নব্বই দশকের নন্দিত শিশুসাহিত্যিক মাহবুব রেজা কলমের নিপুণ ও অভিজ্ঞ আচড়ে এঁকেছেন ১৯৭১ সালে পুরান ঢাকার রাজাকারদের চালচিত্র, মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ এবং শিশু-কিশোরদের সাহসী ভূমিকার কথা। পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রতিটা পথ, প্রতিটা বাড়ির হুবহু বর্ণনা, বড়দের বিশেষভাবে পিতৃতুল্য শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় ছোট শিশুকিশোরদের মানসিকভাবে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠার গল্প, আদর্শবান ও নীতিবিবর্জিত শিক্ষকদের পাশাপাশি উপস্থাপন, পরের সম্পত্তির প্রতি মুক্তিবিরোধী রাজাকারদের লোভ ও মুক্তিকামী মানুষের সাথে অনৈতিক ও হিংস্র আচরণ এবং কিশোর বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ- সবকিছুই মুখ্য হয়ে উঠেছে প্রাজ্ঞ এই শিশুসাহিত্যিক মাহবুব রেজার পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১ শীর্ষক কিশোর উপন্যাসে।
কিশোরদের মানসিকতা ও জীবন যেভাবে ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, ঠিক সেভাবেই উপন্যাসের অনুষঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে, সেভাবেই উন্মোচিত হয়েছে ঘটনাপ্রবাহ। হানাদার দোসর পাকবাহিনীর বিশ্বস্ত সহযোগী, দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের কার্যক্রম ও চেহারা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক মাহবুব রেজা পশুর হিংস্রতা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
মাহবুব রেজা পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১-এ শিরোনামের মধ্যেই পুরো উপন্যাসটি তুলে ধরেছেন, চরিত্রায়ন ও বিষয়বস্তু উপস্থাপনে ব্যবহার করেছেন উপমা, দেখিয়েছেন কিশোরদের বড় হয়ে ওঠা এবং তাদের জাগ্রত দেশপ্রেম।
২. পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১-এর কেন্দ্রে রয়েছে কাজল নামের একজন কিশোর। পরিবারে রয়েছে উকিল বাবা, গৃহিণী মা আর ছোটবোন রেখা। পারিবারিক আলোচনার মধ্য দিয়ে জানা যায়, তারা পুরনো আমলের ভাড়াবাড়িটি ছেড়ে অন্য কোথায় যেতে চায় কিন্তু বাড়ির মালিক আছালত মুন্সির মিষ্টি কথার কাছে বারবার প্রভাবিত হয় কাজলের বাবা রিয়াজউদ্দিন আহমদ উকিল।
পরবর্তীতে জানা যায়, আছালত মুন্সি এ বাড়ির আসল মালিক নয়। অভয়াচরণ বাবুর বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছিল সে। পরবর্তীতে জাল দলিল তৈরি করে থানা পুলিশ ম্যানেজ করে বাড়িটি দখল করে নেয়, অভয়াচরণ বসে পথে। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে সে রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি দখলের প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে। ওদিকে কাজলের স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক কবি খালেদ স্যার বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
প্রধান শিক্ষক খবির উদ্দিনের কথা শুনে বোঝা যায়, সেও একজন রাজাকার। কিন্তু তার কথার সমুচিত জবাব দিয়ে দেন কবি খালেদ স্যার। খালেদ স্যার ছাত্রদের বলেন, তোমরা তোমাদের জায়গা থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারো। তারপর ছাত্রদের মধ্য থেকে নির্মল একটি তথ্য জানায় যে, বসুবাজার লেনে রাজাকারদের মিটিং হয়। ঘটনা এভাবেই এগুতে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রধান শিক্ষক খবির উদ্দিন, আছালত মুন্সিসহ রাজাকারদের ভূমিকা ও চেহারা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে নাদের গুণ্ডা, গালকাটা মালেকসহ সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। এদের নামের সাথে গুণ্ডা শব্দটি লাগানো হলেও গ্রামের কারো কখনো ক্ষতি করেছে বলে কেউ অভিযোগ করতে পারে না। এরা যুদ্ধকালীন ঢাকার বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়া ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। পাক হানাদার বাহিনী যখন ঢাকা শহর তছনছ করে দিচ্ছিল, তখন এরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ভিরু ও বোকা প্রকৃতির উকিল রিয়াজ উদ্দিনও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে স্থানীয় বিভিন্ন যোদ্ধাবাহিনীর জন্য কাজ করে আসছিলেন।
পরিশেষে দেখা যায়, আছালত মুন্সির তোষামুদে রহমত কাজলদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা করে। কাজল আছালত মুন্সির বাসায় গিয়ে জানায়, হিন্দুর জমী দখলের দলিল প্রস্তুত করে রেখেছে তার বাবা। তাই, তাকে এখনই তার বাবা জরুরি ভিত্তিতে ডেকেছে। তারপর চেয়ারম্যান, আছালত মুন্সি, সংগ্রাম, সালেহীন আর রহমত কাজলদের বাসার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু চেয়ারম্যান লক্ষ্য করে রাস্তার আলো নেভানো। তারপরেও রহমত আশ^স্ত করলে তারা এগুতে থাকে। তখন পরিকল্পনামাফিক মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় তারা। একে একে সবাইকে খুন করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার একটি খণ্ডচিত্র দেখানো হয়েছে। এই রাজাকার বাহিনীর মুলোৎপাটনে সাহসী কাজলের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
৩. মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১-এর শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুলোর মাঝেই পুরো উপন্যাসের ঘটনা ও বিষয়বস্তুর ছাপ রেখেছেন মাহবুব রেজা। শুরুতেই ব্যবহার করেছেন “পুরান ঢাকার” শব্দগুচ্ছ। কথাশিল্পী রেজা পুরান ঢাকার অলিগলি হুবহু নিগুঢ় যত্নের সাথে তুলে ধরেছেন। “নারিন্দা, বসুবাজার, শরত গুপ্ত রোড, দয়াগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, মনির হোসেন লেন, দক্ষিণ মৈশুণ্ডি, রায়সাহেব বাজার, রথখোলা, টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম, গেন্ডারিয়া, দীননাথ সেন রোড, ধোলাই খাল, গুরুদয়াল লেন, মীর হাজিরবাগ, স্বামীবাগ, ওয়ারী, যোগীনগর, ঢালকা নগর, কলুটোলা, শিংটোলা”সহ অসংখ্য স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তবে পুরো উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বসুবাজার লেনের ২৪ নম্বর বাড়িটি।
পুরান ঢাকা সম্পর্কে ধারণা কতটা গভীর, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমেই বোঝা যাবে। উপন্যাসের শুরুতে কথক লিখেছেন, “নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে নাক বরাবর যে রাস্তাটা দয়াগঞ্জের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে হেঁটে হেঁটে অনেকটা পথ এসে হলুদ মসজিদ পার হয়ে শরতগুপ্ত রোডের ঠিক মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালে একটা রাস্তা ডান দিকে গোত্তা খেয়ে চলে গেছে বেগমগঞ্জের দিকে।” এভাবে পুরান ঢাকার রাস্তার হুবহু বর্ণনা এনেছেন পুরো উপন্যাসে।
