বড় কৃষক যখন মাছের ঘেরে পানি তোলে, ছোট কৃষকের ফসলের ক্ষেত তখন পানিতে ভাসে। মাছ চাষের প্রয়োজনে বড় কৃষক যখন লবণ পানি তোলে, ছোট কৃষকের তখন প্রয়োজন মিঠা পানি। বড় কৃষক সংখ্যায় কম; তবে দাপট বেশি; এরা ‘নামের কৃষক’। ছোট কৃষক সংখ্যায় বেশি; তবে দাপট কম; কিন্তু এরাই ‘প্রকৃত কৃষক’। বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট, খাল খনন- এসব নামেমাত্র ছোট কৃষকদের জন্য। প্রকৃতপক্ষে এগুলোর সুবিধা ভোগ করেন বড় কৃষকেরাই। ছোট কৃষক চাইলেই স্লুইসগেটের কপাট খুলবে না; চাইতে হবে বড় কৃষককে। কেমন আছেন উপকূলের ছোট কৃষকেরা? এদের কথা একটু ভাবুন!
ছোট কৃষক, বড় কৃষক বলে কথা নয়; সমাজের সব পর্যায়েই ছোট-বড় দ্বন্দ্ব তীব্র। উপকূলের পথ ধরে হেঁটে ছোট-বড় কৃষকের এই বিরোধও তীব্রভাবেই ধরা পড়ে। কৃষি কাজের সুবিধার্থে উপকূলীয় জনপদে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় বেড়িবাঁধ। পানি নিস্কাশনের সুবিধার্থে দেওয়া হয় স্লুইসগেট। চাষাবাদ ছাড়াও বেড়িবাঁধ ও স্লুইসগেটের অন্যতম লক্ষ্য মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেটা কতটা পূরণ হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অসংখ্য কৃষক আমাকে বহুবার জানিয়েছেন, বেড়িবাঁধ আর স্লুইসগেট তাদের চাষাবাদে সুবিধার বদলে অসুবিধাই হচ্ছে। অনেকে আবার বলে থাকেন, বেড়িবাঁধ হওয়ার আগেই আমরা ভালোভাবে চাষাবাদ করতে পারতাম; এখন বিপদে।
সর্বশেষ চিত্র পাই, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজে। দ্বীপের প্রানকেন্দ্র সুলিজ বাজার থেকে চরলক্ষ্মী, চর রুস্তুম, নলুয়া, খলিফার চর, বাইলাবুনিয়া, দাঁড়ভাঙা- যেখানেই যাই, কৃষকদের একই অভিযোগ। বড় কৃষকদের ‘সুবিধামত’ পানি ওঠা নামানোর কারণে তারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। অনেক জমি পতিত থাকছে; অনেকে কৃষি থেকে আয় রোজগারের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় ফিরেছেন; কেউ কেউ ছোট ব্যবসা নিয়ে বসেছেন। ‘বড় কৃষক’ কারা? স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে যে জবাব আসে, তাতে বোঝা যায়, এরা আসলে কৃষক নন। নিজের জমি, কিংবা বিভিন্নভাবে জমি দখল করে এরা কৃষি জমিতে মাছের চাষ করে।
নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করা প্রান্তিকের মানুষের কাছে খুবই কঠিন। হাজারো সমস্যায় ডুবে থেকে এরা সমস্যার কথাই যেন ভুলে গেছে। এলাকার প্রধান সমস্যা কী? এমন প্রশ্ন করলে সকলে আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর আলাপে আলাপে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলে সব সমস্যার খোলামেলা আলাপ হয়। সমস্যার তালিকা তখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সুলিজ বাজার থেকে বউ বাজার হয়ে দক্ষিণের বেড়িবাঁধ ধরে যাই বাইলাবুনিয়া। এখানে আলাপ কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে। এদের সঙ্গে আলাপেও প্রথমে কোন সমস্যা বের হয়নি। অবশেষে তাদের কাছে প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে কৃষির এই সমস্যাটি। যার সঙ্গে জড়িত বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট, বড় কৃষক ইত্যাদি।
