স্কুল, কলেজ জীবনে বাবার সাথে বসে সিনেমা দেখতে দেখতেই একদিন মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন যে, ভবিষ্যতে নিজেই যুক্ত হবেন সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে। কৈশোর, শৈশবে হেঁয়ালিবশত দেখা সেই স্বপ্নের ভীত পোক্ত করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। থিয়েটার, চলচ্চিত্র সংগঠনে নিজেকে জড়িয়ে সত্যি সত্যিই একদিন সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত দেখে নিজেই যেনো চমকে উঠলেন! বলছিলাম সেই তরুণের কথা, যিনি ২০১৭ সালে বাংলাদেশে মুক্তি প্রাপ্ত বক্স অফিস কাঁপানো ছবি ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর চিত্রনাট্য লিখে সিনেমায় অভিষিক্ত হন। নাম তার হাসানাত বিন মাতিন। যদিও এরআগে থেকেই বেশকিছু টিভি প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
মেধাচুরি কিংবা অন্যের গল্প নকল করে বাংলাদেশে যখন একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণের মহড়া চলছে, তখন সিনা টান টান করে এই তরুণ গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার মৌলিক গল্প বলার গ্যারান্টি দিয়ে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার জন্য গল্প বলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন। এ বছর তার গল্পে কলকাতার ওয়েব প্লাটফর্ম ‘হইচই’-এর জন্য দীপঙ্কর দীপন নির্মাণ করেছেন ‘লিলিথ’-নামে একটি ওয়েব কন্টেন্ট। বর্তমানে তার হাতে আছে বেশকিছু কাজ। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় গল্প বলার নানা বিষয় নিয়ে তরুণ এই চিত্রনাট্যকার সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন চ্যানেল আই অনলাইনের:
যতদূর জানি, আপনি সিনেমার স্ক্রিনপ্লে লিখতেই এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। নাটক কখনোই করার ইচ্ছা ছিল না, তারপরও কেন নাটক লিখছেন?
চাকরি ছেড়ে যখন এটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে চাইছি, তখন এসে দেখলাম যে লেখকদের জন্য ফিল্মে খুব একটা স্পেস নেই আমাদের। যা হয় সবকিছু একটা কোরামের মধ্যে হয়ে যায়। একটা সিন্ডিকেশন মেন্টেইন করতে হয়।
স্ক্রিনপ্লে রাইটার হিসেবে আপনার শুরুটা কীভাবে?
আমার কাজের শুরু দীপন দার(দীপঙ্কর দীপন) সাথে। সেটা ২০১১ সালের দিকে। এরপর ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর সাথে প্রথম যুক্ত হই, তখন একটা চাকরি করতাম। প্রফেশনালি স্ক্রিনপ্লে রাইটার হিসেবে কাজ শুরু করবো সেটা তখনো নিজের মধ্যে বিল্ড-আপ হয়নি। স্ক্রিনপ্লে রাইটার হিসেবে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দিয়ে শুরু, এরপর কিছু টিভি নাটকের কাজ করেছি। যদিও টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখার ইচ্ছা কখনো ছিল না, এখনো নাই। কিন্তু এখন তো যেহেতু আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্ক্রিনপ্লে রাইটার হিসেবে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করেছি, ফলে রুটি-রুজির জন্য হলেও আমাকে টিভি নাটকেরও স্ক্রিনপ্লে লিখতে হচ্ছে। এই যেমন গত ঈদেও বেশ কয়েকটা নাটক লিখেছি টেলিভিশনের জন্য। এরমধ্যে যেমন ৭ পর্বের নাটক আছে, আবার এক ঘণ্টার নাটকও আছে।
এখন তো শুধু টেলিভিশন নয়, বিভিন্ন ওয়েব মিডিয়ামও আমাদের সামনে। ফলে কাজের প্রচুর স্পেস, প্রচুর গল্প দরকার। শেষ দুয়েক বছরের অবজারভেশন আপনার কি মনে হয়?