বাংলা সাহিত্যে পুরান ঢাকাকে বিশদভাবে উপস্থাপন করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহিদুল জহির। এদের পরেই নাম চলে আসে কথাসাহিত্যিক মাহবুব রেজার। মীর মশাররফ হোসেন যেমন জমিদার বংশের উত্তরপুরুষ হয়ে জমিদারীর ভেতর-বাহির উন্মোচন করে দিয়েছেন জমীদার দর্পণ নাটকে, তেমনি পুরান ঢাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই কথাসাহিত্যিক এ অঞ্চলের নাড়িনক্ষত্রসহ সব তুলে ধরেছেন পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১-এ।
পুরান ঢাকার উপস্থাপন প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপন্যাসে এ অঞ্চলটি আরোপিত হয়েছে নাকি কথাকার নিজে ধারণ করেন। উল্লেখ্য, কিছু লেখকের লেখা পড়লে দেখা যায় তারা ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিশাল উপন্যাস কিংবা গল্প-কবিতা লিখেছে। অনুমান কিংবা শুধু পাঠনির্ভর লেখনীগুলোতে আরোপিত বিষয় বেশি চলে আসে। চরিত্র যেমন না তেমন করে উপস্থাপন করা হয়, স্থান যেমন না তেমনভাবে দেখানো হয়। এমন অনুমাননির্ভর আরেপিত লেখা মাহবুব রেজা লিখেননি, বরং তিনি পুরান ঢাকাকে ধারণ করেন। পুরান ঢাকায় যা দেখেছেন, যেভাবে দেখেছেন, সেগুলোই উল্লেখ করেছেন। যাপিত জীবনকে গাল্পিক অবলম্বনে তুলে ধরেছেন। এজন্য তার রচনা পাঠককে আকৃষ্ট করে, মোহিত করে।
পুরান ঢাকা প্রসঙ্গের পরেই এসে পড়ে কাজলের নাম। কাজল উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে ঘিরেই পুরো ঘটনা আবর্তীত হয়েছে। কাজল স্কুলে যেমন সাহসিকতা আর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে, স্বাধীনতার যুদ্ধে নিজের প্রাণ বাজি রেখে যেভাবে রাজাকার আছালত মুন্সিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে সোপার্দ করেছে, যেভাবে সালেহীনকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়েছে, যেভাবে বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়েছে, ছোটবোন রেখাকে যেভাবে ক্ষমা করে বড়ত্বের পরিচয় দিয়েছে, তা থেকে কাজলের ভূমিকা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
উপন্যাসের শিরোনামের শব্দগুলোতেই শুধু পুরান ঢাকা আর প্রধান চরিত্র কাজলের নাম দিয়েই থেমে গেলেন না কথাসাহিত্যিক বরং ঐতিহাসিক ১৯৭১ শব্দটিও জুড়ে দিলেন। শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে এই সালটি অতীব পরিচিত একটি শব্দ। দীর্ঘ নয়টি মাস পাকিস্তানের সাথে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নাম ধারণ করে স্বাধীন হয়। যুদ্ধের বিভীষিকা আর রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা মোকাবিলায় মুক্তিদের সাহসী ভূমিকার পাশাপাশি কাজলের মতো কিশোরদের ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন, তবে ঘটনার উপস্থাপনে বাহুল্য নেই, নেই অতিরঞ্জন।
সব মিলিয়ে শিরোনামে পুরো উপন্যাসটি উঠে এসেছে। শুধু শিরোনাম পড়েও অনায়াসে একজন পাঠক বলে দিতে পারেন- উপন্যাসটির ঘটনা কিংবা বিষয়বস্তু কী হতে পারে। তাই সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, উপন্যাসটির নামকরণ সার্থক হয়েছে।
