্যন্ত ওয়াজ চলে। ঘর বাড়িতে অসুস্থ মানুষ থাকে। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যাপার থাকে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুম-কাতর মানুষ থাকে। তাদের সবাইকে জোর করে জাগিয়ে রেখে ওয়াজ শোনানো ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম জোড় জবরদস্তির ধর্ম নয়। মানুষকে অহেতুক কষ্ট দেওয়া ইসলামের কাজ নয়। বরং এই চর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রিয় আয়োজকগণ ধর্মীয় সমালোচনা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সাধারণের কাছে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছে।
এর বাইরেও রয়েছে নানা দিবস উপলক্ষে দিন রাত বিভিন্ন ভাষণের পুনঃপ্রচার ও দেশাত্মবোধক গানের অসহনীয় শব্দ দূষণ। মাইকে সীমা ছাড়ানো উচ্চস্বরে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া এবং তা মানুষকে শুনতে বাধ্য করার মধ্যে সত্যিকারের দেশপ্রেম নেই। এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতির বিবেকহীন চর্চা এবং শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। বরং গানের কথাগুলোর মতো করে নিজেদের কাজ ও দায়িত্ব পালনে সচেতন হলেই দেশের মঙ্গল।
ঢাকা শহরের অনেক সমস্যা। সব সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব নয়। তবে অযাচিত অহেতুক শব্দ দূষণ আমরা চাইলেই বন্ধ করতে পারি। উত্তর-আধুনিক এই সময়ে মানুষকে জোর করে কিছু শুনিয়ে পরিবর্তন করা কঠিন। সময়ের দেয়ার লিখন পড়তে পারতে হবে। সময় পরিবর্তন হয়, সময়ের হাত ধরে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের কর্মপদ্ধতি এবং কর্মকৌশলও।
উচ্চস্বরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় একজন বৃদ্ধ মানুষকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হলো আমরা এখনো কতো পিছিয়ে! যে গান ভালোবাসার, সেই গান মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। এই শহর টিকে থাক ভালোবাসার শহর হিসেবে, মানবিক শহর হিসেবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)