সেই কবে চুয়াল্লিশ বছর আগে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যাত্রা শুরু। জমি বাড়েনি। কিন্তু জন বেড়ে এখন ষোল কোটি। কম জনসংখ্যার দেশ থেকে কেউ আসলেতো হাঁপিয়ে উঠেন মুহূর্তে। কিন্তু বাংলাদেশের কেউ প্রবাসে দীর্ঘকাল কাটিয়ে ফিরেও কম হাঁপিয়ে উঠেন না। আজকালের ফেসবুকের তাদের অনেকের ‘মহাবিরক্তির’ ম্যানম্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হয়। কতো কথা, কতো প্রশ্ন, আছেন কেমন করে এ দেশে? দেখলেন না, ঢাকা শহর হচ্ছে বসবাসের অযোগ্যতা বিচারে দ্বিতীয়। উত্তরে একজনকে বললাম, পঁয়ষট্টি বছরের এই জীবনে অযোগ্যতায় অদ্বিতীয় অবস্থানে এই দেশে, এই ঢাকায় পড়ে আছি মিঠাইয়ের মাছির মতো। স্বদেশের তরে একাত্তরে একবার কিছুকাল প্রতিরোধজ্ঞান অর্জনে পাশের দেশে গিয়েছিলাম। তারপর স্বদেশ জিনিসটা যে কী মিঠাই, কী মণ্ডা, অযোগ্য এই জননীর নরোম পুরোনো শাড়ির আশ্রয় এখনো কোনোমতে বেঁচে বর্তে আছি। আমার পদ্মা, আমার মেঘনা, আমার যমুনা-সুরমা। তোমাদের মিসিসিপি, তোমাদের দানিয়ুব, তোমাদের নায়াগ্রা নিয়ে সবাই ভালো থেকো। আমাদের পঁচা-গলা-দূষিত বুড়িগঙ্গাকে পরিশোধিত করতে পারি আর না পারি, কবি জীবনানন্দ হয়ে রয়ে যাবো এই বাংলাতেই। জানি, অনেকে বলবেন, এসব অযোগ্যতার ছিঁচকাদুনে পালাগান। উত্তরে বলি, পালাগান তো বটেই, তবু পালাবার গান নয়। আজ দু’ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা ডুবে গেছে, নিশ্চল হয়ে গেছে, তবু এই ঢাকা বুকে নিয়েই সব ফাঁকা, সব শূন্যতা ঘুচাতে জানি।
দিল্লী-মুম্বাই-কলকাতা-জাকার্তাসহ অল্প সময়ের প্রবল বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার যে চেহারা প্রায়শঃ দেখি, ঢাকাও সেরকমই, কখনো কখনো বেশি। অমর্ত্য সেন একবার বলেছিলেন, ঢাকা শহরটি তৈরি হয়েছিলো হাজার পঁচিশেক লোকের বসতির জন্যে। তারপর? ২০১৫ সনে সেই ঢাকা ও তার চারপাশে প্রায় পাঁচ কোটি ‘পুঞ্জে পুঞ্জে’ ধেয়ে এসেছে, আসছে। পরিকল্পিত বিকাশের সুযোগ এ শহর, এ মহানগরী পায়নি। জোড়াতালি আর তালিজোড়া। ঢাকা থেকে অতিবর্ষনের জল বেরোবার সব খাল প্রায় বন্ধ, ঢাকার চারপাশের নীচু জায়গা নানাভাবে ভরাট হয়ে চলছেই, ঢাকা এখন টাকা বানাবার বিশাল গণ টাকশাল। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু উত্তরবঙ্গের মঙ্গা বিতাড়িত করেছে, মঙ্গাপীড়িতদের অনেকেই এখন রাজধানীতে মানবমৌমাছি।
ঢাকা যোগ্য হোক না হোক, এই ঢাকাতেই ছিলাম, আছি, থাকবো। প্রেসিডেন্ট ওবামা ওয়াশিংটন-নিউইয়র্ক পথে একঘণ্টা যে যন্ত্রযান দেখবেন, আমাদের ঢাকায় তার চেয়েও বেশি দেখবেন এক মিনিটেই। বসবাসের ‘অযোগ্য’ এমন ঢাকাকেই প্রভাবিত করতে এখন দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় দেশের কূটনীতিকদের শীতকালেও ঘাম ঝরাতে দেখি। বড় দেশটির প্রফেসর রাষ্ট্রদূত আমাদের ছোট দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার না পেয়েই কূটনীতিকের জীবন সাঙ্গ করেছেন। এখনকার রাষ্ট্রদূত অবশ্য ঐ প্রফেসরের মতো ‘আর মার কাট কাট’ আওয়াজ করেন না, অবেশেষে এই সেদিন বার্নিকাট অাপ্পু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হতে পেরেছেন ‘মজিনা-উদ্ধত্য’ নীতি পরিহার করে। ‘অযোগ্য’ কূটনীতিক মজিনা অধ্যাপক, আপনি অবসর জীবনে কোথায় বকবক করছেন জানি না। ‘যোগ্য’ পরিণত হওয়া বার্নিকাট ম্যাডামকে শুধিয়ে জেনে নিন, ঢাকার নানা প্রকারের ইত্যাদি ধরনের প্রভৃতি অশীল-সুশীলদের কাঁচা পরামর্শে না চলাটাই তিনি বুদ্ধি করেছেন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে আজ অল্প সময়ের অঝোর বর্ষণে ‘জলাবদ্ধতার’ পাশাপাশি ইতিহাসের রেকর্ডভাঙা ‘যানবদ্ধতা’ দেখা গেছে। ফেসবুকে সেসবের তিনটি ছবি দিয়েছি, ‘ঢেনিস এক-দুই-তিন’ শিরোনামে। ভেনিস আজ ঢাকায় হয়ে গেছে ‘ঢেনিস’। আজ জাতীয় সংসদের নতুন করে শুরু হওয়া অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার এমনি বেহাল জলাবদ্ধতার সমস্যাটি সমাধানে তিন বছর সময় লাগবে। ঢাকার চারপাশ ভরাট করে চলেছে ক্ষমতাশীল মালপানিওয়ালা ব্যক্তি ও শক্তি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীতো হারকিউলিস হলেও এক্ষেত্রে হার মানতে বাধ্য হবেন বিবেচনা করি। প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্বৈরতন্ত্রী-একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী বলে সেই ‘ক্ষমতা’ প্রেসিডেন্ট এর সঙ্গে ভাগাভাগি করে দেবার ফর্মুলা প্রদান করেছেন জ্ঞানী-সুশীলেরা। অথচ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার রাজনীতির প্রয়োজনে কতো জায়গায় যে কতোরকম আপস করে চলতে হচ্ছে, তা সবচেয়ে ভালো জানেন তিনিই। আপাততঃ বিরোধীপক্ষ পরবর্তী আঘাত হানার প্রস্তুতি সম্পন্ন করার ফাঁকটুকুতেও প্রধানমন্ত্রীকে সুখে থাকতে দিলো না কোন কোন ঘটনা?
২০০৮ সনে মহাবিজয়ের পর মন্ত্রিসভার শপথের দিনে বঙ্গভবনে চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সাহেব তার নামফলক দেখে শপথ নেবার জন্য অপেক্ষমান পংক্তিতে বসবার উপক্রম করতেই মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, স্যার, এই ইঞ্জিনিয়ার আপনি নন। ইনি ফরিদপুরের। ইনি ইঞ্জিনিয়ার এবং মোশাররফ। তবে খন্দকার। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের আনন্দবদল বেলুনখানি চুপসে গেলো হঠাৎ করে। জাতি একজন আকস্মিক অভাবনীয় নবমন্ত্রী পেলেন। এ মুখে সে মুখে কানকথা গুজবে জানা গেলো, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কন্যার শ্বশুর বেয়াইকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে নাকি বাধ্য হয়েছেন। যিনি বেয়াই তিনি মন্ত্রী। সমাসবদ্ধ বাক্যটি কেমন হবে জানি না। ছয় বছরেরও অধিক মানবসম্পদ রফতানির মন্ত্রণালয় সামলেছেন এক প্রকার বিনা স্ক্যান্ডালে। এ যে কম কথা নয়। আজ এই লেখাটির সময়ে বৃষ্টির জলের ঢেউয়ের পরিণতিতে সৃষ্ট সমালোচনার তরঙ্গের এইতো কয়েকদিন আগে ফরিদপুরের এক পতিত জমিদারের সম্পত্তি নিয়ে উঠেছিল ‘জাতীয় বেয়াই-তরঙ্গ’!
