আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটায় তার নামে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা। একই সঙ্গে ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে সেখানে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিবৃতিতে বাংলাদেশের ১৬ জন চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক-শিক্ষক ও লেখক-সম্পাদক এবং ভারতের ৮ জন পরিচালক-সংগঠক এ দাবি জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে: ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটার একটি অংশ ভেঙে সেখানে সাইকেল গ্যারেজ করছিল রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আশির দশকে সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে কলেজকে দিয়েছিল জমিটি। তারা বলেছিলেন, ভবিষ্যতে বাকি ঘরগুলোও ভাঙা হবে, কলেজের প্রয়োজনে।
কিন্তু রাজশাহী ও ঢাকার চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠকদের প্রতিবাদ ও তৎপরতার মুখে ভাঙচুর ও নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতারা এ বিষয়ে তাদের প্রতিবাদ ও দাবি সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে জানিয়েছেন।
‘আমরা বাংলাদেশের ১৬ জন চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক-শিক্ষক-গবেষক এবং ভারতের ৮ জন চলচ্চিত্র পরিচালক-শিক্ষক-সংগঠক অন্যান্যদের মতো দাবি করছি, হুমকির মুখে থাকা ঋত্বিক ঘটকের পৈত্রিক ভিটায় ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র ও যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।’
এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা বলেন: ঋত্ত্বিক ঘটক শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেই এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু দেশভাগকে তিনি কখনোই মেনে নেননি, উন্মূল হয়ে যাবার যন্ত্রণায় তিনি ভুগেছেন সারাজীবন। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তিনি নির্মাণ করেছেন অনন্য সব চলচ্চিত্র- ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা ও ‘কোমল গান্ধার’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সেই অর্থে তিনি বাংলাদেশেরও চলচ্চিত্রকার।’
ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ এবং মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।
এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজকে ইজারা দেয়।
বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। রাজশাহীতে ক্রিয়াশীল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ, রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই বাড়িটিকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে তিন বছর আগেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের দাবি, হোমিওপ্যাথিক কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে অনতিবিলম্বে বাড়িটিতে ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হোক। ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে ক্রমশ একটি যাদুঘর সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হোক। দেশ–বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্ন মাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠুক। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
এই শিক্ষক-গবেষক ও পরিচালক-সংগঠকদের মতে, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িগুলো রক্ষা পেয়েছে সরকারের উদ্যোগের কারণে। বহু মানুষ আজ সেখানে যায় রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালভাবে অনুভব করার জন্য। অনেক দেশি-বিদেশি গবেষক লালন আখড়ায় পড়ে থাকেন।
একইভাবে ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের মতো যারা একসময় এদেশে জন্মেছেন বা যাদের বসতভিটা এখানে ছিল, তারা দেশভাগ বা অন্য কারণে চলে গেছেন; কিন্তু সেগুলোকে রক্ষা করা, সেগুলোকে যাদুঘরের মতো গড়ে তোলা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য কৃতি সন্তানদের বসতভিটাও রক্ষা ও পরিচর্যার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
বিবৃতিতে সই করা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক-শিক্ষক ও লেখক-সম্পাদক এবং ভারতীয় পরিচালক-সংগঠকদের মধ্যে রয়েছেন:
বাংলাদেশ থেকে
১।অনুপম হায়াৎ,লেখক-গবেষক
২।মাহমুদুল হোসেন,লেখক-অনুবাদক
৩। মঈনুদ্দীন খালেদ, শিক্ষক-লেখক
৪। জাকির হোসেন রাজু,শিক্ষক-গবেষক
৫। মীর শামছুল আলম বাবু,সংগ্রাহক-গবেষক
৬। বিধান রিবেরু,লেখক-বিশ্লেষক
৭। ফাতিমা আমিন, শিক্ষক-গবেষক
৮। আ-আল মামুন, লেখক-শিক্ষক-গবেষক
৯। শৈবাল চৌধুরী,লেখক-সংগঠক
১০। কাজী মামুন হায়দার,সম্পাদক-প্রকাশক
১১। হাবিবা রহমান, শিক্ষক-গবেষক
১২। গোপা বিশ্বাস সিজার, শিক্ষক-গবেষক
১৩। বেলায়াত হোসেন মামুন, লেখক-সংগঠক
১৪। তাজিন আহমেদ, শিক্ষক-গবেষক
১৫।এ কে এম আতিকুজ্জামান, প্রকাশক-সম্পাদক
১৬। ফাহমিদুল হক, লেখক-গবেষক-শিক্ষক
ভারত থেকে
১। প্রেমেন্দ্র মজুমদার, সর্বভারতীয় সংগঠক
২। শ্যামল কর্মকার, শিক্ষক-পরিচালক
৩। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, পরিচালক
৪। শান্তনু মুখার্জি, শব্দ প্রকৌশলী
৫। মনীষ কে দাস, পরিচালক
৬। অভিষেক ভট্টাচার্য্য, পরিচালক
৭। এম আর রাজন, পরিচালক
৮। সত্য রায় নাগপাল, চিত্রগ্রাহক