স্ক্রিনপ্লে তো রাইটারের কাজ, আর রাইটার হচ্ছে ওই লোকটা যাকে সাদা কাগজ ফেস করতে হয়। যাকে লেখাটা শুরু করতে হয়। তার জন্য তো এক ধরণের প্ল্যান, একটু সময় দরকার হয়। আমাদের প্রেক্টিস তো এরকম না আসলে, রাইটারকে তো সেই সময় টা দেই না। উপরন্তু আরো বহু ধরণের প্রেসার চাপিয়ে দেয়া হয়। এটা হচ্ছে না, ওটা ওইভাবে, এটা করা যাবে না। এরকম নানা ধরনের বাইন্ডিং দেয়া হয়। কাজের স্বাধীনতা তো নাই ই, সময়ও নাই কিন্তু আমার প্রোডাক্টটা ঠিকঠাক চাই। বর্তমানে যে সিচুয়েশন চলছে মিডিয়াতে, এটা ভয়াবহ ব্যাপার।
কিন্তু তারপরওতো অসংখ্য প্রোডাকশন নামছে প্রতিনিয়ত। গেল ঈদেও টিভি প্রোডাকশন, ওয়েবসহ সব ধরণের মিডিয়াম মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক প্রোডাকশন তৈরি হয়েছে?
গেল ঈদে প্রায় তিনশত প্রোডাকশন নামলো, সংখ্যার হিসেবে এটা হিউজ প্রোডাকশন। কিন্তু কোয়ালিটি প্রোডাকশন টা কই? কোয়ালিটি প্রোডাকশনটা কি আছে আসলে আদৌ? সেই সংখ্যাটা কতো? কোয়ালিটি প্রোডাকশন করতে হলে লেখককে সেই স্পেস টা দিতে হবে, সময় দিতে হবে। কোয়ালিটির পেছনে ইনভেস্ট করতে হবে। আমাদের দেশের রাইটারদের যতদিন সেই স্পেস, সেই সুযোগটা না দেবেন, ওই প্ল্যাটফর্ম না দিবেন, ওই সিকিউরিটি না দেয়া হবে ততোদিন এই জায়গাটা ডেভলপ করা প্রায় অসাধ্য।
কিন্তু এটা কি আসলে সম্ভব? ধরুণ আগামী কোরবানি ঈদের সব প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে ৩০০ প্রোডাকশনের চাহিদা রয়েছে, কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে লেখক এর যে প্রস্তুতি বা স্পেসের কথা বলছেন আপনি, সেটা কি দেয়া সম্ভব?
প্রস্তুতি দিচ্ছি না বলেই তো একের পর এক প্রোডাকশন ঠিকই হচ্ছে কিন্তু সেখানে কোনো কোয়ালিটিফুল প্রোডাকশন আপনি খুঁজে পাবেন না। বেসিক্যালি একটি প্রোডাকশন এর জন্য প্রাথমিক স্টেপ হচ্ছে স্ক্রিনপ্লে, কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে এটা জাম্প করে যাচ্ছি। ফলে এ প্রাথমিক স্টেপটা জাম্প করার জন্য হয়তো ডিরেক্টর-প্রোডিউসার কিংবা কোন এজেন্সির সাথে মার্চ হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে স্পেশালি স্ক্রিনপ্লে রাইটিংকে আলাদা করা যাচ্ছে না। আর এটা ঠিক কথা যে, ৩০০ প্রোডাকশন যদি নামাতে হয় ওই সময়টাতো সত্যি সত্যি কারো হাতে নাই। মানে কী, আমাদের ৩০০ প্রোডাকশনের চাহিদা আছে পাশাপাশি এও ঠিক যে ৩০০ জন লোক আছে বাংলাদেশে যারা স্ক্রিনপ্লে লিখতে চায়। কিন্তু তাদের সেই সুযোগটা দেয়া হচ্ছে না, বা এই জায়গায় আসার জন্য যে প্রসেস বা যে স্পেসটা দরকার সেটা তারা পাচ্ছেন না। আর দিন শেষে একজন রাইটারের যে স্বাধীনতা দরকার সেই স্বাধীনতা আমরা দিচ্ছি না। শত বাধা বিঘ্ন পার হয়েও যারা আসছেন তারা ইনসিকিউরিটির জন্য এটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারছেন না। যেকোনো প্রোডাকশনের শুরুটা হয় রাইটার থেকে। কিন্তু কার্যত দেখা যায় পেমেন্টের ক্ষেত্রে উনি হয়তো সবার শেষে পয়সা পাচ্ছেন, আর এটাই হল রিয়েলিটি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মার্কেটে যারা স্ক্রিনপ্লে রাইটিং এ কাজ করছেন, তাদের প্রায় সবাই এইরকম রিয়েলিটির শিকার।
গল্প কিংবা চিত্রনাট্য যারা লিখছেন, তাদের এই দৈন্যদশা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আপনার জানা আছে?