যে ‘বেয়াই তথা বেহাই তথা বৈবাহিক’ ব্যক্তিটিকে নিয়ে ছয় বছরের ওজারতিতে কোন প্রকার কুৎসা কিংবা গুজবের ঢেউ দেখিনি, তখন হঠাৎ দেখলাম, ক্ষমতাসীন দলের আনুষ্ঠানিক দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে নানা পটভূমিতে দফতরবিহীন করে সেই দফতর তুলে দেয়া হলো ঐ বেয়াইসাহেবকেই। শোনা গিয়েছে অন্য আওয়ামী রুই-কাতলা-চিতল-বোয়াল নেতারা নাকি দ্বিতীয় ব্যক্তির দফতর নিয়ে নিতান্ত নারাজ ছিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে একসময় অনুমতি গ্রহণের কেতা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বেয়াই সাহেব তার দায়িত্ব পালনের উচ্চতর পর্বের সূচনা করলেন। এসবক্ষেত্রে অনেকেরই ঈর্ষা উৎপাদিত হওয়ার কথা। স্বীয় তনয়-নাওখানি অমন বিশাল বৃক্ষে প্যাঁচ দিয়ে ভেড়াবার সাফল্যেইতো আজ কপাল ফেটেছে কিংবা ফুটেছে ফরিদপুরের নুরু খন্দকার পুত্রের।
কিন্তু হায়রে! এভারেস্ট’এ ওঠার পরবর্তী ধাপ হলো নেমে আসা। সেই নেমে আসা সবার জন্য সুখের হয় না। হঠাৎ তেমনি পতনে যা ঘটলো তা হলো বেয়াই-এর মান-সম্মান-নৈতিক অবস্থান ইত্যাদির ব্যাপক বিপর্যয়। যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন কলকাতা থেকে ফিরে গুন মজুমদার ‘সত্যের যত গুহা’ উন্মোচন করুন না কেনো, গণমানুসের কাছে তা ‘ক্রসফায়ার’-এর গল্পের মতোই। একটু লোভের পিচ্ছিলতায় না হড়কে গেলে কী হতো! ১৯৭১ সনে বেয়াই পিতা-তাওই সাহেবের ভূমিকা নিয়ে এতো টানাটানি হতো না। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হলো কার? হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান সংগঠন এ সমাজের কাছে কার মাথা চূড়ান্ত পর্যায়ে হেঁট হলো?
যা ক্ষতি হলো তা ‘বেয়াইন’ নেতৃত্বের। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে তিনি ছোট হলেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় এ নিরানন্দ খবরটি ছাপা হলো বেদনার সাথে। যুদ্ধাপরাধী জোট উল্লসিত হলো মুফতে মুনাফায়। ঘটনাটির দৃশ্যমান ঢেউ যদি কমও হয়, এর রয়েছে বিপজ্জ্বনক ফল্গুধারা। ঘটনাটি স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি মারাত্মকভাবে বিড়ম্বিত করে চলবে। গুহ মজুমদাররা পুরোনো বিশাল জমিদারীর মালিক। নব্য জমিদার খন্দকাররা ফাঁদে ফেলে অতি স্বল্পমূল্যে গুহ মজুমদারদের সম্পত্তির মালিকানা পত্রে এক ধরনের ‘হিংস্র উল্লাস’ও এতে নিহিত থাকে। ক্ষমতার এমনি দাপট আখেরে কাল হয়ে দাঁড়ায়। মূল ক্ষমতার নিকটজনেরা দেশে দেশে যুগে যুগে অনেক সর্বনাশ ডেকে এনেছে। ভারতের গান্ধী পরিবারের জামাই রবার্ট ভদ্র ‘জমি ব্যবসা’ নিয়ে যে অভদ্র কান্ড করছে, তার মাশুল দিতে হয়েছে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে। এমনি কতো শত উদাহরণ কালের পাতায়। জানি না আমাদের জাতির কেন্দ্রীয় শেষ ভরসা- নেতৃত্ব কীভাবে এ ঘটনার প্রতিকার করবেন?