৪. পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১ উপন্যাসটি ঘটনাবহুল হলেও রূপকের ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বসাহিত্যে পশুপাখিকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম বেশ পুরনো। পশুর উদাহরণের মাধ্যমে মূলত মানুষের পাশবিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়। উপন্যাসটিতে রাজাকার আছালত মুন্সিকে বর্ণনা করতে গিয়ে সাপ, ইতর, খচ্চর প্রভূতির মতো কয়েকটি উপমা ব্যবহার করেছেন।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার প্রধান শিক্ষক খবির উদ্দিনের বিরক্তিকর কাশির প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক ব্যাঙের বাচ্চার প্রসঙ্গ এনেছেন। যখন খালেদ স্যার “রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ” এর কথা বললেন, তখন খবির উদ্দিন এমনভাবে কাঁশতে লাগলেন যেন ‘এইমাত্র তার গলার ভেতর এক পাল ব্যাঙের বাচ্চা ঢুকে পড়েছে।”
শুধু তাই নয়, এই শিক্ষক বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে সামিল না হওয়ার যথার্থতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খোঁড়া অজুহাত ব্যবহার করে বলেছে, “সকাল থেকে আমার এমন ডায়রিয়া শুরু হয়েছিল”। সে আরো বলে, “দুপুরের পর থেকে তেরো বার শুধু ঘর আর বাথরুম করতে হয়েছে আমাকে।” খালেদ স্যার সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, “ও রকম অবস্থায় আপনাদের মতো মানুষদের এ রকম ডায়রিয়াই শুরু হয়ে যায়।”
এখানে ডায়রিয়া দিয়ে পেটের অসুস্থতা বোঝালেও রূপক অর্থে কথাসাহিত্যিক মানসিক অসুস্থতাকেই বুঝিয়েছেন। দেশের মুক্তিকামী আন্দোলনের সময় এরা মানসিক অসুস্থতায় ভোগে। ঘর আর বাথরুমকেও উপমা হিসেবে হাজির করা যায়। ঘর বলতে যদি দেশকে বোঝানো হয়, তাহলে বাথরুম বলতে পাকহানাদার বাহিনীর আশ্রয় কিংবা শোষক পাক সরকারের অধিনস্ততাকে বোঝানো যায়।
শারীরিক অসুস্থতায় বিশেষভাবে ডায়রিয়া হলে রোগী যেমন বাথরুম থেকে ঘর, আর ঘর থেকে বাথরুমে যেতে হয়। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকলেও মাথার মধ্যে বাথরুমের বিষয়টি লেপ্টে থাকে। পেটে টান পড়লেই দৌঁড়াতে হবে। এভাবে ঘরে বসে থেকেও যাদের চিন্তা-ভাবনায় বাথরুমের কথা থাকে, তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ, আর যাারা দেশের মাটিতে থাকে ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে থাকে শোষকদের কাছে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ।
আরেক শিক্ষক ইয়াহিয়া মিয়া যখন কটাক্ষ করে দেশপ্রেমিক কবি খালেদ স্যারকে বলেছিল, “আপনার ভাবচক্কর আর কবিতার ভাষা দেখলে মনে হয় আপনি বুঝি সাক্ষাৎ কবি বন্দে আলি মিয়ার জুনিয়র সংস্করণ”, তখন খালেদ স্যার সাহসিকতার সাথে জানিয়ে দিয়েছেন, “শুনে আমার খুব ভালো লেগেছে কিন্তু আপনি কি জানেন আপনাকে দেখতে অনেকটা ইতর, নরপশু ইয়াহিয়া খানের মতো লাগে?”
এখানে নামের সাথে চারিত্রিক মিলেরও ইঙ্গিত প্রদান করে কথাসাহিত্যিক এই দেশদ্রোহী কপট শিক্ষকের চরিত্র উন্মোচন করে দিলেন। স্বল্প পরিসরে এই চরিত্রের বিচরণ হলেও এর মাধ্যমে মুুক্তিযোদ্ধা খালেদ স্যারের সাহসিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সবুর চেয়ারম্যান যখন স্কুলে মিটিং করতে এসেছিলেন, “সবুর চেয়ারম্যান জোরে মাথা ঘোরাতেই জিন্নাহ টুপিটা মাথা থেকে পড়ে যায় মাটিতে।” এই মাটিতে টুপি পড়ে যাওয়াটা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জিন্নাহ শাসনের নড়বড়ে অবস্থা ও পতনেরই ইঙ্গিত দেয়। একই সাথে এসব চেয়ারম্যানদের কপটতার পরিচয়ও পাওয়া যায়।
আছালত মুন্সির দাঁতের বর্ণনা দিতে ভুলেননি ঔপন্যাসিক। “মানুষের দাঁত যে এত নোংরা হতে পারে সেটা আছালত মুন্সির দাঁত না দেখলে বিশ্বাস হবে না।” তার দাঁতের নোংরামী মানসিকতা, চারিত্রিক ও নৈতিক নোংরামীরই পরিচায়ক।