বাইলাবুনিয়ার বর্গাচাষী ফরিদ হোসেন, বয়স ৪৫ বছর। কৃষি কাজেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। বললেন, ‘ঘেরের মালিকেরা জমিতে লবণ পানি উঠিয়ে রাখে। আগে যে জমিতে ১০০ মণ ধান পাওয়া যেত, সে জমিতে এখন ৫০ মণ ধানও পাওয়া যায়না। এখন কৃষি থেকে কিছু পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় কাজ খুঁজছি।’ একই এলাকার আরেকজন কৃষক আলমগীর হোসেন, বয়স ৩০ বছর। বললেন, ‘ফসল পাই না। সব এখন গণঘেরের দখলে। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। বাড়ির চারিপাশে ঘেরের পানি। বাড়ি থেকে বের হতেও সমস্যা।’ বাইলাবুনিয়ার কৃষকেরা জানান, ৫নং ওয়ার্ডের এই বিলে প্রায় ৫০০ একর জমি রয়েছে। এরমধ্যে ১৮ জন সমন্বয়ে একটি গণঘেরের আওতায় আছে প্রায় ৩০০ একর। আছে আরও দুটি ঘের। বাকি জমি ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে থাকলেও এতে তারা চাষাবাদ করতে পারছেন না। অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল জমি আবাদ; এখন সে সুযোগ আর থাকছে না।
বাইলাবুনিয়া বাজারে সবুজ মিয়ার টেইলারিং দোকানে বসে অনেকের সঙ্গেই আলাপ। ভর দুপুরে প্রায় জনশূন্য বাজার। টেইলারিং কর্মীদের অলস সময় কাটছিল। এরই মধ্যে সাংবাদিক আর ক্যামেরা দেখে ভিড় জমে অনেকের। ভিড় ঠেলে অনেকে উঁকি দেন সবুজ মিয়ার দোকানে। কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলেন; কেউ আবার চলে যান। আমার কাজ শেষ। আমি উঠি। কিন্তু এখানকার মানুষেরা বাস্তবে আমাকে কিছু দেখাতে চান। বেড়িবাঁধের পাশে গিয়ে কয়েকজন তর্জনী উঁচিয়ে দেখান মাঠের চিত্র। তারা বলেন, ‘আমাদের বাঁচান। আমরা কী খেয়ে বাঁচবো। কৃষি তো আমাদের প্রধান পেশা। এটা না করতে পারলে কী করবো?’ মাঝেরচরের কৃষক আল-মামুন খান বলেন, ‘আগে চাষাবাদ করতাম। এখন চাষাবাদ কমে গেছে। মাটি লবণ; পানি লবণ। তরমুজ, মরিচ হয় না। ঘেরে পানি ওঠানামা করানোতে কৃষকেরা সমস্যায় পড়েন। কৃষি আবাদ ছেড়ে জীবিকার জন্য এখন মোটরবাইক চালাচ্ছি।’
চরমোন্তাজের যেখানেই আলাপ করি, কৃষকদের একই কথা। কৃষির সমস্যার কথা বলতে গিয়ে দাঁড়ভাঙার এক কৃষক বলছিলেন, ‘স্লুইসগেটের চাবি তো বড় মিয়াদের হাতে। আমাদের কাছে চাবি নাই। কী করে চাষাবাদ করবো। আবাদ করলে ফসল ডুবে যায়, অথবা লবণে পুড়ে যায়।’ আরেকজন বলেন, ‘পাবলিক যদি গিয়া বলে স্লুইসগেট ছাড়ো; তাইলে পাবলিক চরেও থাকতে পারবে না।’ এই কথার সঙ্গে ঘরের ভেতর থেকে একজন নারী যোগ করলেন, ‘চরে তো ভালো, বাংলাদেশেও থাকতে পারবে না।’ নিজের জমি আবাদ করতে না পেরে এভাবেই ক্ষোভ ঝরে মানুষের মনে। অথচ সুষ্ঠুভাবে সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে পারলে চরাঞ্চলের উর্বর জমিতে কৃষিতে বিপ্লব ঘটতে পারে।
চরমোন্তাজের সুলিজ বাজার থেকে উত্তরে চরলক্ষ্মী। এটাকে চররুস্তুমও বলা হয়। এখানে কৃষির সমস্যা নিয়ে আলাপ উঠতেই মো. এরশাদ নামের একজন কৃষক ডান হাতের তর্জনী তুলে আমার হাতের নোটবুক দেখিয়ে বললেন, ‘কৃষির কথা লিখতে ওই রকম নোটবুক দুইটা লাগবে।’ আমি অবাক হই! তার এই কথাটাই বলে দেয় কৃষকের মনে কত ক্ষোভ জমে আছে। পাশেই নির্মাণাধীন নতুন স্লুইসগেটটিতে সদ্য ফেলা বালু-সিমেন্ট-রডের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, যাদের জন্য এই স্লুইসগেট নির্মিত হচ্ছে, তারাই যদি উপকৃত না হয়, তাহলে এত টাকা ব্যয় করার কী প্রয়োজন? হয়তো এই নতুন স্লুইসগেটটির দিকেও নজর রয়েছে কোন প্রভাবশালীর। কিছুদিন পরে তার নামেই পরিচিত হবে স্লুইসগেটটি।
