চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

উপকূলের দুঃখ পানি?

“ Water, water, every where,
And all the boards did shrink;
Water, water, every where,
Nor any drop to drink.”

1797–98 সালে ‘Samuel Taylor Coleridge’ এর রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘ The Rime of the Ancient Mariner ‘ কবিতায় জাহাজের মেরিনার সমুদ্রের পবিত্রতার প্রতীক ‘ অ্যালব্যাট্রস’ পাখিকে হত্যা করার অভিশাপের দরুন সমুদ্রের বাতাস থেমে যাওয়ায় জাহাজটি সমুদ্রের বরফাচ্ছন্ন পানিতে আটকে পড়ে। ক্রমাগত খাবারের এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেক নাবিক জাহাজে মৃত্যুবরণ করে। চারপাশে প্রচুর পানি। কিন্তু তা পানের অনুপযোগী। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলের চিত্র ঐ কবিতার জাহাজের মত। চারিদিকে এত পানি। কিন্তু পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি এবং বিশুদ্ধ পানির প্রচুর অভাব। ‘আলবাট্রস’ পাখিকে হত্যার মত কোনো অভিশাপ উপকূলের মানুষের জন্য আছে কিনা তা জানা নেই। তবে উপকূলের মানুষের এই দুর্দশার জন্য অনেকাংশে দায়ী “জলবায়ু পরিবর্তন “। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরুপ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৫৩ লাখ মানুষ সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে৷ প্রতি বছর বাংলাদেশের উপকূলের একটা বিরাট অংশ পানিতে প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের মানুষের এই অঞ্চলসমূহে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মত বর্তমানে জোয়ারের পানির অধিক প্রবাহ জনজীবনকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত।

২০১৯ সালের ‘প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামের জার্নালে এক জরিপের ফল অনুযায়ী , ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়তে পারে ৬২ সেন্টিমিটার থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। বিজ্ঞানীদের মতে, এর ফলে ৮০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার পরিমাণ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে –যার মধ্যে থাকবে বাংলাদেশের এক বড় অংশ। বাংলাদেশের অনেক এলাকা তখন লোকজনের বসবাস খুবই দুরূহ হয়ে পড়বে। বর্তমানে সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার চিত্র অবলোকন করলে এই জরীপের বাস্তব চিত্র উপলব্ধি করা যায়।

পানির লবণাক্ততা উপকূলের মানুষের জন্য একটা বিরাট অভিশাপ। সাতক্ষীরার আশাশুনি অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির জন্য বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন উৎসের উপর নির্ভর করতে হয়। বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পানি বিভিন্ন বাড়িতে ট্যাংকে রিজার্ভ করে রাখা হয়, যা প্রায় ৩-৪ মাস ব্যাবহার করা যায়। উপকূলের মানুষের খাবার পানির জন্য বিভিন্ন পুকুরে বর্ষার পানি সংগ্রহে রাখা হয়। সারা বছর এই পানিকে ব্যাবহার করা হয় খাওয়ার জন্য। কখনো পুকুর ফিল্টার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্টই (আর ও প্ল্যান্ট) হচ্ছে মানুষের খাবার পানির উৎস হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। লবণাক্ততার কারণে পুকুর ফিল্টার উৎসটি প্রায় বিলুপ্তের পথে। এমনকি, গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রাকৃতিক উৎস বেশির ভাগ অচল থাকে। ফলে, মানুষকে বাধ্য হতে হয়, এই সময় পানি কিনে খেতে।

স্থানীয় সুত্র মতে, আশাশুনির প্রতাপনগর, খাজরা, শ্রীউলা ,অনুলিয়া, শোভনালি, কাদাকাটি, বড়দল, দরগাহপুর এলাকার অধিকাংশ লোকের পানি সংগ্রহ করতে হয় প্রায় ০৫-০৬ কিলোমিটার দূর থেকে।এই উপজেলার মোট ১১টি ইউনিয়নের মানুষের জন্য মাত্র ৭০টির মতো সচল আর ও প্ল্যান্ট রয়েছে। এই প্লান্টের স্বল্পতার কারণে অনেক মানুষকে প্রায় ০৪-০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় খাবার পানি সংগ্রহের জন্য। অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি সংগ্রহের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপিত হয়েছে। সেই গভীর নলকূপের পানির উৎস বর্ষাকালে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া, গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এই সমস্ত নলকূপ থেকেও পানি সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পানি সংগ্রহের জন্য থাকা পুকুরগুলোও শুকিয়ে যায় বা পানির স্তর এত নিচে অবস্থান করে যে পানি সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা হ্রাসও এই অবস্থার সৃষ্টির জন্য অনেকটা দায়ী।

