চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

উৎসবের অর্থনীতিতে অনেক পিছিয়ে বইমেলা

উৎসবের বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে বইমেলা। এমনকি পহেলা বৈশাখের আগে পোশাক বিক্রির ধারেকাছেও নেই মেলায় বিক্রি হওয়া বই থেকে আয়।

সমাজতাত্ত্বিক ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্যাশনের দিক থেকে মানুষ খুব দ্রুত আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও সে হারে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী নন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেটে সিনেমা-নাটকে তরুণরা যতটা আগ্রহী বইয়ের দিকে ততটা না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বইয়ের বাজারে। ভবিষ্যতে এ বাজার আরো ছোট হওয়ার আশঙ্কা তাদের।

এজন্য অন্য ব্যর্থতার পাশাপাশি মানসম্পন্ন লেখক ও লেখার অভাবকে দায়ী করেছেন তারা। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের এখনই উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শও তাদের।

বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, ২০১৭ সালে এক মাসের অমর একুশের বইমেলায় বই বিক্রি হয়েছে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার। বাংলাদেশ পুস্তুক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি অবশ্য বলছে, মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা হতে পারে। বছরজুড়ে কী পরিমাণ বই বিক্রি হয় তা সমিতি সংরক্ষণ করে না।

তবে বইয়ের তুলনায় বিক্রিতে কয়েক হাজার গুণ এগিয়ে রয়েছে উৎসবের পোশাক।

দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশিয় বাজারে পোশাক বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫শ কোটি টাকার। শুধু ঈদ-উল-ফিতরের আগে বিক্রি হয়েছে সারা বছরের মোট বিক্রির অর্ধেক অর্থাৎ ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এক হাজার ৬শ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে পহেলা বৈশাখে। আর ঈদ-উল-আযহা, দুর্গা পূজা, এবং পহেলা ফাল্গুনসহ বিভিন্ন উৎসবে এক হাজার ৬৫০ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে। এ তালিকায় অমর একুশেও আছে।

বাংলাদেশ পুস্তুক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি মনে করে, মানুষ মনে করে পোশাকে তাদের মর্যাদা ফুটে উঠে। কিন্তু বই পড়া ও কেনাকে তারা শুধু খরচই ভাবে।

সমিতির সহসভাপতি আলমগীর মল্লিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এখনকার মানুষ স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করে না। সবাই মনে করে দুই-একটা ইংরেজি বলতে পারলেই হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সনদপত্র পেলেই তারা সন্তুষ্ট। এছাড়া শিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল।

তিনি বলেন, অনেকে একটা লিপস্টিক কিনে ৫শ টাকা দিয়ে। যা নির্দিষ্ট সময়ে কেবল ব্যবহার করা যায়। অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে-এমন একটা বই ২শ টাকার বিনিময়ে কিনতে চায় না। মানুষ মনে করে পোশাকে তাদের মর্যাদা ফুটে উঠে। আর বই পড়লে জ্ঞান অর্জন হবে ঠিকই। কিন্তু তা জনসমাজে দেখানো যাবে না।

পোশাকের আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ উন্মুখ বলে মনে করেন সমিতির সাবেক সহসভাপতি রতন চন্দ্র পাল। তিনি বলেন, বিশেষ দিনগুলোতে আকর্ষণীয় ও দিবসের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক পরতে হবে- এমন প্রবণতা থেকে তরুণ-তরুণীরা পোশাকের দাম কম না বেশি তা নিয়ে ভাবে না।

‘এছাড়া বর্তমানে হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডুবে থাকে তারা।’

তিনি বলেন, বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা না গেলে ভবিষ্যতে বাজার আরো ছোট হয়ে আসবে। বই পড়ার সুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দিতে হবে। এতে ক্লাসে শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

বই পড়ার অনাগ্রহের কারণ হিসেবে কেউ কেউ রাষ্ট্র ও  লেখকদের দায়ী করছেন। তাদের মতে, লেখকরা সমাজমুখী লেখা কম লিখেন। আর রাষ্ট্র মানুষদের বইমুখী করতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রাষ্ট্র মানুষকে বইমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছে। বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা নিচ্ছে না। এছাড়া পাঠকদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে বর্তমান সমাজমুখী বই কম লিখেন লেখকরা। এজন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকরাও দায়ী।

বইয়ের হার্ড কপির পাশাপাশি বর্তমানে ইন্টারনেটে সফটকপিও পড়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ই-বুক পড়ে এমন পাঠকের সংখ্যা হাতে গোনা। আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বুক তৈরি করার জন্য যে ধরণের প্রস্তুতি দরকার তা বাংলাদেশের প্রকাশকদের নেই।

এ বিষয়ে বেসিসের সভাপতি ও আইটি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মেধাস্বত্ত সম্পর্কে এখনও বাংলাদেশ সচেতন নয়। এদেশে পাইরেসি বলতে কিছুই নেই। ই-বুক করে তা নেটে দিলে মূহূর্তেই মানুষ ডাউনলোড করে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে পাঠক নেটে বই না পড়েই ডাউনলোডের পথ বেছে নেয়।

তিনি বলেন, নেটে বইয়ের পাঠক বাড়াতে হলে কপিরাইটের বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। ‘২০০৯ সাল থেকে এই আইন বাস্তবায়নের কথা বলে আসছি। কিন্তু আজো তা হয়নি। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এখন মানুষ বইয়ের হার্ডকপি বহন করতে চায় না। নেটে পড়তে পছন্দ করে।’

তবে এই পাঠকদের ধরতে হলে প্রকাশক ও সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।