আছালত মুন্সির মেয়ে নাজমা মুক্তিযোদ্ধা গালকাটা মালেকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার খবর শোনার পর আছালত মুন্সির অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে: “আছালত মুন্সি সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে ফুঁসছে আর শোল মাছের মতো গজরাচ্ছে।” সাপ উপমাটি খুবই পরিচিত। বিষাক্ত কোনো কিছুর বর্ণনায় সাপের উপমাটি দেয়া হয়। আবার ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মমতে, শয়তান স্বর্গে সাপের বেশে আদম হাওয়া কিংবা অ্যাডাম ইভকে প্রতারণা করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। এই অভিশপ্ত সাপের মতই বিশ্বাসঘাতক এই রাজাকার। আর শোল মাছ রাক্ষুসে মাছ হিসেবে পরিচিত। এই রাক্ষুসে বৈশিষ্ট্যও রয়েছে আছালতের মাঝে।
এই ব্যক্তিকে নিয়ে কাজলেরা যখন আলাপ করছিল, তখন নির্মল বলে, “আছালত মুন্সি মানুষটা কিন্তু চূড়ান্ত ঘড়েল টাইপের।” এই ঘড়ের শব্দের ব্যাখ্যায় সে বলে, “ঘড়েল মানে ঘাগু। ঘাগু মানে চালাক, ধূর্ত- সোজা বাংলায় যাকে বলে শিয়াল।” অর্থাৎ শেয়ালের মতো চতুরতার মধ্য দিয়ে সমাজে বিচরণ করে আছালত মুন্সিরা। এভাবেই সার্থক উপমা ব্যবহার উপন্যাসটির গুরুত্বকে পাঠকের বোধ আর মননের জায়গাকে অনেক গুণে বর্ধিত করেছে লেখক।
৫.
পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১ উপন্যাসটি কিশোররা কেন পড়বে, কী উপকার হবে তাদের কিংবা উপকারের জন্যেই কি পড়বে, এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া যায় না। তবে উপন্যাসটি এবং এর বিষয়বস্তু-অনুষঙ্গ কিশোরদের উপযোগী কি না, তা আলোচনা করা যেতে পারে।
কাজলদের ক্লাসে খালেদ স্যার বলেন, “তোমরা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ।” তিনি আরো বলেন, “তোমাদের এসব জানা জরুরি।” একজন শিক্ষক যখন তার কিশোর শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব সহকারে কিছু বলতে চান, শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই নিজেদের বুঝতে শুরু করে। কথাসাহিত্যিক রেজা ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে লিখেছেন, “খালেদ স্যারের কথাই কাজলদের ক্লাসের সবাই নিজেদের বেশ জরুরি ভাবতে শুরু করল।” এভাবেই কিশোররা ধীরে ধীরে কিভাবে বড় হয়ে ওঠে, তার গল্প আমাদের শোনাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধে সকলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে খালেদ স্যার ছাত্রদের বললেন, “তোমরা তোমাদের জায়গা থেকে যে কেউ যুদ্ধে না গিয়েও যুদ্ধে অবদান রাখতে পারো।” অর্থাৎ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান থেকে অবদান রাখার সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষনের একটি লাইন প্রাসঙ্গিক।
তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।” অর্থাৎ সবাইকে অস্ত্র নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যুদ্ধে কিংবা অস্ত্র নিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে, বিষয়টি কিন্তু তেমন না। যার পেশিতে শক্তি আছে, তারুণ্য আছে, মনোবল আছে, সে সরাসরি অস্ত্র নিয়ে অস্ত্রধারী শত্রুর মোকাবেলা করবে। যার কণ্ঠে শক্তি আছে, সে গান গেয়ে কবিতা আবৃত্তি করে ভাষণ দিয়ে কণ্ঠধারী শত্রুদের মোকাবেলা করবে। যার কলমে জোর আছে লেখায় শক্তি আছে, সে লেখনী দিয়ে লেখক শত্রুদের মোকাবেলা করবে। তাহলেই শত্রুপক্ষকে সবদিক দিয়ে মোকাবেলা করে কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন সম্ভব। ঠিক সে বিষয়টিই মাহবুব রেজা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছাত্ররা কেউ তথ্য দিয়ে, কেউ শত্রুর অবস্থানের কথা জানিয়ে সাহায্য করেছে। কাজল নিজেও মুক্তিবাহিনীর রহমতের কথানুযায়ী আছালত মুন্সিকে হিন্দুর বাড়ি দখলের দলিলের লোভ দেখিয়ে তার বাবার কাছে নিয়ে আসার কথা বলে। পথেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবুর চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য রাজাকারদের হত্যা করা হয়।
উপন্যাসটি কিশোরদের উপযোগি হলেও জাতি ও দেশের অর্ধাংশ নারীদের ভূমিকাকে উপক্ষো করা হয়নি। ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নত জাতি গঠনে সবার সমান অংশগ্রহণ আবশ্যক। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদের হেয় করার হীন প্রচলন রয়েই গেছে। শিশুকিশোররা সবাইকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার শিক্ষাটা শৈশব থেকেই পায়, উপন্যাসে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।
উকিল রিয়াজউদ্দিন অর্থাৎ কাজলের বাবা পেশায় উকিল হলেও সে তার স্ত্রীর কাছে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিতে পরাজিত। কাজলের পানু খালাকে তার বাবা বলেছেন, “তোমার আপা হলো আমার কাছে প্রধান বিচারপতি।” তিনি আরো বলেছেন, “তোমার আপার বুদ্ধি-বিবেচনা আর তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত খুব ভালো।” আবার বাসা পরিবর্তনের কথা রিয়াজ সাহেব আছালত মুন্সির কাছে জোরালোভাবে বলে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে বারবার পরাস্ত হয় কিন্তু সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার সাথে কাজলের মা ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
আছালত মুন্সির মতো চারিত্রিক স্খলনের মানুষের কাছে নারীরা যে নিরাপদ না, তার উদাহরণও দেয়া হয়েছে। স্ত্রীকে পেটানোর বদঅভ্যাস আছে রাজাকার আছালত মুন্সির। মেয়ে নাজমা গালকাটা মালেকের সাথে পালিয়ে গেছে। এটার জন্য যদি অভিভাবকদের দোষ থেকেই থাকে, তবে পিতা হিসেবে আছালত মুন্সিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু কিছু দূর্বল মানুষ তাদের সাহসিকতার প্রকাশ ঘটায় স্ত্রীর নিকট। তাদের অত্যাচার করে। এ দৃশ্যটি পড়া যাক কথাসাহিত্যিক রেজার ভাষায়।
তিনি লিখেছেন, “…আছালত মুন্সি কুলসুম বেগমকে বেদমভাবে মারতে লাগল। কিল, ঘুষি, লাথি, থাপ্পড় কোনটাই বাদ থাকছে না। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই। আছালত মুন্সির ছোট বউ মাজেদা বেগম অবস্থা বেগতিক দেখে এগিয়ে এসে কুলসুমকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে এলে আছালত মুন্সি তিরিক্ষি মেজাজে তাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, ভালো চাস তো ভালোয় ভালোয় এইখান থিকা সইরা যা, নাইলে কিন্তু তোর অবস্থা কুলসুমের থিকাও খারাপ হইবে।” এভাবে বেদম প্রহারের সময় সে বলেছে, “যদি আমি ঘূণাক্ষরেও টের পাইতাম নাজমায় ওই গালকাটা মালেইক্কার লগে ভাগনের পাঁয়তারা করতাছে তাইলে আমি ঘরটারে জাহান্নাম বানায়া ফালাইতাম।” এইসব অত্যাচারী মানুষের কাছে যখন নিজের পরিবারই নিরাপদ না, তারা দেশকে সুরক্ষা করবে কিভাবে?