যেহেতু একটা প্রোডাকশন শুরু করেন রাইটাররা, আমার মনে হয় ইচ্ছে করলেই রাইটারকে মূল্যায়ন করা যায়। একটু সদিচ্ছা থাকলেই হয়। রাইটার বেশিরভাগ সময়েই তার পারিশ্রমিক নিয়ে ইনসিকিউরিটিতে ভোগেন। ক্রিয়েটিভ লোক হয়েও যখন টাকা পয়সা নিয়ে ক্যালকুলেশন করতে হয়, তখন সেটা তার কাজেও প্রেসার পড়ে। কিন্তু তাকে যদি রেমুনারেশন এর জায়গাটায় চিন্তামুক্ত রাখা যায়, মেন্টাল বেনিফিট এর জায়গাগুলি এনসিওর করতে পারা যায়, হয়তো ফুল প্লেজারে কোনো কনফিউশন ছাড়াই একটা দুর্দান্ত প্রোডাকশন উপহার দিতে পারেন তিনি।এই যে এখন সাকিব আল হাসানরা দেশের হয়ে দুর্দান্ত খেলে দিচ্ছেন, এর পিছনে কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট আছে। ২০০৭ সালে যখন আমরা ওয়ার্ল্ড কাপে গেলাম খুবই আনাড়ি একটা দল। দু একজন সিনিয়র আর বাকি সব জুনিয়র প্লেয়ার। আমরা জানতাম যে আমরা ওই বিশ্বকাপে কিছুই করতে পারবো না। এমনটা জেনেও কিন্তু আমরা ইনভেস্ট করে গেছি তাদের পেছনে, আমরা ভেবেছি যে নতুন জেনারেশন তৈরি হচ্ছে, হয়তো সামনে এদের পেছনে ইনভেস্ট করে যেতে থাকলে একদিন না একদিন ভালো খেলবে। দেখুন ২০১৯ সালের যখন বিশ্বকাপ হচ্ছে তখন সেই সব আনাড়ি খেলোয়ারদের পারফর্মেন্স! সাকিব, তামিম, মুশফিকরা কতো দুর্দান্ত খেলছে। যদি ওই সময়ে ভালো খেলছে না বলে তাদের পেছনে ইনভেস্ট করা বন্ধ করে দেয়া হতো তাহলে কিন্তু এই ফিডব্যাক আমরা পেতাম না। এই বেনিফিট আমরা এখন পেতাম না।ইনভেস্টমেন্টের এই কালচারটা যদি প্রত্যেকটা সেক্টরে এপ্লাই করা হয়, তাহলে সব সেক্টর থেকেই আমার ধারণা এমন ফিডব্যাক পাওয়া সম্ভব।
ইনভেস্টমেন্ট এর যে উদাহরণ টানলেন, এরকম মানসিকতা কোনো ডিরেক্টর কিন্তু প্রযোজক মধ্যে আছে বলে মনে হয়?
সবাই তো এ বিষয়ে সচেতন নয়। কিন্তু আমি এরকম বহু দেখেছি, সংখ্যাটা হয়তো কম। যারা এ জায়গাটা রেস্পেক্ট করেন, যারা না পারলেও চান অন্তত এই জায়গাগুলো ঠিকঠাক হোক। তারা অন্তত শুরু করুক। কাউকে না কাউকে শুরু করতে হয়। এখন সারা পৃথিবীর মার্কেট এক জায়গায় হয়ে গেছে, ফলত কম্পিটিশনও গ্লোবাল। পৃথিবীর সমস্ত প্রোডাকশন এখন ঘরে বসে দেখা যাচ্ছে। এখন আমি কোন্ ঈদকে সামনে রেখে ৩০০ কিংবা তার চেয়ে বেশি প্রোডাকশন নামালাম এটা ম্যাটার করে না, বরং তার থেকে তিনটা প্রোডাকশন গ্লোবাল মার্কেটে ফাইট দিতে পারলো কিনা আর সেই মানের হয়েছে কিনা এটা ম্যাটার! কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটি রক্ষায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কিনা, এটা দেখতে হবে। আমার মনে হয় কোয়ান্টিটি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন এরকম একজন লোকও যদি এগিয়ে আসেন যে, না। এবার তিনটা প্রোডাকশন হবে, এবং এ প্রোডাকশনগুলো গ্লোবাল ফাইট দেয়ার মত। দ্যাটস এনাফ। ইন্সপিরেশন তো একজন থেকেই আসে, কেউ শুরু করলো তো!
সিনেমার কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় চাহিদার তুলনায় অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে রাইটার আমাদের নাই বললেই চলে, একটা গল্প বা চিত্রনাট্যের জন্য যে সময় এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন তা একজন স্ক্রিনপ্লে রাইটারকে দেয়া হয় না। বলিউডের দিকে তাকালেও দেখবেন যিনি মৌলিক চিত্রনাট্য লেখেন তার কিন্তু বছরে দুই তিনটা চিত্রনাট্য লেখার সুযোগ খুব কম। এই ক্ষেত্রে রাজ কুমার হিরানির কথাও বলা যেতে পারে। তো ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার তুলনায় সেই মৌলিক চিত্রনাট্যকার কে দিয়ে কি সারা বছর হল চলবে? এরজন্যই কি গল্প নকল করে সিনেমা নির্মাণের বিষয়টা বাড়ছে না?
মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা করার চর্চা বলিউডে বহু আগেই শুরু হয়েছে। আজকে যে সিনেমাটা হচ্ছে তার বেজমেন্ট বহু আগেই তৈরি হয়েছে, এটা একটা সিমালটেনিয়াস প্রসেস। ধরুন বলিউডে প্রতিবছর ২০০ সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, তার মানে সেখানে অন্তত ২০০ নির্মাতাও আছেন। কিন্তু তার মধ্য থেকে আমরা অনুরাগ কাশ্যপ, সুজিত সরকার কিংবা এমন কয়জনের নাম জানি! এই যে রাজকুমার হিরানি আমাদের কথায় চলে আসলো, তার নামটা কেন আসলো? কারণ তিনি মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা করেন, কারণ দে মেড দ্য প্রসেস রাইট…। সেটা হোক তিন বছরে একটা সিনেমা। ফিলোসফিক্যাল জায়গায় তারা ঠিকঠাক আছেন, কাজের প্রতি তাদের সততা আছে।
গল্প বলা কিংবা চিত্রনাট্য লেখার পেশা বেছে নেয়া আমাদের এখানে রীতিমত আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।তো চাকরি বাকরি ছেড়ে এরকম একটা পেশায় কেন নিজেকে জড়ালেন?
