ওয়াসার পানির সার্বিক চিত্র দেখতে উৎসসহ মোট ৩৪টি পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করে আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ওয়াসার পানি পরীক্ষার জন্য গঠিত চার সদস্যের কমিটিকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পরীক্ষায় যত টাকা লাগবে, তা ওয়াসাকে দিতে বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমানের উপস্থাপন করা মতামতের পর মঙ্গলবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে সাবিতা রিজওয়ানা রহমান বলেন: সুপেয় পানি পাওয়া সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার সংযোগ ছিলো ২লাখ ৭২ হাজার ৮৪৪টি। বর্তমানে সেই সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ১৭৭টি।
‘‘যে পানিতে ময়লা বা ঘোলা দেখা যায় সেটাতো পরীক্ষারই দরকার নেই। সেটা তো রিজেক্টেড। আমাদের ওয়াসার পানি চারটি উৎস থেকে আসে, এগুলো হলো; ভূমিস্থ, ভূগর্ভস্থ এবং শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা।’’
এসময় আদালত বলেন: এই চারটি সোর্সে পানি এবং এই সোর্স থেকে আসা ১০টি জোনের পানি এবং এই জোনগুলো থেকে বিভিন্ন যাওয়া ১০টি র্যান্ডম এলাকার আর গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে দেওয়া ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার পানির স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
এই ৩৪টি জায়গার পানির প্রতিটি স্যাম্পল পরীক্ষায় পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানান অধ্যাপক সাবিতা।
এরপর আদালত ৩৪টি পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করে ২ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।
আদালতে স্থানীয় সরকারের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। আর ওয়াসার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম মাসুম।
এর আগে বাংলাদেশের পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি ও দরিদ্রতা নিয়ে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন দেয়।
বাংলাদেশ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অপরিচ্ছন্ন এবং অনিরাপদ উৎসের পানি পান করছে। পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত এবং ১৩ শতাংশে রয়েছে আর্সেনিক।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পাইপলাইনের পানির ৮২ শতাংশেই রয়েছে ই-কোলাই। ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে পাওয়া গেছে এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।’
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘নিম্নমানের পানি এবং পয়োনিষ্কাশন–ব্যবস্থা দেশের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এ দুটি বিষয় শিশুর পুষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতায় কম। নিরাপদ ও মানসম্মত পানি এবং পয়োনিষ্কাশন–ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হলে শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের পানি সরবরাহ, পয়োব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় কম। গত এক দশকে এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক কমেছে।’
বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত খবর যুক্ত করে গত বছরের ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ। সে রিটের শুনানি নিয়ে গত ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট ওয়াসার পানি পরীক্ষার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
এরপর স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মনিরুল আলম, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম বদরুজ্জামান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে সদস্য হিসেবে নেওয়া হয় কমিটিতে।
পরে এই কমিটির দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নমুনা সংগ্রহ করে তার নির্দিষ্ট পরীক্ষার পর বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করতে একটি তহবিলের পাশাপাশি ল্যাবরেটরিসহ ঢাকা ওয়াসার সামগ্রিক প্রচেষ্টা দরকার।’
পরবর্তীতে হাইকোর্টের আদেশে মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে বলে,
গত তিন মাসে গ্রাহকের অভিযোগের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ওয়াসার ১০টি জোনের ৫৯ এলাকায় ময়লা পানির প্রবণতা বেশি। ওই প্রতিবেদন আরও বলা হয় ওয়াসার ১০টি জোনের প্রত্যেক এলাকা থেকে ৩৫৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হবে। যাতে মোট নমুনার সংখ্যা দাঁড়াবে ১০৬৫টি। এই ১০৬৫ টি নমুনা করে তিনটি ল্যাবরেটরিতে রোগজীবাণু ও ভোৗত রাসায়নিক সংক্রান্ত পরীক্ষা করতে খরচ হবে ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা।
তবে আরো কম নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার খরচটা কমানো যায় কিনা সেজন্য এক্সপার্টের মতামত দরকার মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে ২১ মে আদালতে আসতে বলেন হাইকোর্ট।
সেই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান ২১ মে আদালতে তার মতামত উপস্থাপনের পর হাইকোর্ট ৩৪ টি পয়েন্টের পানি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন।