আমরা হুজুগে জাতি। কোনো একটা হুজুগে না মাতলে আমাদের চলে না। যখন যে বিষয়টি সামনে আসে তখন আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। এজন্য কোনো না কোনো একটা ইস্যু চাই। আমাদের দেশে বেশ কিছু দিন ধরেই হুজুগে মাতবার মতো তেমন কোনো ইস্যু বা উপকরণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মাতামাতি প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এর মধ্যে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম। বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদের খবর গোপন রেখে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় সেরাও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার কপাল পোড়ে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে ব্যাপক তোলপাড়!তবে আপাতত দুর্নীতি দমন কমিশন ও মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ উল্টোপথে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে আমাদের একটি নতুন ইস্যু উপহার দিয়েছে।
উল্টোপথে গাড়ি চালানো আমাদের দেশে নিয়মিত ঘটনা। যাদের ক্ষমতা বেশি, সাধারণত এই কাজটি তারাই বেশি করেন। ঢাকায় উল্টোপথের গাড়ি ঠেকাতে গেল সপ্তাহে আকস্মিকই বিশেষ অভিযান শুরু করে ট্রাফিক বিভাগ৷ উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এই অভিযানে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে সরকারি গাড়ি!
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আইন না মানার তালিকায় বেশিরভাগ সময়ই এগিয়ে থাকেন দায়িত্বশীলরাই৷ পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন, গণমাধ্যমসহ ব্যক্তিগত গাড়িও উল্টো পথে চলছে৷ আর এসব দেখে সাধারণ মানুষও সুযোগ পেলেই উল্টো পথে যানবাহন চালিয়ে দেয়৷
এই অনিয়মে বাধ সাধতেই এ দফায় প্রথম এগিয়ে আসে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধার সামনে হঠাৎ করেই এক অভিযান শুরু করেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ৷ তার উদ্যোগে পুলিশ সেখানে উল্টো পথে চলা গাড়ি ও মোটরসাইকেল আটকানো শুরু করে৷ মাত্র দুই ঘণ্টার অভিযানে আটক হয় সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী, সচিব, বিচারক, সরকারি দলের নেতা, পুলিশ ও সাংবাদিকদের গাড়ি৷ দুই ঘন্টায় ট্রাফিক পুলিশ ৫০টি যানবাহন ধরে মামলা ও জরিমানা করে৷ এর মধ্যে ৪০টিই সরকারি গাড়ি!
উল্টো পথে গাড়ি আটকের ঘটনায় বিশেষভাবে নজরে এসেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাফরুহা সুলতানা৷ তিনি একটি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব৷ প্রথমদিন তার গাড়ি আটক করে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ পরদিন আবার একই ঘটনা ঘটান তিনি৷ আবারও উল্টো পথ ধরেন৷ চালকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়৷
লক্ষণীয় হলো, এই অভিযানে কেবল গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ আড়ালে থেকে যাচ্ছেন মালিক, যিনিও কম দায়ী নন৷ কারণ, এমন ঘটনা অহরহই ঘটে যে, মালিকের প্ররোচনাতেই উল্টো পথে যেতে বাধ্য হন চালক৷ এ ব্যাপারে মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মোসলেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য হলো: ‘‘মোটরযান আইনের অধীনে এই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে৷ সেই আইন অনুযায়ী, চালকের বাইরে অন্য কাউকে শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়৷ ঘটনার সময় মালিক যদি চালকের আসনে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ তবে আইনে না থাকায় মালিক গাড়িতে কেবল বসে থাকলে তার বিরুদ্ধে আর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না৷’’
উল্টো পথে গাড়ি চালানোর কারণে একদিকে যেমন দুর্ঘটনা বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে যানজট। শত শত গাড়ি যখন যানজটে আটকে থাকে, নিশ্চল হয়ে যখন ভোগান্তি পোহান সবাই, তখন চোখের সামনে দিয়ে কিছু মানুষের এই উল্টোযাত্রা সাধারণ মানুষের প্রতি এক ধরনের পরিহাসও বটে৷ এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষ খুব একটা আইন মানতে চায় না। সে দেশে ‘ক্ষমতাবানদের’ এমন চর্চা যে মানুষকে আইন মানতে আরও নিরুৎসাহিত করে।
সাধারণত এ ধরনের অভিযান হলে মানুষ সাবধান হয়। তারপর অভিযান শেষ হলে আবার চলে উল্টোযাত্রা। অভিযান হলেই সাবধান হতে হবে, আইন মানতে হবে–এমনটি হতে পারে না৷ কারণ, এমন প্রবণতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতার লক্ষণ৷ এ প্রবণতা শুধু ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনেরই দৃষ্টান্ত নয়, সাধারণভাবে আইনের শাসন না থাকারও ফলাফল৷
আসলে আমাদের মধ্যে, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের মধ্যে সততা নেই। আমরা বুদ্ধিমানও নই, তবে আমরা অবশ্যই চালাক। আমরা চোরাপথ, উল্টোপথ খুব সহজেই আয়ত্ত করি। পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন করি। কিন্তু দায় চাপাই অন্যের উপর। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনো পথ গ্রহণ করতে, চামড়া বাঁচাতে, অপকর্মের দায় এড়াতে, অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে আমাদের জুড়ি নেই। এ ব্যাপারে আমরা ভীষণ দক্ষ। কীভাবে আরেকজনকে ফাঁসানো যায়, জব্দ করা যায়, এ কৌশল আমরা সহজেই আয়ত্ত করি। এজন্য আমাদের বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও দরকার হয় না। চতুর ও ধূর্ত হওয়ার জন্য আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ লাগে না, কোনো বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন হয় না। জন্মসূত্রেই এই গুণ অর্জন করি।
আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারা প্রত্যেকেই একেকজন ফেরেস্তা, কারো কোনো দোষ বা সীমাবদ্ধতা নেই, জীবনে কেউ কোনো অন্যায় বা অপকর্মের ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি, কারো মধ্যে কোনো রকম লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধ নেই, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা ছাড়া। যদিও আমরা জানি কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্বার্থপরতা-সংকীর্ণতা-হিংসা-প্রতিপক্ষের অনিষ্ট কামনা আর মিথ্যাচার ভিন্ন সেসব লোকের জীবনে অন্য কোনো ব্রত নেই। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে শর্টকাট, রং সাইড, ভুলপথ-চোরাপথের সন্ধানে এক শ্রেণির মানুষ মুখিয়ে থাকেন।
এ ব্যাপারে ক্ষমতাবানরা থাকেন সবেচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু তারা কখনও তাদের অপকর্মের কথা কবুল করেন না।নিজেদের ধোঁয়া তুলসি পাতা হিসেবে উপস্থাপন করা এবং সব অপকর্মের দায়ভার অন্যের উপর চাপানোটা আমাদের দেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ভিলেন আর নিজেদের মহানায়ক হিসেবে উপস্থাপনের এই ধারা চলছে তো চলছেই। আমাদের সমাজ বর্তমানে একদল চতুর ও ধূর্ত ব্যক্তির ভণ্ডামি আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে স্বার্থোদ্ধারের উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের একটা বড় ট্রাজেডি!
অর্থ-বিত্ত-সম্মান-প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভের আশ্চর্য জাদুর চেরাগ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এই চতুর লোকগুলো। তাদের কাছে দেশের চেয়ে, নিয়মের চেয়ে, আইনের চেয়ে নিজের স্বার্থ বড়। সবার উপরে স্বার্থ সত্য তাহার উপরে নাই।
যদিও এ জীবন নিয়ে আমাদের বড় বেশি খেদ বা অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না। সবাই দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেখানে যতটুকু পরচর্চা আর আঁতলামি করা দরকার অকৃপণভাবে তা করছি। সরকার নিজের মত করে পথ চলছে, কারও কোনো পরামর্শ বা সমালোচনাকে পাত্তা দিচ্ছে না, নিজেদের কোনো ব্যর্থতাকেও স্বীকার করছে না। বিরোধী দল যথারীতি সরকারের বিরুদ্ধে ‘কাছা-খোলা’ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সরকারকে বিপদে ফেলতে যা যা করা দরকার তার সবকিছুই করছে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ ও সুবিধাকে প্রধান্য দিয়ে পথ চলছে। আমাদের ভাগ্যের চাকা অদৃশ্য নিয়তির হাতেই ঘুরছে। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারকে সম্বল করে আমরা উল্টো পথের যাত্রী হয়ে বসে আছি।
একবার এক ভদ্রলোক তীর্থযাত্রায় বের হয়ে উল্টো পথে হাঁটছিলেন। পথে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে পথিক, এমন গেরুয়া বেশে তুমি কোথায় চলেছ?
পথিক জবাব দিলেন, দেখে বুঝছ না আমি তীর্থে চলেছি?
কিন্তু এদিকে তো কোনো তীর্থ নেই। আমার জানা মতে তুমি যেদিক থেকে এসেছ তীর্থ তো সে দিকেই।
এবার তীর্থযাত্রীর ভুল ভাঙলো। তিনি বললেন, ভাই দয়া করে আমাকে ঘুরিয়ে দাও।
আমরাও বর্তমানে ওই তীর্থযাত্রীর মত উল্টো পথে চলেছি। কিন্তু হায়, আমাদের ঘুরিয়ে দেবে কে? ট্রাফিক পুলিশ আর দুর্নীতি দমন কমিশনের ‘সৌখিন’ উদ্যোগ কী পারবে আমাদের ঘুরিয়ে দিতে? সোজা পথে হাঁটাতে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)