বেয়াই-ঢেউ কিংবা বেয়াই ফল্গুধারা যাই বলুন না কেন, তার পাশাপাশি এই আগস্টে হঠাৎ দেখা গেলো ‘স্বদলীয় ক্রসফায়ার’! শেখ পরিবারের তরুণ স্বল্পবাক সদস্য তাপস এমপি পর্যন্ত এহেন ঘটনায় গর্জে উঠলো। এতে মূল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিবৃত হয়ে পড়লো। এর চেয়েও অনেক বড় আকারে গর্জে উঠলেন শেখ পরিবারের অতি প্রভাবশালী সদস্য শেখ সেলিম, ১৫ আগস্ট নিহত শেখ মনির ছোট অনুজ, তাপসের পিতৃব্য।
হঠাৎ করে তার ক্রোধের ছোবল পড়লো জাসদ-এর উপর। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতকল্পে জাসদ সশস্ত্র লড়াই করেছিল। সেই জাসদ কালের পরিক্রমায় এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাজোটে। জাসদ নেতা ক্ষমতার মঞ্চে বসে যেভাবে প্রতিপক্ষ খালেদা এবং যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী জোটের বিরুদ্ধে গর্জন তুলেছেন, তাতে দেখেছি বিশেষতঃ চেনা জানা বিএনপি মহল জাসদ নেতার উপর প্রচণ্ড খাপ্পা। একদিকে ২০ দলীয় জোটকে ভাঙ্গতে চায় ক্ষমতাসীনেরা, বিপরীতে ওরাও ১৪ দলীয় জোটকে এলোমেলো করে দিতে চায়। আমাদের ‘সর্বাগ্রে আলোকিত’ পত্রিকার নীতি নির্ধারকেরা এই প্রকল্পটিকে অনেক আগেই হাতে নিয়েছে ভালোভাবে। পূর্বতন জাসদ মহলের একজন লিখিয়ে ‘গণবাহিনী কমরেড’কে তার এ কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। ঐ ‘লিখিয়ে গণবাহিনী’ ভ্রাতার প্রধান আক্রোশ কর্নেল তাহের (অব.) এবং তদীয় জীবিত ভ্রাতাদের ওপর। ভায়ার তীব্র আক্রোশ ক্ষমতাসীন জাসদ মন্ত্রীর ওপরও। এসব আক্রোশের মিশেলে আলোচিত প্রকাশক থেকে একটা পুস্তকও প্রকাশিত হয়েছে অনেক শব্দ-সানাই-বিউগেল ব্যবহার করে। ১৯৭২-৭৫ সময়কালের জাসদ যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কতটুকু খতরনাক আচরণ করেছে সেটাকে জোরে শোরে তুলে ধরার প্রকল্পটি বেশ জম্পেশ হয়েছে।
২০১৫ সালের আগস্টে শেখ সেলিমতো বজ্রনির্ঘোষে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ক্ষমতাসীন জাসদ-এর ওপর। হঠাৎ টর্নাডো। সুযোগমতো কিঞ্চিৎ ইলিমড় তুলতে চাইলেন আওয়ামী নেতৃত্বের ‘মৎস্যাজীবী’ নেতা কুষ্টিয়ার হানিফ ভ্রাতা। ক্ষমতার কেন্দ্রীয় স্থাপনা সব কেমন হাল্কা ভূমিকম্পে নড়বড় করে উঠলো। তা শেখ সেলিম কী ভুল কথা বলেছেন? মোটেও না। তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বাঙ্গবন্ধু নিজস্ব বাহিনী এভাবে ফ্রাংকেনস্টাইন কিংবা বিভীষণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলবে, তা কেউ ভাবেনি। এককালে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি যাদের সহ্য হতো না তারা কোন এক ইশারার বুতামে হঠাৎ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ বনে গেল? বিনা প্রক্রিয়ায়। পরম গরম বুলিতে রাজনীতির বাদামভাজা ভালোই চললো। বঙ্গবন্ধু-নেতৃত্বকে দুর্বল করার প্রকল্পটি সফল করে দেবার কাজে জাসদ ব্যবহৃত হলো শতকরা একশত ভাগ। ইতিহাস থেকে এ সত্যটি মুছে দেবার শক্তি কারো হাতেই নেই। কিন্তু ১৯৯৬ সনে ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য শেখ হাসিনাকেতো অনেক ‘কৌশল’ করতে হয়েছে। সে সব ‘ কৌশল’ যে সবই নৈতিকভাবে ‘অনুমোদন যোগ্য’ তাতো নয়। যেমন একই সঙ্গে তিন অ-অ-অ অর্থাৎ আর্মি-আরব-আমেরিকাকে একরকম তুষ্ট করেই রাষ্ট্রক্ষমতায় বিস্ময়করভাবে তিনি আসীন হলেন। জামায়াতের সাথে ‘যুগপৎ’ আন্দোলন ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের সাথে অনুকূল বাতাবরণ গড়ে তোলা, ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য যা প্রয়োজনীয় ছিল; এমন বিশ্লেষণও শুনি হাসিনার নিকটমহল থেকে। ২০০৮ সনে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্যও নানা ভিতর-বাহিরের শক্তির সাথে সমঝোতা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ২০১৪ সনে রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কম নমনীয় হতে হয়নি ‘স্বৈরাচারী’ হাসিনাকে। পরিবারের ঘরে-বাইরে শেখ হাসিনাকে নীরবে-নিঃশব্দে যে কতো প্রকারের কূট-ঝুট কারবারে যুক্ত হতে হয় এটা জানেন শুধু তিনিই। আওয়ামী লীগকে আরও ১৩টি খুচরা দলকে জুটাতে গিয়ে কাঠ-খড় কেমন করে পোহাতে হয়েছে, তার অনেককিছুই আমরা জানি না। জানার কথাও নয়। এমনি একটি সমঝোতা ফ্রন্ট ছিলো জাসদ।
ততোদিনে জাসদ অনেক খণ্ডড। জাসদ (ইনু) সে বিচারে সক্রিয় এবং কিঞ্চিৎ সংঘবদ্ধ। শেখ সেলিম ইতিহাস জানেন, শেখ হাসিনা জানেন না? তিনি এ-ও জানেন, রাজনীতি হচ্ছে অগ্রাভিযান আর পশ্চাদপসরণের যুগপৎ খেলা। তিনি জানেন ১৯৭৫ আর ২০১৫ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি আর রণকৌশলের সময়কাল। কাকে কাকে তার কখন প্রয়োজন, বিপরীতে তাকে কখন কার প্রয়োজন– এসব হিসাব কিভাবে ঠিকমতো না জানলে যে ক্ষমতায় টেকাই দায়– এ সত্য হাসিনা জানেন অনেক ভালোভাবেই। আমেরিকা আর ইউরোপের তীব্র বিরোধীতার মুখে ভারত-চীন-রাশিয়া-জাপান-কোরিয়াকে একসূত্রে গাঁথার কূটনীতি তিনি মন্দ দেখাননি। তা শেখ সেলিম-মাহবুবুল হানিফের সমস্বর জাসদ-ব্যাদানের রহস্য কী? হঠাৎ এই ঢেউ উঠলো কেন? শুধুই ওজারতি না আবার দুঃখে আর ক্ষোভে? কেননা দু’জনেরইতো তেজারতি মন্দ নয়। শেখ সেলিমকে জমা-খরচ দিয়েই নাকি চলতে হয় বাংলাদেশের সব রুই কাতলাকে!
এদিকে খালেদা মহলও খুশিতে বাগ বাগ হয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে জাসদের বিচার দাবি করে বসেছে। জেনারেল জিয়া যে বঙ্গবন্ধু-হত্যা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিলেন, সেটা এখন আর তর্কের বিষয় নয়। এখন চালনী দেখছি সূঁইয়ের ওপর বেজায় খাপ্পা। বাংলাদেশ অনেক তীব্র এবং নির্মম সত্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত দেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের অনেকেইতো বঙ্গবন্ধুর নিকটজন ছিলেন। খুশি হয়েছিলো কতো ‘আপনজন’। নানা সতর্কবাণী সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর এক প্রকার নিরাপত্তাহীনভাবে থাকার যুক্তি ও সারবত্তা নিয়ে প্রশ্নতো উঠবেই। সেসব বিস্তর ব্যাপার।
তা বর্তমানে ফিরে আসি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সিলেটে, হঠাৎ যা ঘটে গেলো, তার দায় গিয়ে কোথায় পড়লো? ‘ছাত্রলীগ’ হয়ে তা গিয়ে পতিত হলো ঐ শেখ হাসিনা-নেতৃত্বেরই ওপর। মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা প্রভৃতি শব্দ কন্টকিত হলো। খুশিতে বাগ বাগ হলো বেকায়দায় পরা যুদ্ধাপরাধী জোট। সর্বশেষ ঢেউয়ে শেষ পর্যন্ত বিব্রত, বিপর্যস্ত হলো ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ গড়ার সাধনা।
এই ঢেউ। সেই ঢেউ। অই ঢেউ। হঠাৎ ঢেউ সামাল দেবার রাজনৈতিক ব্যবস্থা জোরদার করা ছাড়া আর কোনোই পথ নেই। পথ থেকে দূর করতে হবে অনেক অনেক ‘আগাছা’। প্রতিদিন। ক্রমাগতভাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)