এইতো একটু আগে বললাম, কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হয়। আমি চাইছি কাজটা ঠিকঠাক ভাবে শুরু করতে। আগেই বলেছি আমার কাজের শুরু দীপঙ্কর দীপনের সাথে, যখন উনার সাথে কাজ শুরু করি তখন আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। থিয়েটার করি, লেখালেখি করি, টুকটাক অ্যাক্টিংও করতাম। সে সময় প্রচুর সিনেমা দেখতাম, ভাবতাম, সিনেমা নিয়ে লেখার চেষ্টা করতাম, সেই সময়ে ভাবনাটা মাথায় এলো যে ক্যামেরার পেছনে ক্রিয়েটিভ কিছু করা যায় কিনা! সেই জায়গা থেকে ২০১১ সালে আমি পুরোপুরি যুক্ত হই। কিন্তু কাজ করতে এসে দেখলাম এই মিডিয়ামে প্রচুর ঝামেলা, তখন আবার আমি চাকরি-বাকরিতে ঢুকে গেলাম। কিন্তু চাকরি করলেও সেই সময় আমার মাথার মধ্যে একটা প্ল্যান ছিল, চাকরি করলে আমি কতদিন করব? বেসিক্যালি নিজের মধ্যে কনফিডেন্ট গ্রো করেই এখানে আসতে চেয়েছিলাম। যে হ্যাঁ, এখন আমি প্রস্তুত। আমি পারবো। এই কনফিডেন্ট যখন নিজের মধ্যে পেলাম তখন ভাবলাম হ্যাঁ, এখন যে কোনো রিস্ক নেয়া যায়। এটা ঠিক, প্রচুর স্ট্রাগলিং এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে আমি টোটালি স্ক্রিনপ্লে রাইটার হিসাবে নিজেকে ফোকাস রাখছি, এবং সেটা অবশ্যই সিনেমার জন্য। আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী, চিত্রনাট্যকার হিসেবে আমি আমার পরিকল্পনার কাছে যেতে পারবো কিনা, কিন্তু আমি আমার সমস্ত কন্সেন্ট্রেশন সিনেমার জন্যই আপাতত রাখছি। তবে আমি আত্মবিশ্বাসী এই জায়গাটা এ প্লাটফর্মটা আমাদের এখানে তৈরি না থাকলেও আমি আমার নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।
তাহলে আপনি সিনেমারই চিত্রনাট্য বা গল্প লিখতে চান? কিন্তু আপনাকে যে মাঝে মাঝে আবার নাটকও লিখতে হচ্ছে। অতীতে আমরা দেখেছি ১ ঘন্টার নাটকের গল্পগুলো প্রচুর সিনেমার গল্পকে কিল করেছে। আপনার কি মনে হয়?
হ্যাঁ, এটা সত্য। আমরা টেলিভিশনে প্রচুর ভালো গল্প বলেছি যেগুলি সিনেমা হওয়ার মত বা খুব ভালো সিনেমা হতে পারতো। ওইখানে কম্প্রোমাইজ করেছি বলেই আজকে আমাদের সিনেমার দুরাবস্থা তৈরি হয়েছে। চিত্রনাট্য বা গল্প বলার ক্ষেত্রে আমি খুব কনশাসলি চেয়েছি যে টেলিভিশন নাটক থেকে দূরে থাকতে এবং এই বিষয়গুলো যদি আমি ধীরে ধীরে সেক্রিফাইস করতেই থাকি, একটা পর্যায়ে যে সেই ফ্লো টা আর থাকে না, এখন যা হয়েছে। তো আমার টার্গেট হচ্ছে তাই, পারতপক্ষে টিভি কেন্দ্রিক গল্প বলার ধারে কাছে যাচ্ছি না। আমি বলছি না নাটক খারাপ বা সিনেমা ভালো, দুটো দুইটা মিডিয়াম, ডিফারেন্স স্ক্রিনিং, ডিফারেন্ট আস্পেক্ট।
‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর পর আর কোনো সিনেমার স্ক্রিনপ্লে করেছেন?
‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর পর এই মুহূর্তে আমি একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। এটা একটি ইন্ডিপেনডেন্ট প্রজেক্ট। আপাতত এটি নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। তবে এই টিমের সাথে কাজ করে মজা পাচ্ছি, ভালো একটা সিঙ্ক হয়েছে। স্টোরি লাইন টা করছি আপাতত, এটা বিল্ড-আপ হলে স্ক্রিনপ্লেতে হাত দিব। আশা করছি এটি একটি ভাল প্রজেক্ট হবে, দেখা যাক। দ্বিতীয়ত, দীপন দার ‘অপারেশন সুন্দরবন’ চলচ্চিত্রের রিসার্চ টিমে ছিলাম। এখন পর্যন্ত এই ছবির যে স্টোরিলাইন রয়েছে সেটা আমার করা। হয়তো এখন তার উপরে স্ক্রিপ্ট হবে। ইন্ডিপেনডেন্ট ওই প্রোজেক্টের জন্য আপাতত আমি ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এ কাজ করছি না। তবে সামনে এর স্ক্রিনপ্লেতে কাজ করবো কিনা না এটা এখনো জানিনা। এছাড়াও আরও কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে কথা হচ্ছে।
টিভি প্রোডাকশন কিংবা সিনেমার বাইরে এখন তো ওয়েব প্রোডাকশন এর বাজিমাত। ভারতে বিভিন্ন দুর্দান্ত ওয়েব কন্টেন্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় ওয়েব সিরিজ-এর গল্প বলার ক্ষেত্রে যে আলাদা একটা ভাষা আছে, সেটা কি আমাদের এখানের নির্মাতারা রপ্ত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় আপনার?