চরলক্ষ্মীর নির্মিতব্য নতুন স্লুইসগেটটির পাশেই আলাপ হচ্ছিল কয়েকজন বয়সী কৃষকের সঙ্গে। আমি তাদের মুখের দিকে তাকাই। দেখি চেহারায় বয়সের ছাপ। এদের কেউ কেউ প্রায় সারাজীবনই কৃষিকাজ করেছেন। একজন খলিল খা, বয়স ৬০ বছর। নিজের জমিতে আমন ধান, ডাল, মরিচ, তরমুজ আবাদ করতেন তিনি। নিজের চাষাবাদের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছিলেন, ‘পানি যখন বেশি হয়, তখন পানি সরানোর সুযোগ থাকে না। বীজতলা ডুবে যায় পানিতে। লবণ পানি ওঠানামার জন্য স্লুইসগেট হলেও তা কৃষকের কাজে আসে না। কারণ স্লুইসগেট থাকে প্রভাবশালীদের দখলে।’ খলিল খার এই কথায় সায় দেন বয়সী কৃষক বারেক হাওলাদার, মজিদ গাজী, হারুন গাজী, আবুল কাসেমসহ আরও কয়েকজন। এখান থেকে আলাপে জানতে পারি, চরমোন্তাজের মোট কৃষি জমির মধ্যে ৭০ শতাংশ ঘেরের আওতায় রয়েছে। বর্ষাকালে যখন ফসলি জমি পানিতে ডুবে যায় তখন পানি সরানোর উপায় থাকে না। আবার শীতকালে ঘেরে লবণ পানির ওঠানোর ফলে কৃষকরা রবিশস্য আবাদ করতে পারে না। কৃষকেরা ঘের মালিকদের রুখে দাঁড়ালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়।
২নং ওয়ার্ডের মধ্যমচর নলুয়ায় মাইনুদ্দিন শিকদার, জলিল মেলকারসহ আরও কয়েকজনের উপস্থিতিতে চরমোন্তাজের চারিদিকে বেড়িবাঁধে ৩০টি স্লুইসগেট রয়েছে বলে হিসাব পাই। এরমধ্যে ১৬টি সরকারি; বাকি ১৪টি বেসরকারি। এই তালিকা যাচাই করি, আরও কয়েকটি স্থানে। সকলেই একমত পোষণ করেন। সরকারি স্লুইস মানে এগুলো জনগনের সুবিধার্থে পানি নিষ্কাশনের জন্য সরকারি অর্থে নির্মাণ করা হয়েছে। আর বেসরকারি স্লুইস মানে হচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাছের ঘের করার লক্ষ্যে নিজেদের প্রয়োজনে সরকার নির্মিত বেড়িবাঁধ কেটে নিজেদের অর্থে স্লুইসগেট নির্মাণ করেছে। এগুলোর পানি ওঠানামানোর চাবিকাঠি তাদের হাতেই। নিজের টাকায় নির্মিত স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের কাছে থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। যদিও তারা অবৈধভাবেই সরকারি বেড়িবাঁধ কেটে এ স্লুইস নির্মাণ করেছেন। অন্যদিকে সরকারি অর্থে নির্মিত স্লুইসগেটগুলোও কিন্তু কোন না কোন প্রভাবশালীর দখলেই থাকে। সরকারি স্লুইসগেটগুলো কোন না কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে পরিচিত হওয়াটা তারই প্রমাণ করে। এখানে আছে আবু মিয়ার স্লুইজ, খলিফার স্লুইজ, কুদ্দুস খা’র স্লুইজ ইত্যাদি।
উপকূলের বেড়িবাঁধে স্লুইসগেট নির্মিত হয় জনগনের সুবিধার্থে; সময়মত পানি ওঠা নামানোর জন্য; জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচানোর জন্য; কৃষির সমৃদ্ধির জন্য। সরকারি অর্থে নির্মিত স্লুইসগেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা কৃষকদের হাতে। যাতে সুবিধামত সময়ে তারা পানি ওঠাতে এবং নামাতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। আসুন, সরকারি স্লুইসগেটের চাবিটা প্রকৃত কৃষকের হাতে তুলে দেই; আর বেড়িবাঁধ কেটে অবৈধভাবে স্লুইসগেট নির্মাণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। উপকূলের ছোট কৃষকের কথা একটু ভাবি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)