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। নারীদের অত্যাচারিত রূপ দেখিয়েই চুপ হয়ে যাননি মাহবুব রেজা। বরং নারীদের প্রতিবাদী স্পৃহাও তিনি দেখিয়েছেন। এই নিন্দিত রাজাকারের মেয়ে নাজমা বাবার প্রতি রুষ্ট হয়ে বাবার অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ মুক্তিযোদ্ধা মালেকের সাথে পালিয়ে যায়। এই পালিয়ে যাওয়াটা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রথমত, সব বাঁধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়। দ্বিতীয়ত রাজাকার পিতার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন এবং মুক্তিযোদ্ধা মালেকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের প্রয়াস দেখা যায়। এছাড়াও পালিয়ে যাওয়ার সময় সে চিরকুট রেখে যায় যাতে লেখা ছিল “আমার পথ আমি দেখছি। বাপেরে কইও হে জানি মালেকের লগে পায়ে পইড়া আগ বাড়ায়া ঝগড়া লাগাতে না আহে।” এই চিরকুটের দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করতে কথক বলেছেন, “নাজমার চিরকুটের মধ্যে এক ধরণের প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে বোঝা যায়।” অর্থাৎ প্রতিবাদী নারীকণ্ঠও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। এই প্রতিবাদ অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এই প্রতিবাদ বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে, পাশবিকতার বিরুদ্ধে।
নারীদের প্রতিবাদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের কথাও উল্লেখ করেঠেন। কথক লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠে নেমে গেছে। রণাঙ্গনের ক্যাম্পে ক্যাম্পে মেয়েরা কাজ করছে।” আমি মনে করি, নারীদের অত্যাচারিত রূপ, প্রতিবাদী রূপ এবং দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠক শিশুকিশোরদের মন ও মানসিকতায় পরিবর্তনধর্মী মানোভাব সৃষ্টি হবে যা খুবই ইতিবাচক।
পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১-এর কেন্দ্রীয় প্রতিনায়কের চরিত্রে রাজাকার আছালত মুন্সিকে স্থান দেয়া হয়েছে। তার নামের সাথে মুন্সি লাগানো হয়েছে কিন্তু সে ধর্মের তেমন ধার ধারে না। পরের সম্পদ দখল করার চিন্তা তার মাথায় সবসময় ঘোরে। দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই তার ভেতর। আবার একই সাথে কপট ও ভণ্ডের চূড়ান্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার চরিত্রের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের কপটতাও তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পোশাক ও বেশভুশায় তারা মুসলমান ছিলো বটে, কিন্তু এই লেবাসের আড়ালে তারা পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর চালিয়েছে অত্যাচার, অনাচার, লুট, ধর্ষণ, অর্থনৈতীক আগ্রাসসের স্ট্রিমরোলার। ঠিক একইভাবে, আছালতের নামের সাথে মুন্সী জুড়ে দেয়ার কারণ হলো, চেহারা ও বেশভুশায় সে মুসলমান কিন্তু ধার্মিক হয়। লোক দেখানো সামান্য ধার্মিকতা দেখায় বটে, কিন্তু জমি ও বাড়ি দখল, শত্রুবাহিনীকে সাহায্য, মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা এবং নারীদের ওপর অত্যাচারের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে পাকিস্তানকেই দেখানো হয়েছে।
উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো, প্রতিটি চরিত্র পরম মমতা আর যত্নে উপস্থাপন করেছেন কথাশিল্পী মাহবুব রেজা। যে চরিত্রটি একেবারে গৌণ, তাকেও পূর্ণতা দান করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে উপন্যাসটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের রূঢ় বাস্তবতার কথা ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে, উপস্থাপন করা হয়েছে রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা ও কপটতা। এড়িয়ে যাওয়া হয়নি শিশুকিশোর ও নারীদের অবদান।
৬.
এডওয়ার্ড সাঈদের একটি মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেই শেষ করব। তিনি ওরিয়েন্টালিজম বইতে লিখেছেন, জ্ঞান নিরপেক্ষ নয়। মানুষ তার নিজস্ব অবস্থান থেকে সবকিছু ব্যাখ্যা করে। পুরান ঢাকার কাজল ১৯৭১ উপন্যাসে গালকাটা মালেক ও গুণ্ডা নাদেরের প্রসঙ্গ এসেছে। রাজাকার আছালত মুন্সির নিকট এরা ত্রাস, এরা গুণ্ডা। কিন্তু যদি অবস্থানটা পাল্টে দেয়া হয়, অর্থাৎ মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এই দু’জন ব্যক্তি মহান মুক্তিযোদ্ধা। যখন পাকবাহিনীর সদস্যরা পুরো ঢাকা শহরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল, তখন এই গুণ্ডা নাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
কথাশিল্পী লিখেছেন, “শ্রেণি শিক্ষকরা যেভাবে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লাস নেন সেই ভঙ্গিতে নির্মল নাদের গুণ্ডা সম্পর্কে বলা শুরু করল, আপনে কি মালিটোলার নাদের গুণ্ডার কথা কইতাছেন যে কিনা ২৫ মর্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালির ওপর কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনার পর বংশালের দিকে এগিয়ে আসছিল পাকিস্তানি আর্মির এক কনভয়। ওদের সঙ্গে ছিল অস্ত্রশস্ত্র হাজার রাউন্ড গুলি, কামান আর মর্টার। ওরা বংশাল দিয়ে মালিটোলা হয়ে পুরান ঢাকায় ঢুকতে পারলে বিশেষ করে হিন্দু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলত। তখন এই নাদের গুণ্ডা করল কী, একা বুকে সাহস রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় বংশাল ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের মতো করে তৈরি হয়ে একটি দেশি বন্দুক নিয়ে ছাদ টপকে টপকে ঈসা ব্রাদার্সের ছাদে গিয়ে পজিশন নেয়। ঈসা ব্রাদার্সের ছাদ থেকে বংশালের মেইন রোড কাছাকাছি। এতটুকু বলে একটু থামে নির্মল যেন জিরিয়ে নেয় সে, নাদের গুণ্ডার রেঞ্জের মধ্যে যখন পাকিস্তানি আর্মির কনভয় এসে যায়, তখন নাদের গুণ্ডা সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করা শুরু করে। নাদেরের আচমকা গুলিতে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। নাদের গুণ্ডার এই সাহসী আক্রমনে পাকিস্তানি আর্মি ভয়ে স্তব্ধ হয়ে ফিরে যায়।”
উল্লেখ্য, নাদের চরিত্রটি ইতিহাস থেকে হুবহু নেয়া, ২৫ শে মার্চ রাতে তার ভূমিকাটি বাস্তব এবং সত্য। কথাশিল্পী ইতিহাসকে উপন্যাসের মোড়কে শিশু-কিশোরদের জন্য বোধগম্য করে উপস্থাপন করলেন, অথচ ইতিহাসের বাহুল্য নেই, আছে ইতিহাসের ঘটনা।
আবার গালকাটা মালেকের পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে: “গালকাটা মালেকের বাপ মুক্তিযোদ্ধাগো কমান্ডার, আর মালেক নিজেও তো নামকরা গুণ্ডা মাজেদা বেগমের কথা শেষ হওয়ার আগেই আছালত মুন্সি জানোয়ারের মতো চিৎকার করে উঠল, গুণ্ডা আছিল অহন মালেইক্কা হইছে মুক্তিযোদ্ধা।” এই মালেক সম্পর্কে রহমত বলে, “মালেক ভাই তো অহন ক্র্যাক পেলাটুনে নাম লেখাইছে।”
এভাবেই এই দুই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। পরে আছালত মুন্সির মত ধূর্ত রাজাকারদের মালেক দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়। এই সাহসী সন্তানেরা রাজাকারদের দৃষ্টিতে গুণ্ডা আর মুক্তিকামী মানুষের দৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধা। কথাশিল্পী এ বিষয়টিও দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন।
ঔপন্যাসিক মাহবুব রেজা এভাবেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিশু-কিশোরদের উপযোগী ভাষা ও অনুষঙ্গ ব্যবহার করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ফুটিয়ে তুলেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কিশোরদের অবদান। উপন্যাসটিতে যুদ্ধকালীন পুরান ঢাকা এবং পুরান ঢাকার কাজলেরা তৎকালীন সারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।