ওয়েব সিরিজ কাজ করা বা এই মিডিয়ামটা আমাদের জন্য একটা আশীর্বাদের মতো। পুরো ফ্রিডম নিয়ে কাজ করার মত একটা মিডিয়াম। সিনেমায় তো স্বাধীনভাবে অনেক কিছুই বলা যায় না, সেন্সর এর বিষয় মাথায় থাকে, আমাদের আর্থসামাজিক বিষয় কাজ করে। কিন্তু ওয়েব এ এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নাই। আমার হাতে একটা স্মার্ট ফোন আছে, তারমানে পৃথিবীটা আমার।
আমরা কি ওয়েবের প্রপার ইউটিলাইজ করতে পারছি?
না, আমাদের মেন্টালিটি টা এখনো আগের মতোই রয়েছে। ওয়েব মিডিয়াম তো সিঙ্গেল মানুষের ইমোশন কে ধরে, কিন্তু আমরা এখনো শেয়ার্ড স্ক্রিনের ইমোশনে পড়ে আছি। স্টেরিওটাইপ যে চিন্তা ভাবনা, তা থেকে বের হতে না পারলে যতো ফ্রিডম নিয়েই আমাদের সামনে বিভিন্ন মিডিয়াম আসুক আমরা তার প্রপার ইউটিলাইজ করতে পারবো না। আমাদের পাশের দেশের নির্মাতারাও যেখানে ওয়েব প্লাটফর্ম গুলোকে ব্লেসিং হিসেবে দেখছেন, নিউ ফিল্ড হিসেবে দেখছেন সেগুলোকে এক্সপ্লোর করার ইচ্ছাটা আমাদের নির্মাতা দের মধ্যে গ্রো না করলে কিছুই সম্ভব না।
স্টোরি টেলার কিংবা যিনি স্ক্রিনপ্লে করেন তখন গল্পটা নিয়ে তার তো এক ধরনের ইমাজিনেশন থাকে, কিন্তু চিত্রনাট্যটা যখন ডিরেক্টরের হাতে যায় তখন ডিরেক্টর তার মত করে চিন্তা করেন, পর্দায়ও তার ইমাজিনেশনটাই আমরা দেখি। এতে কি স্টোরি টেলার এর যাতনা হয়?
এটা পৃথিবীর সব রাইটারের থাকে। এই যাতনা থেকে মুক্তি কোন স্টোরি টেলার পাননি বলেই আমার মনে হয়। আবার এটাও ঠিক, বলা হয় যে স্ক্রিপ্ট তৈরি হওয়ার পর গল্পটা মারা যায় এবং তার পরের প্রসেস এ ডিরেক্টর-এক্টর সবাই মিলে সেই গল্পটাকে নতুন আরেকটা জীবন দেন। সেই লাইফটা দেখতে যে রাইটারের ইমাজিনেশন এর মতো হতে হবে এমনটার বাধ্যবাধকতা নেই। রাইটাররা এটা মেনে নেন। আমার সাথে দুই ধরনের ঘটনা ই ঘটেছে।
চিত্রনাট্য নিয়ে যাপনের প্ল্যান কি আপনার?