আশাশুনি অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস মৎস্যচাষ। এই এলাকায় খাল বিল, হাওড়, পুকুর, সর্বত্র লোনা পানি তুলে অপরিকল্পিকতভাবে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে।। এতে সমগ্র এলাকায় পানি, মাটি, এবং পরিবেশ হয়ে পড়ছে লবণাক্ততাময় এবং দূষিত। সমুদ্রের মত যেদিকে তাকানো হয়, চারিদিকে শুধু পানি এবং পানি, কিন্তু লবণাক্ততার কারণে তা খাবার বা অন্য দৈনন্দিন কাজে ব্যাবহার অনুপযোগী। এছাড়াও, মাত্রারিক্ত আর্সেনিক, আয়রণ এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে পানিতে। মানুষ বাধ্য হয়ে সেই পানি গ্রহণ করার ফলে বিভিন্ন ধরনের পানি বাহিত রোগ যেমন- ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আনিরাপদ পানি ব্যাবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, ঘা –পাঁচড়া , যৃকত রোগের মত মানুষরা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে, নারী ও শিশুরা রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।

উপকূলবর্তী অঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। বর্ষার মৌসুমে আয়লা, সিডরের মত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জনজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। অনেক মানুষ প্রাণ হারায়, জীবনহারায় অনেক গবাদী পশু-পাখি, বাঁধ ভেঙ্গে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে ধ্বংস করে ফেলে ঘরবাড়ি এবং আয়ের উৎস। মানুষকে জীবনবাঁচার তাগিদে ঘর- বাড়ি ছেঁড়ে আশ্রয় নিতে হয় আশ্রয়ন কেন্দ্রে , রাস্তার পাশে বা অন্য কোন উঁচু জায়গায়। অনেক মানুষ চিরতরে বাধ্য হয় বসতবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। রাস্তাঘাটের ক্ষতির কারণে শহরের সাথে মানুষের যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই দুর্যোগের কারণে পানির উৎস নষ্ট হওয়ার ফলে মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এই ধরনের চিত্র সচরাচর আশাশুনি উপজেলায় বর্ষা মৌসুমে দেখা গেলেও শুকনো মৌসুমে বিগত দিনে মানুষেরা এই দুর্ভোগ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতো। কিন্তু ২০২০ সালের মে মাস থেকে উপজেলার শ্রীউলা, প্রতাপনগর এবং সদর ইউনিয়নের বিরাট অংশ এখনও পর্যন্ত পানিবন্দী। জোয়ারের পানির বৃদ্ধির সাথে সাথে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।

প্রথম আলোর ৩০ মার্চ ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, “ শুকনা মৌসুমেও বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়েছে সাতক্ষীরার আশাশুনির অন্তত চারটি গ্রাম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে আশাশুনি সদরের দয়ারঘাট এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রিং বাঁধ চার স্থানে ভেঙে যায়। এতে শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই শতাধিক চিংড়ির ঘের প্লাবিত হয়েছে।“ পাশাপাশি, প্রতাপনগর, কল্যাণপুর, মাদারবাড়িয়া, বন্যতলা, কুড়িকাউনিয়া গ্রাম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বিরাজ করছে। অস্বাভাবিক পানির প্রভাব এখন উপকূলের মানুষের জন্য বিরাট অভিশাপ। এর ফলে মানুষ এখন সুপেয় পানি, খাদ্য সংকট, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ ও বসবাসের সমস্যার রয়েছে।

পানির অপর নাম ‘জীবন’ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশাপের কারণে সারা বছর ব্যাপী পানির সংকট এবং পানির অধিক প্রবাহের ফলে বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশের ফলে “ পানিই” এখন হয়ে উঠেছে উপকূলের দুঃখ। সেই কবিতার মত, চারিদিকে পানি কিন্তু খাবার ও ব্যবহারের পানির বড়ই অভাব”।

সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে এই সংকট ভবিষ্যতে আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। বাস্তব হতে পারে, ২০১৯ সালের ‘প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামের জার্নালের জরিপের ফল।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)