সিনেমায় গল্প বলতে চাই, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে চাই। এখন আমি জানি একটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট বা স্ক্রিনপ্লে এক মাসে লেখা সম্ভব না। ইনফ্যাক্ট এক বছরে লেখাও সম্ভব না। যেহেতু আমাদের রিয়েলিটি ভিন্ন, সেহেতো যতোটুকু সেক্রিফাইস করে কাজ করা যায় আমি সেটাও করতে চাই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে ধরণের সিনেমা হচ্ছে সব ধরণের সিনেমা নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। কমার্শিয়াল কিংবা আর্ট ফিল্ম নিয়ে যে দ্বন্দ্ব আমি সেইসব বিভাজনে যাচ্ছি না, আমি সব ধরনের সিনেমা চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতে চাই এবং সামনে হয়তো করব ও। বেসিক্যালি আমি এই কাজটা করতে চাই, কারণ আমি নিজেও এক সময় সিনেমা নির্মাণ করবো। হয়তো বয়স যখন চল্লিশ হবে, তখন। কিন্তু তার আগে পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য আমি বেশ কিছু কাজ করতে চাই।
এই সময়ে সিনেমার গল্প কেমন হওয়া উচিত?
আমার মনে হয় আমরা এক ধরণের টেকনোলজিক্যাল ডিসটোপিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ফলে এখন ভাবতে হচ্ছে আমরা আসলে ফিল্ম এ কোন্ গল্পটা বলবো? ফিল্মে কি এখনো আমরা সেই প্রাচীন গল্পগুলি বলবো, নাকি এই সময়ের গল্প বলবো, নাকি ভবিষ্যতের? এইটা যে কোন কিছু হতে পারে। তবে আমার মনে হয় আমরা এমন একটা সময় এর মধ্যে এখন বাস করছি যে সময়টার কাছাকাছি কোন সময় পৃথিবীতে আগে কখনো এক্সিস্ট করে নি। মানুষের এখন দুইটা রিয়েলিটি! গতানুগতিক রিয়েলিটির সাথে যুক্ত হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। এক ধরণের ট্রাঞ্জিশান পিরিয়ড চলছে। সিনেমা হল থেকে সিনেমা এখন ঢুকে যাচ্ছে নেটফ্লিক্স এমাজনের মত প্লাটফর্মে যেখানে যে যার ইচ্ছামত কন্টেন্ট দেখতে পারছে। ফলে সিনেমা হলেরও কদর কমছে। ভবিষ্যতে সিনেমা হলে শুধু সেই সিনেমাগুলোই চলবে যেগুলো এক ধরণের স্পেশাল এক্সপেরিয়েন্স দেবে। থ্রি ডি বা ফোর ডি সিনেমার মত। পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় আছে। এখন ফেসবুক বলেন, গুগল বলেন এগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা চলছে এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন একটা জায়গায় যাচ্ছে, যেগুলো সেল্ফ বিল্ড-আপ হচ্ছে। আমরা আর তার জন্য কোডিং করছি না, সে তার নিজের কোডিং বানাচ্ছে এবং নিজে নিজে ডেভলপ হচ্ছে। আমরা জানিও না সে কোন কোন সোর্স থেকে ইনফরমেশন নিয়ে সেল্ফ-ডেভলপমেন্ট করছে। যার ফলে আমরা ধীরে ধীরে একটা ভয়ঙ্কর ডিকটেটরশিপ এর দিকে যাচ্ছি। যেখানে হয়তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই বলে দিবে আমার কখন কি করতে হবে। এসব দিক বিবেচনা করে আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে প্রচুর ডিসটোপিয়ান গল্প দেখানো দরকার যেগুলোতে বলা হবে যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে যদি আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে না লাগাতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে আমাদের কি অবস্থা হতে পারে। তাহলে সেগুলো দেখে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হবে এই ধরনের ভবিষ্যৎকে রুখে দেবার। আর এই ক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখা দরকার বলে মনে করি। ডিসটোপিয়ান স্টোরিগুলোকে অনেকেই ভাল চোখে দেখেন না। এটা অনেকটা সমালোচনা সহ্য করতে না পারার মত মানসিকতার সামিল। তবে আমি মনে করি ডিসটোপিয়ার গল্প তারাই বলে যারা চলমান সময় নিয়ে চিন্তা করে, মানুষের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে।